শ্রদ্ধেয় স্যার,
আমার বিশ্বাস সৃষ্টিকর্তা আপনাকে অনেক ভালো রেখেছেন। আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। সেই যে গেলেন আমাদের ছেড়ে। চলে যাবার সময় আপনি বলেও যাননি কোথায় যাচ্ছেন। একটা ঠিকানা কিংবা ফোন নাম্বার কোনোটাই রেখে যাননি। শুধু আপনার একটা ব্রিফকেস আজো আমাদের ঘরে যে রুমটাতে আপনি থাকতেন সেখানটায় রাখা আছে যত্নে। কলেজ কমিটি আপনার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারেনি বলে অভিমান করে চলে গেলেন ভোরের আলো ফুটবার আগেই। যেদিন চলে গেলেন আমাদের গ্রাম ছেড়ে সেদিন সকালে আপনার পিয়ন আমাদের বাসায় এসে কেঁদে কেঁদে জানাল আপনি রাগ করে চলে গেছেন।
খবরটা শুনে খুব মর্মাহত হয়েছিলাম। এভাবে চলে যাবেন ভাবতেও পারিনা। আব্বু অনেক খুঁজেছে আপনাকে।
জানেন স্যার, আপনার নিজ হাতে গড়া কলেজটা অনেক নাম করছে আমাদের উপজেলায়। মাত্র ৭ জন ছাত্রী নিয়ে আপনি যাত্রা শুরু করেছিলেন ১৯৯৯-এ। বেতন ছাড়াই আপনি মাসের পর মাস, বছরের পর বছর খেঁটেছেন কলেজটা দাঁড় করাতে। রাতে ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিতেন আপনার ছাত্রীরা পড়ছে কিনা। আপনার কলেজ থেকে এখন প্রতিবছর অনেক ছাত্রী বের হয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান করে নিচ্ছে। কলেজের মুখ উজ্জ্বলকরছে। অনেক ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে প্রতিবছর। আপনি দেখলে অবাক হবেন টিনের ঘর ভেঙে দালান উঠেছে।
স্যার, আপনি কলেজ ছেড়ে চলে গেলেন ২০০২-এ। ২০০৯ এ এমপিওভুক্ত হলো আপনার কলেজটা। শিক্ষকদের বেতনের জন্য আপনি কতকিছুই না করেছেন। আপনার গুণগ্রাহী অনেকেই জিজ্ঞেস করে আপনার কথা। কিন্তু তাদের কিছুই বলতে পারিনা আপনার সম্পর্কে।
স্যার, আপনার রেখে যাওয়া ব্রিফকেসটা খুলেছি ক’দিন আগে। এছাড়া আমার কিছুই করার ছিলনা। আপনার ঠিকানা খুঁজতেই এ কাজটা করেছি আমি। ক্ষমা করবেন আমাকে।কিন্তু কোনো ঠিকানা বা ফোন নম্বর ছিল না ব্রিফকেসে। তবে আপনার একটা ছবি পেয়েছি। ছবিটা যে খামে ছিল তাতেও এমনভাবে আটকে আছে যে আপনার মুখবয়ব অস্পষ্ট হয়ে গেছে।
আমার মনে আছে আপনি এই ব্রিফকেসটাই নিয়ে
এসেছিলেন আমাদের গ্রামের কলেজটা প্রতিষ্ঠা করতে। আপনার সংসার বলতে ঐ ব্রিফকেসটাই -মাঝেমাঝে আপনি বলতেন। ব্রিফকেসটাতে আপনার প্রিয় জিন্নাহ টুপি, ২টি লুঙ্গি, ১টি পাঞ্জাবি, ১টি পাজামা, ১টি তোয়ালে, কলম, কাগজ, একটি সাবান রাখা ছিল। ভিতরটা ছত্রাক লেগে গিয়েছিল। লুংগি আর পাঞ্জাবিটা ধুয়ে আবার রেখে দিয়েছি যত্নে। আব্বু আপনাকে আমাদের গ্রামের কলেজের জন্যই এনেছিল। কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আপনি। শুধুমাত্র গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মানুষের স্বার্থে আঘাত লেগেছিল বলে আপনাকে তাঁরা পথের কাঁটা ভেবে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। আর আপনি রাতের অাঁধারে কাউকে কিছু না জানিয়ে সেই যে চলে গেলেন আর ফিরে এলেন না। কতোটা মন:কষ্টে, দুঃখ নিয়ে আপনি চলে গেলেন কলেজটা ছেড়ে। আপনার মতো সরলমনা মানুষ খুব কমই দেখেছি আমি।
আমাকে যদি বলা হয়, আমার প্রিয় শিক্ষক কে?
