শৈশব, কৈশোর এবং বড়বেলার খুব কাছের এক বন্ধুর কথা।
তাঁর একজন প্রেমিক ছিল। বাঁধভাঙা প্রেম ছিল। সময় সুযোগ একসাথে মিলিয়ে তাঁরা রঙিন প্রজাপতির মতন উড়তো। ভাঙচুর টাইপের এই প্রেম দেখে আমার খানিক বিরক্ত লাগতো, আবার প্রশ্নও জাগতো। পরিবারের তুমুল বিরোধিতা, কড়া শাসন এবং নানাবিধ মানসিক শাস্তির পরও এ সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার কোন কারন খুঁজে পেতাম না। ভাবতাম, বাবা-মা, ভাই-বোন নিয়ে যে পরিবার, পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় এবং দামী তো আর কিছু হতে পারে না। ক’দিনের পরিচিত একজন প্রেমিক কেমন করে এতো ক্ষমতা রাখে যে,একটি মেয়েকে জন্মদাতা বাবা-মা এবং পরিবারের সকলের মতের বিরুদ্ধে দাঁড় করবার !!
হোস্টেলে থাকবার সময় একদিন বন্ধুটি বিরিয়ানী রান্না করে প্রেমিককে খাওয়াবে বলে। নীচতলার কোনার দিকে প্রায় পরিত্যক্ত রান্নাঘরে রান্না বসিয়েছে। আমায় পাহারাদার হিসেবে সেখানে রেখে সে অন্য কাজে দোতলায় যায়। বিরিয়ানী হাড়িতে লেগে যাচ্ছে কিনা, পুড়ে যাচ্ছে কিনা সেই আতংকে আমি তা নাড়তে থাকি। নাড়তেই থাকি। এইদিকে বন্ধুটি এসে দেখে বিরিয়ানী ততোক্ষণে আলুভর্তা ! রাগে আমায় বকতে থাকে__” তোরে আমি নাড়তে কইসি ? তোরে এইখানে দাঁড়ায়া থাকতে কইসিলাম, তুই কি করলি !” আমি রান্নাঘরের ময়লা দেয়ালে ঠেস্ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। চোখ মুখ কুচকে নখ কামড়াই।
আরেকদিন বন্ধুটি রোড এক্সিডেন্ট করে পায়ে ভীষণ আঘাত পায়। ব্যান্ডেজ পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কপাল ভাঁজ করে হাঁটে। পরিবারের মানুষজন যখন তখন তাঁকে দেখতে আসে। ঝুঁকিপূর্ণ এক সময় ! কিন্তু তবুও প্রেমিকের সাথে দেখা সাক্ষাত, ঘুরে বেড়ানো থামে না। বাইরে যাবার সময় আমায় বলে যায়, ” বাসা থেকে কেউ এলে বলবি ডাক্তারের কাছে গেসি, পায়ে ড্রেসিং করাইতে “। আমি জানালার গ্রীলে কনুই রেখে উঁকি মেরে মেরে দেখি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভিজিটরদের। শিখিয়ে দেয়া মিথ্যা বিড়বিড় করে রিহের্সেল দিতে থাকি। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই যেন ওর পরিবারের মানুষজনের সামনে পড়তে না হয়। তাঁরা আসেন। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা শেষে যা বুঝার বুঝে নেন। এবং একসময় ফিরে যান।
পরিবারের তুমুল অমতে এমন প্রেম দুঃসাহসই বটে ! একদিন দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেরে ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটুকু করেই ফেলি বন্ধুটিকে। জবাবে সে বলে __
একদিন বইয়ের ভাঁজে তাঁকে উদ্দেশ্য করে লেখা আবেগীয় এক প্রেমপত্রের সন্ধান পায় বড় বোনেরা। দুইহালি ভাইবোনের প্রায় সকলেই তাঁর বড় বিধায়, বাবা-মা সহ সকলেই একযোগে তাঁকে তিরস্কার করতে থাকে। দিনের পর দিন। লেখাপড়া বন্ধ করে দেয়। এখানে, ওখানে, স্যার এর কাছে, কলেজে__ সবখানে যাওয়া বন্ধ। বড় বোনদের রেখে হুট করে তাঁকে অন্যত্র বিয়েও দেয়া যাচ্ছে না। অনেক অনুনয় বিনয় শেষে সে আবারো লেখাপড়া করবার অনুমতি পায় পরিবার থেকে।
পরিবারের সকলের অবহেলা আর বিরূপ আচরন একসময় আমার বন্ধুটিকে সেই মানুষটির প্রতি দুর্বল করে তোলে, যে মানুষটি তাঁকে প্রচণ্ড রকম ভালোবেসে একটি প্রেমপত্র দিয়েছিলো। প্রেমিকটির প্রতি তীব্র ভালোবাসার অনুভূতি জমতে থাকে তখন থেকেই। একসমুদ্র হতাশার মাঝে এক চিল্তে নির্ভরতার, ভরসার জায়গা খুঁজে পায়। অতঃপর তাঁহাদের প্রেম হয়। এবং একদিন সকলের অমতে পালিয়ে বিয়েও করে। বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে এই খবরটি পেয়ে আমি জ্ঞান হারাবার মতন অবাক হইনি।
যে কারনে লেখাটি লিখেছি__
প্রতিটি মানুষের দুটি রূপ। একটি দৃশ্যত অন্যটি অদৃশ্য। বাইরে থেকে দেখে অনুমান করে কোন মানুষকে অভিযুক্ত করলে হিতে বিপরীত হয়। দৃশ্যত আমরা যা দেখছি, তা-ই সব নয়।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৬টি মন্তব্য
মৌনতা রিতু
আপু তুমি তো অবিডিয়েন্ট বন্ধু ! গুছিয়ে শিখানো মিথ্যাগুলো বলছিলে ! যদি ধরা পড়তে ! বিরিয়ানি আলু ভর্তা !
