ভোরের আবির্ভাব...
ভোরের আবির্ভাব…

দেখতে দেখতে “এলোমেলো কিছু কথা”র ষোলোটি পর্ব হয়ে গেলো। অথচ এই এলোমেলো কথা পর্বগুলোর জন্ম হয়েছিলো অভিমান থেকে। মধ্যিখানে লেখা ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখনও ব্লগে আসিনি, ফেসবুকে কোনো লেখা দেয়া থামিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু শুভাকাঙ্খী, সুহৃদ থাকেই প্রত্যেকের জীবনে। আমি ফেলতে পারলাম না। তখনই ফেসবুকে লেখা শুরু করলাম “রোজনামচা” নামে। তারপর “এলোমেলো কিছু কথা।” ৪ এপ্রিল, ২০১৪ ইং তারিখে লেখা শুরু করি “রোজনামচা”, আর ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪ ইং তারিখে “এলোমেলো কিছু কথা।” ফেসবুকে আমার বন্ধু তালিকায় সকলেরই ভালো লাগলো এমন লেখাটা। বলতে গেলে আমিও কিন্তু “দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাচ্ছি” এমন আর কি! আমি নিজেকে দিয়ে দেখি কবিতা-গল্প সাহিত্যের সকল শাখা-ই অসম্ভব প্রিয় আমার। নতূন বই পেলেই হলো, বসে যাই। নেশা নাকি ভালো না, তাহলে বই নিয়ে এই যে নেশা আমার, একে তো কেউ খারাপ বলেনা? যাক যা বলছিলাম, “এলোমেলো কিছু কথা” লেখার পর মনে হলো আসলে আমরা সকলেই অন্যের মনের সাথে নিজের মনকে মেলাতে চাই। সেই চাওয়াটা কিভাবে পাওয়া হয়ে ওঠে? অন্যের কিছু জানার পরেই। আমি দেখেছি আমার জীবনের সাথে এমন অনেকের জীবনের মিল আছে, আবার অনেকেরই নেই। অবাক হইনা কিভাবে এতো মিল হতে পারে!

যাক “এলোমেলো কিছু কথা”র জন্মবৃত্তান্ত। এবারে আসি নিজের লেখা নিয়ে। আমি ব্লগে যখন এসে লিখি, আমার আলাদা কোথাও আলাদা ফোল্ডারে রাখা নেই। যদি ব্লগে একটি লেখাও হারিয়ে যায়, কোথাও পাবো না খুঁজে। হুম ফেসবুকে কিছু লেখা অবশ্য আছে। কিন্তু ব্লগে যেদিন থেকে নিয়মিত হলাম, সোনেলাকে ভেবেই লিখি। কিন্তু আজ পর্যন্ত নিজের মন ভরাতে পারিনি। আমার মামনি বলে, “তুই যে কাজ করে সন্তুষ্ট হতে পারবি না, সেই কাজ কিছুতেই অন্যও পছন্দ করবে না।” তার মানে তো আমার সব লেখাই একটা এলোমেলো অবস্থায় এসেছে এখানে? ওহ মামনিকে জানিয়ে দিয়েছি সবাই যে কতো শুভেচ্ছাবাণী দিয়েছে। কি যে খুশী। আমায় বললো, “আমি তো ক্ষুদ্র এক ধূলিকণা, সবাই এভাবে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে, লজ্জ্বা লাগছে রে।” বললাম ক্ষুদ্র ধূলিকণা হয়েছো, কিন্তু কারো চোখে গিয়ে তো খোঁচাওনি, তাই সবাই ভালোবাসে। গতকাল ফোন দিতেই বললো, “জানিস ভিয়েনা থেকে শিল্পী ফোন দিয়েছিলো? এত্তো ভালো মেয়েটা, কখনো দেখিনি, অথচ মনে হয় কতোকালের চেনা!” বললাম প্রশংসা রাখো, তোমার চোখে কে খারাপ এটা একটু বলো। “আর জানিস ঊর্মীও ফোন দিয়েছে। অনেকক্ষণ কথা বললো। ওহ তোর যে লিপা ভাবী সেও ফোন দিয়েছে।” মামনির মন তো আবেগাপ্লুত হবারই কথা। আমি নিজেই যে হয়ে গেছি। এমন বন্ধু কতোজনে পায়? আমি জানিও না ওরা যে মামনির জন্মদিন মনে রেখেছে। তারপর ফোনও দিয়েছে। অথচ এমন অনেক মানুষও আছে পরিচিত, যারা আপন আপন মুখেই বলে। কাজে গোল্লা।

