মাত্র পাশ করেছি তখন, আবেগগুলো তখনো পেশাদার হয়নি… ইন্টার্নশিপের প্রথম দায়িত্ব পরলো প্রসূতি বিভাগে… রোগিটির নাম মনে নেই, হয়তো সালেহা টাইপের কিছু ছিলো… সালেহা, লতিফা, মিরা কিংবা শুন্য সবাইতো একই নারী অনেক নামের আড়ালে…
সালেহার অবস্থা তখন খুব খারাপ… তার গর্ভের বাচ্চাটির একটি হাত বের হয়ে গিয়েছিলো… গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার নিয়ে আসা হলো, জনাব ডাক্তার পরামর্শ দিলেন হাতটি কেটে ফেলতে হবে, তাহলে নরমাল ডেলিভারি সম্ভব… কেটে ফেলা হয়েছিলো সেই বাচ্চাটির হাত…এই নির্মমতার বিচার করেছিলেন আল্লাহ্ তবে সেটা শুধু ভোগ করেছিলো সালেহা … অনেক আশংকাজনক অবস্থায় সালেহা কে এনে ভর্তি করা হলো আমাদের ওয়ার্ডে… সালেহার স্বামিকে দেখতাম প্রতিদিন বউ এর পাশে বসে কাদতো … সালেহাকে বাঁচাতে পেরেছিলাম, শেষ পর্যন্ত তার জরায়ু কেটে ফেলে … অনেকদিন ভর্তি ছিলো সে… উন্ড ইনফেকশন থেকে আরো অনেক জটিলতায় ভুগতে হয়েছে তাকে…
সেই হাতুড়ে ডাক্তার এবং তাকে সহযোগিতার জন্য গ্রামের মাতবর এর উপর কেস করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো…নেয়া হয়নি… টাকা থাকতে আবার কেস কেনো? প্রথম আলোর এক কোণায় ছোট করে ছাপা হয়েছিলো সেই নিউজ সাথে কর্তব্যরত ডাক্তার শুন্যের ইন্টারভিউ, তবে ছাপা হয়নি আমাদের সালেহার চোখের পানি…
মাস দুএক পরে গাইনি বিভাগে রোগী দেখছিলাম, পেছন থেকে কে যেনো আপা আপা বলে ডাকছিলো, কাছে গিয়ে দেখি সালেহা…অবাক হলাম, রোগীর ফাইল হাতে নিয়ে দেখলাম বাচ্চা হবার সময়ের কমপ্লিকেশনে তার ফিস্টুলা হয়েছে… অনবরত প্রস্রাব ঝরে যায়… খুব কষ্ট হচ্ছিলো বেচারির জন্য…অবাক হবার তখনো বাকি ছিলো… সালেহা বললো আপা আমার স্বামি অনেক টাকা পেয়েছে সেই হাতুড়ে ডাক্তার আর মাতবর এর কাছ থেকে… আর আমার সারাক্ষন এমন প্রস্রাব ঝরে সে ঘেন্নায় আমার কাছে আসেনা, সে আবার বিয়ে করেছে… কিছুক্ষন কোন কথা বলতে পারিনি… হায়রে মানুষ …
অনেকদিন ভর্তি ছিলো সালেহা… আমার রোগী ছিলোনা, তবে আমি তাকে দেখতে যেতাম … প্রায় মাস খানেক ভর্তি ছিলো সে, এর মাঝে একদিন দেখলাম তার পতিদেব কে…নতুন জামা কাপড়, নতুন স্যান্ডেল, তেল দিয়ে চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ানো …
এ হচ্ছে আমাদের দেশের গ্রামের একজন সহজ সরল পুরুষ …
২৬টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
অত্যন্ত কঠিন এক বাস্তবতা তুলে ধরেছেন ডাঃ সাহেব ।
শুন্য শুন্যালয়
অনেক বাস্তবতার সাক্ষী হয়েছি ভাইয়া এই পেশাতে এসে, সব তুলে দেওয়া কি সম্ভব ?