সত্যি এই উথাল পাতাল প্রেম হয়ত একসময় ফুরিয়ে যায়।
রিমি রুম্মান
মিথ্যে বলার প্রয়োজন হয়নি।
আমি মিথ্যে বলার ভয়ে পালিয়ে থাকতাম। 🙂
প্রজন্ম ৭১
মানুষের আসলেই দুই রূপ আপু। বাইরে থেকে একরকম দেখি, বাইরেটাই সব নয়। যাকে আমরা খারাপ ভাবি বাইরেটা দেখে, ভিতরে হয়ত সে যথেষ্ঠ ভাল। আবার বাইরে ভাল কিন্তু ভিতরটা কালো এমন মানুষও আছে। মানুষকে বিচার করা খুবই কঠিন, খুবই কঠিন।
রিমি রুম্মান
সেটাই। আমাদের একের ভিতর দুই… যাকে আমরা দেখি এবং যাকে আমরা দেখি না…
নীলাঞ্জনা নীলা
প্রেম শাশ্বত, চিরন্তন। কিন্তু এই প্রেমই একলা করে দেয় সকলের থেকে। অনেক সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় প্রেমের কারণে। এমন এক প্রিয় বন্ধুকে হারিয়েছি তার প্রেমের কারণে। প্রেম এতোটাই স্বার্থপর যে অনেকদিনের বন্ধুত্ত্ব নষ্ট হয়ে যায় এক নিমিষে। তবে কিছু কিছু পরিবার আছে যারা কখনোই সন্তানের পছন্দের উপরে বিশ্বাস রাখেনা। তাতে হয় কি সন্তানরা মিথ্যে বলে, গোপন করে। এই যে তোমার বন্ধুটি এতো গোপন করতো না, যদি উনার পরিবার পাশে থাকতো।
রিমি আপু তুমি অনেক ভালো বন্ধু আসলে। আজকের লেখায় প্রমাণ পেলাম আবারও।
ভালো রেখো। -{@
রিমি রুম্মান
আমার বন্ধুটি কিন্তু আগে প্রেমে পড়েনি। অহেতুক সন্দেহ তাঁকে সেদিকে যেতে বাধ্য করেছে।
অতঃপর জেদ বাড়তেই থাকে … শেষে একদিন বড় বোনদের আগেই পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে।
নীলাঞ্জনা নীলা
সন্দেহ মারাত্মক ক্ষতি করে।
ভাগ্য ভালো আমার ওই রোগটি নেই।
ছাইরাছ হেলাল
ঠিক ই বলেছেন,
বাইরে থেকে দেখে আপনি আমাদের জন্য এত্তগুলো ভাল লেখেন
বোঝাই যায় না!!
রিমি রুম্মান
হা হা হা … বেশ বলেছেন …
ইঞ্জা
জেদ মানুষকে অনেক দূর নিয়ে যায় যেমন ২০০১ আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, প্রেম কিন্তু প্রেমেই সুন্দর কিন্তু তা যদি পরিণতিতে গড়াই তাহলে সবার উচিত বুঝে শুনে চলা।
রিমি রুম্মান
তখন কি আর বুঝে শুনে চলার মতন স্বাভাবিক চিন্তা ধারা কাজ করে ? তবে ভুল ভুঝে আমরা বড়রা আদতে ভুল পথেই ঠেলে দিচ্ছি ছোটদের। দৃশ্যত আমরা যা দেখি, তা-ই সব নয়।
ইঞ্জা
ঠিক বলেছেন আপু
আবু খায়ের আনিছ
আমার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, মুদ্রার পরের পৃষ্ঠার কি হলো? আর সেই মুদ্রার প্রস্তুতকারকের কি হল?
সুখি হলে কোন সমস্যা নেই, কিন্তু যদি হিতে-বিপরীত হয়ে যায় তখন?
এমন ঘটনা প্রতক্ষ্য করেছি জীবনে, আর ফলাফল দুটোই দেখেছি।
তবে হ্যা, বাহির থেকে দেখে মানুষকে কখনোই চিনা যায় না।
রিমি রুম্মান
তাঁরা ভাল আছে দুই সন্তান নিয়ে। দীর্ঘ বছর পর তাঁদের পরিবার তাঁদের মেনে নিয়েছে আংশিক। কিন্তু ওই যে, জন্মদাতা বাবা, মা, সহ পুরো পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় করল, কষ্ট দিল, সে অনুশোচনা কুড়ে কুড়ে খায় প্রতিনিয়ত আমার বন্ধুটিকে। মুলত, সে ভাল আছে দৃশ্যত। আদতে ভাল নেই।
লীলাবতী
বুঝতেই পারিনি প্রথমে এভাবে শেষ করবেন লেখা। আমার মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছিল, এত্তবড় সাহস ওই মেয়ের আমাদের মায়াবতী আপুকে এমন করে খাটায়! শেষে এসে তো ওই মেয়ের প্রতি মায়া জমে গেল। দ্বৈততা থাকেই আমাদের মাঝে আপু। জীবন থেকে নেয়া ঘটনাদি নিয়ে আপনার মত সুন্দর উপস্থাপন করতে কাউকে দেখিনি আর।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
সত্যিই মানুষের দুটি রূপ
আপনার বিরানি পাকানোটা বেশ হয়েছে বেচারা প্রেমিকের ভাগ্যে এমন বিরানি আলুর ভর্তা।নিশ্চয় নয় এখন বিরানি রাধেন সেই রকম।ভাল থাকুক সুস্থ্য থাকুন।