কতোকিছু যে বলে যাচ্ছি। আমার ছেলেটার কথা বলি একটু। যতো বড়ো হচ্ছে, ততোই জানি কেমন লাগে দেখতে! ওইটুকুন একটা কাদা-মাটির দলাকে কোলে নিয়ে গান শোনানো। ওর নরম নরম হাতের আঙুলে আলতো করে কামড় দেয়া, পায়ের পাতায় চুমু খাওয়া। কি যে ছিলো। আমার ছোট বোন ওকে ডাকতো ধাবলা-দুবলা। সেই ছেলেটা আর মাত্র আটদিন পর হাইস্কুলে যাবে। আমার এক্সিডেন্টের পর অনেক বেশী আদর করে আমায়। সকালে উঠেই আমার পেটে এসে মাথা রাখে। তারপর গল্প করে এখানে এই পেটে যে ছিলো আমি কি ব্যথা পাইনি? হাসি আর বলি এখন ব্যথা পাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে বলবে, “ওহ স্যরি! আচ্ছা আস্তে করে রাখি মাম?” ফিজিও দিতে যাই, দরোজা খুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরবে। আমার ইচ্ছে করে সেই আগের মতো করে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু উল্টো আমায় তুলে নেয়। বাবা-মা যে একদিন শিশু হয়ে যায় নিজের বাপি-মামনিকে দিয়ে দেখি। আমিও কি তাহলে শিশু হবার পথে হাঁটছি?

শরৎকাল চলে এলো। রাতের হাওয়ায় হাল্কা হিম হিম। আর কিছুদিন পরই শীতের চাদর পড়ে নেবে প্রকৃতি। সবুজ হারিয়ে যাবে। হেমন্ত ঋতু দেখা হয়না কতোকাল! এতো সুন্দর একটা দেশ আমাদের, আজকাল গ্রীনহাউস ইফেক্টের জন্য সারা পৃথিবীর আবহাওয়া বদলে গেছে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের দৌরাত্ম্য বেশী। অরণ্য ধ্বংস করে, সবুজকে মেরে ফেলে বিশাল বিশাল অট্টালিকা বানানো হচ্ছে। আমাদের বিষাক্ত কার্বন যারা খাবে, তারাই তো নেই। আর আমরা পাচ্ছিনা সেই পরিমাণ অক্সিজেন। কল-কারখানার দূষিত বর্জ্য নদীর জলে, সমুদ্রে। সৌরজগতের আর কোথাও পৃথিবীর মতো এতো সবুজ অরণ্য আর নীল আকাশ নেই। অথচ আমরা মানুষ তার যত্ন করতে পারলাম না। প্রকৃতি নীরবে আর কতো সইবে? এদিকে সারা পৃথিবী জুড়ে চলছে জঙ্গী হামলা। দিদিমা-ঠাকুমারা বলতো, “এখন কলিযুগ।” ছোটবেলায় জিজ্ঞাসা করতাম, কলিযুগ মানে কি? আবারও বলতো, “কলিকাল রে দিদি, মানুষ এমনও হবে যে শিশু আর শিশু থাকবে না। চলতে শুরু করলেই আস্ত মানুষ হবে। শৈশব-কৈশোর এসবের কিছুই থাকবে না। এই হলো কলিকাল।” তাঁদের কথাই তো ঠিক। পেপারে পড়ি দশ থেকে চৌদ্দ বছরের শিশুরা মানুষ খুণ করে। কার নাটকে জানি এই সংলাপটা ছিলো, “হায়রে কলিকাল, ছাগলে চাটে বাঘের গাল!”

