হেমন্তের শান্ত বিকেল। পিনপতন নীরবতা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের গ্যালারিতে। দেয়ালে স্বাধীনতা যুদ্ধের চিত্র। পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম অত্যাচারে নির্যাতিত নারী। ক্ষুধার্থ শিশুর আঁকড়ে ধরা মায়ের শূন্য বুক। গণকবরে গলিত লাশ। চুপচাপ দেখছিলেন এক নারী। বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট যেন চেপে রাখতে পারলেন না। হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। বললেন, আমি তো বাংলাদেশেরই নাগরিক। আমাকে কি একটা জন্মসনদ দিতে পারো? আমি এ দেশের পরিচয়টা বহন করতে চাই। নিজের মাকে হারালেও বাংলা মায়ের সন্তান হতে চাই। বুধবার সেগুনবাগিচার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দেশের ইতিহাস জানতে এসেছিলেন একাত্তরের যুদ্ধশিশু মনোয়ারা ক্লার্ক। তিনি থাকেন কানাডায়। পাকিস্তান বাহিনীর নির্মম অত্যাচার আর পাশবিকতার ফল মনোয়ারা। নিজের জন্য তার দুঃখ নেই। শুধু কষ্ট লাগে সেই নির্যাতিত মায়ের জন্য। যাকে সহ্য করতে হয়েছে পিশাচদের নির্মম নির্যাতন। তিনি বলেন, ‘আমি তো ভালোই আছি। কান্না পায় নির্যাতিত সেই মায়ের কথা ভেবে। যার গর্ভে আমার জন্ম। আমাকে নিয়ে মায়ের হয়তো অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। পিতার কথা মনে হলেই ঘৃণায় শরীর গুলিয়ে ওঠে।”আমায় একটি জন্মসনদ দিন’
একাত্তরের যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কানাডার একটি শিশুভিত্তিক সংগঠন তাকে নিয়ে যায়। দীর্ঘদিন সেখানেই বসবাস। হৃদয়ের টানে বিজয়ের মাসে নিজের মাকে খুঁজতে বাংলাদেশে আসেন তিনি। গতকাল বিকেলে সমকালের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আলাপচারিতায় এসব কথা বলেন তিনি।
স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কথা বললেন মনোয়ারা। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে জেনেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। ছোট্ট এ দেশটির অভ্যুদয় দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে নিজের সম্ভ্রম। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসের কথাও মনে আছে তার। তাই তো বিজয়ের মাসে আর ধরে রাখতে পারেননি নিজেকে। ছুটে আসেন নাড়ির টানে।মনোয়ারা জানান, বুঝতে শেখার পরই তিনি তার শরীরের পেছনের দিকে লম্বা একটি দাগ দেখতে পান। তিনি তার পালিত বাবা মি ক্লার্ক ও মা হেনরি ক্লার্কের কাছে জানতে পারেন, নির্যাতনের পর পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা বেয়নেট দিয়ে তার মায়ের শরীরে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়। মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় আঘাত পান তিনি। বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থায় জন্ম তার। এরপরই কানাডায় গমন।
