প্রতি শনিবার সকালে ছেলেকে সুইমিং পুলে পাঠিয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় বসে টিভি স্ক্রিনে তার সাঁতার শেখা দেখি। অন্য শিশুদের তুলনায় রিহান বয়সে ও উচ্চতায় বড়। তা সত্ত্বেও সে অনেকটাই পিছিয়ে। আমি স্পষ্টই দেখতে পাই, অন্যরা কোনো সাপোর্ট ছাড়া অবলীলায় কিছুদূর সাঁতরে যেতে পারে। রিহান তার প্রশিক্ষকের সহযোগীতা ছাড়া বেশিদূর যেতে পারে না। হাবুডুবু দশা। টিভি স্ক্রিনে এইসব দেখার ফাঁকে ফাঁকে আমি ডানের টেবিলে বসা এক তরুণীর দিকে দৃষ্টিপাত করি। চায়নিজ, জাপানিজ আর কোরিয়ানদের আলাদাভাবে শনাক্ত করা কঠিন। ছোট চোখ, বোঁচা নাক, রেশমের মতো ঝরঝরে চুল, মসৃন ত্বক। মেয়েটি এ গোত্রের হবে হয়ত। কফির কাপে চুমুক দিয়ে গভীর মনোযোগে বই পড়ে সে। কখনো সশব্দে হেসে ওঠে। দৃশ্যটি খুব সাধারণ। তবুও আমি প্রতি সপ্তাহে টিভি স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তাকে দেখি। তার অভিব্যাক্তি দেখি। হেসে ওঠা দেখি।
এদেশের লাইব্রেরীগুলোতে গেলে যে কারো ভেতরে একরকম ভালোলাগা কাজ করে। শান্ত, পরিচ্ছন্ন, নিরিবিলি পরিবেশ। সুনসান নীরবতার মাঝে সকলেই গভীর মনোযোগে লেখাপড়ায় ডুবে থাকে। কেউ ল্যাপটপে, কেউবা কম্পিউটারে। লাইব্রেরীটিতে কাজ করে তরুণ কিছু ছেলেমেয়ে ও একজন প্রবীণ। লোকটি বয়সের তুলনায় বেশ কর্মঠ। সেলফে বই গুছিয়ে রাখে। সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় ল্যাপটপে ডুবে থাকা কোনো তরুণকে মুখ থেকে সামান্য সরে যাওয়া মাস্ক সঠিকভাবে পরতে সতর্ক করে দিয়ে যায়। কখনোবা কোনো তরুণীকে তার এক পায়ের আধো খোলা জুতাটি ঠিকভাবে পড়ার আদেশ করে। বইয়ের পাতায় নিমগ্ন থাকলেও আমি প্রায় সময় অপেক্ষায় থাকি এ পথে হেঁটে যেতে যেতে আজ কাকে কী বিষয়ে সচেতন করবে সে!
ভোরের দিকে জিমে এক মধ্যবয়েসি নারীর সঙ্গে তার টিনএজ দুই পুত্রকে ট্রেডমিলে দৌড়াতে দেখি। বড় জন ধীর, স্থির, শান্ত। ১৪/১৫ বছরের ছোটছেলেটি স্পেশাল চাইল্ড। দুরন্ত। চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি। সে এমনভাবে কুঁজো হয়ে দৌড়ায়, আমার প্রায়শই মনে হয়, এই বুঝি উল্টে পড়ে যাবে। হেডফোনে গান শুনতে শুনতে আমি সেদিকে তাকাই রোজ। কোনোদিন না দেখলে ডানে-বাঁয়ে খুঁজি। যদিও তাদের সঙ্গে আমার কখনোই কুশল বিনিময়টুকু পর্যন্ত হয়নি। তবুও। কখনোবা আমার সামনের সারির ট্রেডমিলে তাল ঠিক রেখে দ্রুতলয়ে হেঁটে চলা নিখুঁত শারীরিক গঠনের রমণীকে খুঁজি। তার ঝুঁটি বাঁধা লম্বা সোনালী চুল জলের ঢেউয়ের মতন ছন্দে ছন্দে দুলে ওঠা দেখতে অপেক্ষায় থাকি।
কোনো কারণ ছাড়াই আমরা রোজ কত কিছুর জন্যে অপেক্ষা করি! এইসব অপেক্ষা, অচেনা মানুষের উপস্থিতি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে ছোটখাটো আনন্দের কারণ হয়ে ওঠে।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৫টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যাঁ আপু, অনেক কিছুই চোখে চেয়ে দেখে মনের অজান্তে/ জেনেও। অনেক অবলা কথা উঠে আননে। আপনার গল্পের সারি আমার বেশ ভালো লাগে।
ধন্যবাদ আপু।
আলমগীর সরকার লিটন
সু্ন্দর লেখেছেন ভাল ও শুভেচ্ছা জানাই আপু ভাল থাকবেন
হালিমা আক্তার
চলার পথে অচেনা অজানা মানুষ গুলো আমাদের মনে অজান্তেই ঠাঁই করে নেয়। খুব ভালো লাগলো। শুভ কামনা রইলো।
ছাইরাছ হেলাল
অসাধারণ আপনার দেখার চোখ।
ভাল থাকবেন আপনি।
মাছুম হাবিবী
কোনো কারণ ছাড়াই আমরা রোজ কতকিছুর জন্য অপেক্ষা করি। সত্যি এটা একদম সত্য কথা।
পুরো লেখাটা পড়ে ভালো লাগলো।