এতোকিছুর মধ্যেও এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা দিন-রাত নীরবে-নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছেন সুন্দর এই পৃথিবীটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে। কেউ তাঁদের লেখনী দিয়ে, কেউ গবেষণা করে, কেউবা গায়ে-গতরে খেটে। আমরা যদি নিজেদের ঘর থেকেই শুরু করি গাছ লাগানো, আমাদের দেখে আরোও কেউ না কেউ তো করবে। বাঙ্গালী মহিলাদের আসরে শুধু শাড়ী-অলঙ্কারের গল্পই চলে, আর পুরুষদের আসরে রাজনীতি, সমালোচনা। কাউকে দেখিনা একটা গান-কবিতা-বৃক্ষ এসব নিয়ে আলোচনা করতে। পহেলা বৈশাখ বিএনপি’র, তো আওয়ামীলীগও আলাদা করে পহেলা বৈশাখ। সকল বাঙ্গালী এক হয়ে আজ পর্যন্ত একটা পহেলা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, মাতৃভাষা দিবস, বিজয় দিবস কিছুই পালন করতে দেখলাম না। ভাষা নিয়ে বড়ো বড়ো কথা বলে, ঘরে দেখা যায় ছেলে-মেয়ে বাংলা বলতেই পারেনা। কিছু বললে ভাব নিয়ে বলবে, “দিদি এ দেশেই তো থাকবে। দেশে তো আর ফিরে যাবেনা।” কাক যতোই ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়ে নাচুক না কেন, কাকই থাকে। পাঁচ প্রজন্মও যদি দেশের বাইরে থাকে, হাজার সিটিজেনশিপ থাকলেও শুনতে হয়, “হোয়ার আর ইয়্যু ফ্রম?” অনেক কথা আজ বলে ফেললাম। যতো যা-ই হোক শুধু চাই এ পৃথিবীতে শান্তি আসুক। যুদ্ধ থেমে যাক, নবজাতক শিশুদের থেকে আরেকটি সুন্দর পৃথিবীর জন্ম হোক। অনেক প্রিয় কবিতার মধ্যে সুকান্ত’র “ছাড়পত্র” আমার অনেক প্রিয় একটি কবিতা। আগে পুরোটা মুখস্থ ছিলো, একা একা আবৃত্তি করতাম।

“এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

এলোমেলো কথাগুলো কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এলো আমায়, তাই না? তবুও বলি, এতো কিছুর পরেও হাসি আছে আমার ঠোঁটে। বিশাল এক আশা আছে। স্বপ্ন আছে। আজও নিরাশা আমায় গ্রাস করতে পারেনি। জানিনা এ শক্তি আমি কোথা থেকে পাই! আমার যারা বন্ধু, সবাই জানতে চায় কিভাবে পারি? উত্তর কি দেবো আমি?——

সুচরিতা আজ তুমি যতো দূরেই যাও
তোমাকে টেনে নেবে তোমার অতীত
দূরবর্তী দ্বীপের বাসিনী হয়ে কতোদিন আকাশের তারায় চোখ রাখবে ?
পায়ের নীচে শ্যাওলাগুলো ঠিক তোমাকে দেবে পিচ্ছিলতার যন্ত্রণা
এরপর বিবর্তন যতোই হোক না কেন
তুমি এই তুমি-ই থেকে যাবে
নিঃসঙ্গ-একাকী এবং একলা…। (নামহীন কয়েকটি পংক্তি)

সবুজের ঢলে...
সবুজের ঢলে…

হ্যামিল্টন, কানাডা
২৭ আগষ্ট, ২০১৬ ইং।

এলোমেলো কিছু কথা…**পনেরো**

১৯৪৬জন ১৯৪৭জন

৪৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