ঋণ

শুন্য শুন্যালয় ২৩ জুলাই ২০১৬, শনিবার, ০৩:২৯:০৬পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৬০ মন্তব্য

ক্লাস শেষে খাতাপত্র হাতে এক দৌঁড়ে বাথরুম সিরিয়াল দিতে গেলাম। বাথরুম খালি থাকলে দুইখান চাঁন্দ হাতে পাওয়ার মতই আনন্দ, কিন্তু না, আজ অমাবশ্যা। সর্বনিম্ন যেই সিরিয়াল পাইলাম তার নাম্বার ৭ এবং কামরুন নাহারের পরের সিরিয়াল আমার। মুখ কালো করে রুমে ঢুকলাম। রুমে ঢুকতেই মুন্না আপু জিজ্ঞেস করলো, বাথরুম পাইছো? তোমার পরে আমি।
বললাম ঠিক আছে আজ আর গোসল করতে হবেনা।
কেন?
কারন আমার আগে কামরুন।

কামরুন আমার ক্লাসমেট এবং পরে আমার রুমমেট হয়েছিল। তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হাতে ছোট্ট এক বাটিতে কাঁচা হলুদ আর ময়দা মিশিয়ে বাথরুমে ঢোকা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, মাঘ মাসের শীত, টাইফুন এমনকি আমাদের ৪০ নাম্বার সিগন্যাল প্রফেশনাল এক্সামও এই রুটিনের কোন পরিবর্তন আনতে পারে নাই। একবার এক দূর্যোগের সময় কলেজের বিদ্যুত সাপ্লাই, পানি সাপ্লাই সব বন্ধ হয়ে গেলো, শুনতে পেলাম শহরের একমাত্র বাজারেও বন্যার পানি উঠেছে তবুও রিস্ক নিয়ে আমরা বাজারে ছুটলাম বেশি করে মোমবাতি, শুকনা খাবার এসব জমিয়ে রাখতে। কামরুন হন্যে হয়ে কাঁচা হলুদ খুঁজতে লাগলো।

মুন্না আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা (বুয়া) কই?
বলে, বিদায় করে দিয়েছি।
কি? আমার মাথায় হাত। কেন?
বলে, পলা বরিশাল থেকে ফিরেছে। কেরোসিনের স্টোভে মাত্র ভাত চড়াইছে, খালাকে বললাম এক কৌটা চাল বেশি দেন খালা। খালা তার ছেলের সর্দি মুছে চালের ডিব্বায় হাত ডুবিয়ে চাল তুলে না ধুয়েই চুলার অই হাড়ির মধ্যেই ছেড়ে দিলো।
ইয়াক!
বলেছি ধন্যবাদ খালা, বাড়ি যান আবার পরে দেখা হবে।
খালার শোকে আমি পাথর হয়ে গেলাম। রান্নাবান্না বিশাল ভেজালের কাজ। ওদিকে রিপা আপু পড়তেই আছে, তার এদিকে কান নাই, দুইদিন পর কার্ড ফাইনাল পরীক্ষা। জিজ্ঞেস করলাম, রিপা আপু কাল ঘুমের মধ্যে কি লিখতে ছিলেন?
কয়, কি লিখছি?
তা কি আমি জানি? বিড়বিড় করে কি বলতেছিলেন আর শূন্যে আঙ্গুল দিয়ে কি যেন লিখতেছিলেন। মুন্না আপু বললেন হা হা তুমি ওর হাতে তখন একটা খাতা ধরিয়ে দিতে।
এই মুন্না আপুর কথা আগে একবার লিখেছিলাম। মনে আছে সেই কাঁটা পায়ের গল্প? আমার খুব পছন্দের আপু ছিলো, আপু তার সব কথা আমাকে শেয়ার করতো। আপুটা যেন পরে কেমন হয়ে গেলো। এক হুজুরের সাথে বিয়ে হলো, আমি পাশ করে বের হবার আগেই তিন বাচ্চার মা হয়ে গেলো। মিস করি আপুকে।