তিনি বলেন, ভিন্ন দেশে ভিন্ন পরিবেশে বড় হয়েছি। সন্তান হিসেবে যত্নের কোনো ঘাটতিই ছিল না তার পালক বাবা-মার। সেখানেই প্রতিষ্ঠিত হন মনোয়ারা। বিয়ে করেন ফিনল্যান্ডের এক যুবককে। সংসার আলো করে আসে জুলিয়েট নামের এক কন্যা। উপচে পড়া প্রাচুর্য আর ঘরভর্তি সুখ থাকলেও কোথায় যেন শূন্যতা থেকেই যায়। লাল-সবুজের পতাকার কথা মনে হলেই বুকটা হাহাকার করে ওঠে। যদিও পাশ্চাত্য সভ্যতায় বেড়ে ওঠা। তবুও মনের কোণে লালন করেন বাঙালি ও বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা। গভীর এ মমত্ববোধ থেকেই দেশে আসা।পিতা-মাতার পরিচয়হীন এ যুদ্ধশিশু বলেন, দীর্ঘ সময় পার হয়েছে। পরিবর্তন ঘটেছে সবকিছুরই। হয়তো মাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবুও আমি মায়ের ভিটার ধুলা নিতে চাই। দেখতে চাই কোন জায়গাটায় জন্মেছিলাম আমি। এতে পিপাসার্ত হৃদয় একটু হলেও শান্তি পাবে।
বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশ খোঁজ রাখেন মনোয়ারা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে খুবই খুশি। চান যুদ্ধাপরাধীদের ট্রাইব্যুনাল দেখতে। এ বিচারের জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানান মনোয়ারা। দেশকে কলঙ্কের ইতিহাস মুক্ত করার আন্দোলনের জন্য গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনেও অভিভূত তিনি। সুযোগ থাকলে এ আন্দোলনে জড়িত হতেন বলে জানান। মনোয়ারা বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত ফাঁসি বাস্তবায়ন করা দরকার।দেশে দু’সপ্তাহের মতো থাকবেন মনোয়ারা। এ সময়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বুদ্ধিজীবী কবরস্থান, গণকবরসহ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গা ঘুরে দেখতে চান। বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করেন, একটি জন্মসনদ দেওয়ার জন্য। যেন বলতে পারেন, আমি বাংলা মায়েরই সন্তান।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী তাদের ক্যাম্পে প্রায় ২০ হাজার নারীর সম্ভ্রমহানি করে। বাড়ি বাড়ি থেকে নারীদের ধরে নিয়ে তাদের ক্যাম্পে দিয়ে আসে এ দেশের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তিবাহিনীর সদস্যরা। অনেক নির্যাতিত নারীর গর্ভে জন্ম নেয় কয়েক হাজার যুদ্ধশিশু। দুর্দশাগ্রস্ত এসব মা ও শিশুর নিরাপত্তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আহ্বান জানান।তার আহ্বানে সাড়া দেন কানাডার তৎকালীন মন্ত্রী ফ্রেড কাপুচিনো। ফ্যামিলিজ ফর চিলড্রেন সংগঠনের মাধ্যমে এ দেশের ১৫টি শিশুকে কানাডায় নিয়ে যান তারা। দত্তক দেন ১৪টি ফ্যামিলিকে। এর মধ্যে ১২ শিশুর জন্ম ঢাকার মাদার তেরেসা হোমসে। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসন করা হয় এই হোমসে। বাকি ৩ শিশুকে অন্য জায়গা থেকে সংগ্রহ করা হয়। এসব শিশুর বয়স ছিল ১০ দিন থেকে ১০ মাস। ১৯৭২ সালের ১৮ জুলাই এয়ার ইন্ডিয়ার একটি ফ্লাইটে এই শিশুদের কানাডায় নিয়ে যাওয়া হয়।
লেখাটি দৈনিক সমকাল পত্রিকা থেকে নেয়া হয়েছে।
২২টি মন্তব্য
মেঘাচ্ছন্ন মেঘকুমারী
এই প্রথম একজন যুদ্ধশিশুকে সেখয়াম। মনোয়ারা আপুটাকে শ্রদ্ধা জানাই। আপুটা যেনো তার মাকে খুজে পান এই কামনা করি।
প্রজন্ম ৭১
সমকালে লেখাটি পড়লাম, তাই শেয়ার দিলাম।
ছাইরাছ হেলাল
শ্রদ্ধা তাঁকে,তিঁনি যেন তাঁর প্রকৃত পরিচয় খুঁজে পান।
প্রজন্ম ৭১
তা কি সম্ভব এখন আর?