মা মাটি দেশ
সুন্দর উপস্হাপনায় বাস্তবতার নিরীখে নারী মূল্যান ভাল লাগল।এরকম পোষ্ট আমাদের চোখে রেয়ার।আরো লিখুন জানতে চাই আপনার কর্ম সাইটের অজানা কথা। (y)
শুন্য শুন্যালয়
ইচ্ছে আছে জানানোর… ধন্যবাদ ভাইয়া মন্তব্যের জন্য …
খসড়া
সালেহারাই কিন্তু টেনে নিয়ে যাচ্ছে সমাজ পরিবার রাষ্ট্র।ওদের যত চোখের পানি পরবে তত গতি পাবে রাষ্ট্রের চাকা। তেতুল হুজরই ঠিক।
শুন্য শুন্যালয়
ভালো বলেছেন ভাইয়া …
মর্তুজা হাসান সৈকত
বড়ই কঠিন বাস্তবতার অপূর্ব উপস্থাপন।
শুন্য শুন্যালয়
হ্যাঁ অনেক কঠিন বাস্তবতা… তার পরের ইতিহাস আমাদের কারোরই জানা নেই…
তন্দ্রা
এভাবেই এই সমাজ চলছে হইয়ত চলবে কিন্তু থাম্বেনা। এই অপকর্মের লকের কর্ম, এতাই বাস্তবতা।
খুব কষ্টের ও ব্যাদনার।
শুন্য শুন্যালয়
এই সমাজের পরিবর্তন চাই … আমাদের দেশের মতো এতো সস্তা চিকিৎসা ব্যবস্থা মনে হয় আর কোন দেশে নেই…
শিশির কনা
কি পিশাচ সালেহার স্বামী । সালেহার কারনে সে টাকা পেয়ে নতুন বৌ নিয়ে আনন্দে আছে , আর সালেহার চিকিৎসা হয় না । ইচ্ছে করে জুতা দিয়ে পিটাই ঐ বদ লোকটাকে ।
এমন অভিজ্ঞতার কথা আরো শেয়ার করুন আপু। ভালো লিখেছেন। -{@
শুন্য শুন্যালয়
ধন্যবাদ শিশির কনা..কত কিছু ইচ্ছে করে আমাদের, পারি আর কোথায় …
শেয়ার করবো আরোও আশা করছি…
নীলকন্ঠ জয়
সালেহার স্বামীকে আচ্ছা মতো পিটিতে পারতাম,তাহলে মনের জ্বালা মিটতো। এই সমাজের এরকম আরো ঘটনা আছে দিনের পর দিন যা পীড়া দিয়ে যাচ্ছে সালেহাদের।
ভালো লেগেছে। ধন্যবাদ শুন্য আপনাকে।
শুন্য শুন্যালয়
আপনাকেও ধন্যবাদ নীলকন্ঠ …এ পীড়ার মুক্তি কোথায়?
স্বপ্ন
এমন লেখায় বিবেককে অসহার করে দেয় , অক্ষমতার কষ্টে তলিয়ে যেতে থাকি। আমিও ঐ নিষ্পেষক শ্রেনীর একজন , এটি ভেবে লজ্জায় অবনত হই । এমন অবস্থা থেকে উত্তরন হবে কিভাবে ?
শুন্য শুন্যালয়
সবাই আপনার মতো করে ভাবলে সালেহাদের গল্পটা অন্যরকম হতো …
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্যে …
মিথুন
সালেহা, লতিফা, মিরা কিংবা শুন্য সবাইতো একই নারী অনেক নামের আড়ালে… ভালো বলেছেন আপু.
শুন্য শুন্যালয়
ধন্যবাদ মিথুন আপনাকে …
আদিব আদ্নান
আমাদের সালেহারা এমনই এ সমাজে ।
আপনি কাছে থেকে দেখেছেন আর আমরা দেখেও না দেখার ভান করে থাকি ।
শুন্য শুন্যালয়
ভান করাটাই সবচেয়ে সহজ পন্থা ভাইয়া …
আমাদের গল্প লেখায় তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবেনা …
তন্দ্রা
সকল ভাই-বোন দের উদ্দেশ্যে বলি এরকম হাজার সালেহার স্বামী আমাদের মাঝে, প্রতেকে যদি নিজের মনুসত্য নিজে নিজেই পরিবরতন করত সমাজ অনেক চেঞ্জ হতো।
শুন্য শুন্যালয়
সেটাই আপু…
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য…
বনলতা সেন
সালেহার স্বামীকে শূলে চড়াতে ইচ্ছে করে দু’বার । (একবার উল্টো করে)
আপনি ডাঃ ?
আপনার সাথে কি সব সময় ইনজেকশন থাকে মোটা সূইয়ের ?
শুন্য শুন্যালয়
সালেহার স্বামী …হাতুড়ে ডাক্তার সবগুলোকেই ইচ্ছে করে শুলে চড়াই …
হ্যাঁ সবসময় ইঞ্জেকশন নিয়ে ঘুরি…অপারেশন এর ছুরিও থাকে …
জিসান শা ইকরাম
সালেহারা এভাবেই বেঁচে আছেন
একে যদি বেঁচে থাকা বলে ,
তাহলে বেঁচে থাকা , অস্তিত্বহীন ,
নিজস্ব স্বত্বাধীন বেঁচে থাকা
অথবা শুধুই জীবন ধারন।
আপনার অভিজ্ঞতা পরে মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেলো। শিক্ষা , পারিবারিক ভাবে মেয়েদের সন্মান দিতে জানা , এই পরিবেশে শিশুদের বড় করা ব্যতীত এ মনোভাব যাবে না ।
এমন লেখা আরো শেয়ার দিন প্লিজ।
শুন্য শুন্যালয়
এটুকু পারলেই অনেক কিছু ভাইয়া …
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য…শেয়ার দেবো আশা রাখছি..