হাত মুখ ধোবার জন্য বেসিনে গেলাম। হাতে পানি নিতেই হাত ফস্কে পানি পরে গেলো। কারন -গান। বি ব্লক থেকে উচ্চ স্বরে গান গাইছে আইরিন আপু, “চোর আমি, ডাকু আমি বলোনারে, দুনিয়াতে সাধু আছে কয়টিরে?” সেকেন্ড ব্যাচের দজ্জালদের ভীড়ে এই একজনই হাসিখুশি আর মজার এক আপু। তার জুনিয়ার রুমমেটের সাথে তার সারাক্ষন লেগেই থাকতো, মধুর ঝগড়া যাকে বলে। তাদের কথোপকথন এমন ছিলো—
-তোর মতো ঝগড়াটে মেয়ে প্রত্যেকদিন জামাইএর কাছে লাত্থিগুতা খাবে।
=তাইলে আপনিও কম খাইবেন না।
-তা খাইতে পারি, তবে আমি হলফ করে কইতে পারি তোর থেকে আমি দুইদিন সংসার বেশি করুম
=তা করতেই পারেন, সবাই তো আর আপনার মতো লাত্থিগুতা খেয়ে সংসার করতে পারেনা। 😀

রুম চেঞ্জ করার পরে এবার আমার রুমে সবাই এক ক্লাসের। রাত দুইটার সময় সবার ভাব উঠলো, অই গান ধর। আমি চ্যাঁচাইতে শুরু করলাম, “অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন কেঁটে যায়”।
একটু পর আইরিন আপু গজড়াইতে গজড়াইতে আসলো (তার কএকদিন পর এক্সাম)। দেখি, মাঝ রাত্রিরে ময়না টিয়া কইরা কে চিল্লায়। মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম আপু স্যরি, আর গাইবোনা। প্রসংগত এর দু একদিন আগেই বিল্ডিং এর নানা কাজ চলছে। আমাদের ব্লকের টাইলস লাগাবোর জন্য মিস্ত্রীরা এসে যেই মেশিন চালু করেছে, আইরিন আপু বললো, কি হচ্ছে এখানে?
টাইলস লাগাবো।
কোন টাইলস ফাইলস না, বের হন এখান থেকে। ব্রেইনে এমনিতেই গিট্টু লেগে আছে পড়তে পারছিনা।
প্রিন্সিপাল স্যার বলছে।
আপনার প্রিন্সিপাল স্যার কিংবা তার আব্বারে গিয়া বলেন আমি টাইলস লাগাতে দেইনাই। যান এখান থেকে। মিস্ত্রীদের আর ত্রি সীমানায় দেখিনাই।
সেই আপু ঝাড়ি দিয়ে সারারাত জেগে আমাদের রুমে বসে গান গাওয়ালো পানিশমেন্ট হিসাবে। আপু মিস ইউ।

মনে পড়ে,
রাত ১০ টার মধ্যেই ঘুমিয়ে যাওয়া কে রাত ১২ টায় একদিন ক্লাসমেটরা এসে খাট থেকে টেনে ফেলে দিলো। ভূমিকম্প ভেবে উঠে দেখি বান্দরনী গুলো। বলে, আজ বিজয় দিবস আর তুই ঘুমাচ্ছিস? থালাবাটি চামচ দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে ছাদে গিয়ে উঠলাম। এরপর গান, দেশের যতগান,  “একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতায়”, “প্রতিদিন তোমায় দেখি সূর্য্যরাগে” আরো কতশত–
এখানেও প্রসংগত উল্লেখ্য, কলেজের একমাত্র ছাত্রাবাসের ছাদ আমাদের থেকে মাত্র কএক হাত দূরে ছিলো 😉

প্রিয় কলেজ,
ফিরে ফিরে আসবোই, তোমার কাছে যে আমার অক্ষত ঋণ …

৭০৬জন ৭০৬জন

৬০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