রিমি রুম্মান
যুদ্ধশিশুরা সমাজে আজ শ্রদ্ধেয়___ ভাবতেই ভাল লাগছে।
প্রজন্ম ৭১
কত দূর থেকে ছুটে এসেছেন নাড়ির টানে
জিসান শা ইকরাম
শ্রদ্ধা জানাচ্ছি মনোয়ারাকে। তার মায়ের প্রতি স্যাল্যুট। তার মার মত লক্ষ মা এর আত্ম ত্যাগেই আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।
প্রজন্ম ৭১
শ্রদ্ধা যুদ্ধশিশু মনোয়ারা এবং তার মায়ের প্রতি।
আবির
৭১ পাকিস্তানি নরপিশাচদের হাত থেকে কেউই বাদ যায়নি হোক বৃদ্ধা হোক শিশু, ঘটনাটি পত্রিকাতেই পড়েছিলাম, পড়ে আঁতকে উঠেছিলাম। শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
প্রজন্ম ৭১
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
মেহেরী তাজ
দেশকে দেখতে ছুটে এসেছেন উনি। খুব ভালো লাগছে। কান্না পাচ্ছে মাকে হয়ত উনি খুজেই পাবেননা।
খেয়ালী মেয়ে
যুদ্ধশিশুকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই…
নুসরাত মৌরিন
স্যালুট বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধ শিশুদের।
তাদের আত্মত্যাগের কারনেই আমরা পেয়েছি একটা দেশ,একটা পতাকা,একটা মানচিত্র।
ব্লগার সজীব
মনোয়ারা আপু যেনো জন্মসনদ পান এই কামনা করছি।দুঃখিনী মায়ের দুঃখিনী বোন মনোয়ারা।
শুন্য শুন্যালয়
উনি সৌভাগ্যবান তাই জন্ম সনদ চাইতে পারছেন। এদেশে থাকলে সারাজীবন মাথা নীচু করে থাকতে হতো।
প্রার্থনা করছি তার জন্য। বুকের মধ্যে খচখচ করছে কতোটা কস্ট নিয়ে আছেন তিনি এটা ভেবে। ভালো থাকুন বোনটা।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
”আমায় একটি জন্মসনদ দিন’
পারেনি দেশমাতা তাদের জন্ম সনদ দিতে বরং উল্টো তাদেরকে কলংক মনে করে দেশ থেকে দ্রুত বিতারিত করেছেন।
ভালো লিখেছেন ভাইয়া -{@
আজিজুল ইসলাম
আমাদের এই বোনের প্রতি রইলো অনেক অনেক বিনম্র শ্রদ্ধা। আমাদের ক্ষমা করুন বোন, আমরা আসলেই আপনার কাছে করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী আপনাদেরকে এদেশে রাখতে পারিনি বলে।
সমকালে লেখাটা পড়া হয়েছিল। এখানে পোষ্ট করার জন্য প্রজন্ম ৭১-কে অসংখ্য ধন্যবাদ।
বোকা মানুষ
যদি একাত্তরে আমার বয়স এক বছর না হয়ে পনের বা ষোল হতো, তবে মায়ের কসম, ওই পাকিস্তানী জানোয়ারগুলোর যতগুলোকে পারি মারতাম! অথবা, একটা টাইম মেশিন যদি পেতাম, তবে ৭১ এ ফিরে গিয়ে এরকম হাজারো মনোয়ারার মায়েদের উপর নির্যাতনকারী জানোয়ারদের খুঁজে খুঁজে মারতাম! লেখাটা পড়ে রক্তের উথাল পাথাল সামলাতে পারছিনা কোনোভাবেই! :@
নওশিন মিশু
আমাদের ইতিহাসের ঠিক এই জায়গাটায় আমি কখনই মন্তব্য করার কিছু খুঁজে পাইনা। আজ শুধু দাবী রেখে যাচ্ছি, প্রতিটি যুদ্ধশিশু যে যেখানে আছে তাদের যেন জন্মসনদ দেওয়া হোক…..
স্বপ্ন
শুন্য আপুর সাথে একমত।আমাদের দেশে থাকলে চিরকাল মাথা নীচু করে থাকতে হতো। যতই আধুনিক হইনা কেনো আমরা,এখনো আমরা মানুষ হতে পারিনি।
মিথুন
যাদের জন্য এ যুদ্ধ তাদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচানোর জন্য শিশুগুলো পাঠিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই মা গুলো? কেমন জীবন ছিলো তাদের কিংবা এখনো আছে? লজ্জাবনত শ্রদ্ধা জানাই তোমাদের মতো মা, বোন, ভাইদের———-
শিশির কনা
বিজয় মাসে বেশ কিছু ভালো লেখা পড়লাম।মনোয়ারা আপুকে কি জন্মসনদ দেয়া অসম্ভব কোন কিছু?শেয়ারের জন্য ধন্যবাদ।