উত্তরে বলব গোলাম কিবরিয়া।
আব্বুর স্যার বলে আমরা সবাই স্যারই ডাকতাম আপনাকে। একটা দুঃখ মনের ভিতর রয়ে গেছে, আপনার ছাত্র না হতে পারার দুঃখ। তবে পরজন্ম বলে যদি কিছু থাকে তবে সে জন্মে আমি আপনার ছাত্র হয়ে জন্মাতে চাইব। আপনার ক্লাশের শেষ বেঞ্চের এককোণে হলেও একটুকু জায়গাই চাইব স্রষ্টার কাছে।
জানেন স্যার, আমার গ্রামের মানুষ আপনাকে অপমান করেছে, এটা মনে করে আব্বু মনোঃকষ্টে ভোগেন। আব্বুর প্রিয় স্যার ছিলেন আপনি। আপনার জন্যই আব্বু শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিতে পেরেছিলেন। আপনার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে আব্বুও শিক্ষকতা জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে।
বছর পাঁচেক আগে খবর পেলাম আপনি চলে গেছেন পৃথিবীর মায়া ছেড়ে। আমার এখনো বিশ্বাস হয়না আপনি নেই। ভাবতেই কষ্ট হয় আপনার সংসার নামক ব্রিফকেসটির জন্যও আপনি আর আসবেন না আমাদের মাঝে। আপনার ব্রিফকেসটা অনেক যত্নে রাখা আছে। না ফেরার দেশে চলে গেছেন আপনি তবু একটি চমকে উঠার দিনের অপেক্ষায় আছি।
আল্লাহ আপনার বেহেশত নসীব করুন।
ইতি
আপনার স্নেহের
ইকরাম
৩৬টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
চিঠির মাধ্যমে জানতে পারলাম একজন স্যারের গুনের কথা।
স্যারের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী।
আল্লাহ্ তাঁকে বহেশত নসীব করুন……… আমীন।
ইকরাম মাহমুদ
নিজের মান রক্ষার জন্য নীরবে চলে গিয়েছিলেন তিনি। তার সম্মান আমার গ্রাম এর মানুষরা দিতে পারে নি। এজন্য আমি লজ্জিত। যদি দেখা হতো স্যারের সাথে তবে ক্ষমা চেয়ে নিতাম। দোয়া করবেন তার জন্য।
নিতাই বাবু
সম্মানিত ইকরাম মাহমুদ
দাদা আপনি ভালো লিখেছেন, লেখায় একজন স্যারের কথা জানা হলো। জেনে ডুঃখ পেলাম দাদা।
স্যারের পরিবারবর্গের প্রতি জানাই সমবেদনা
ইকরাম মাহমুদ
আমার দেখা স্যারকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ধন্যবাদ দাদা। স্যার চিরকুমার ছিলেন। ছাত্র-ছাত্রীরাই ছিল স্যারের সন্তান। কলেজ ছিল তার বাড়ি।
নীলাঞ্জনা নীলা
আমরা শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে পারিনা।
আমাদের সকল জীবনে শিক্ষকদের অবদান কতোটা, সেটা খুব কম মানুষই স্বীকার করেন।
শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের প্রতি প্রণাম।
ঈশ্বর উনার আত্মার মঙ্গল করুক।
চিঠি ভালো লেগেছে।
ইকরাম মাহমুদ
সত্যিই পারিনা। শিক্ষকের অবদানও স্বীকার করতে জানিনা। আমরা কবে মানুষ হবো! কবে শিক্ষা গ্রহনের মানসিকতা তৈরি হবে!
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনি অনেক ভালো একজন মানুষ। শিক্ষকের অবদান স্বীকার করেন বলেই এমন একটি পোষ্ট লিখেছেন।
মেহেরী তাজ
শিক্ষকরা এমন হলেই না ছাত্ররা তাকে মনে রাখবে!
পরপারে ভালো থাকুক আপনার পছন্দের আদর্শ সেই শিক্ষক!
ইকরাম মাহমুদ
কর্মই মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে হাজার বছর। স্যার আমাদের মাঝে নেই তবে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।
ব্লগার সজীব
মনটা খারাপ হয়ে গেল ইকরাম ভাই। ভাল মানুষরা বেশী দিন থাকেন না।
ইকরাম মাহমুদ
ভালোদের মিছিলটা খুব বড় হয়না। ভালোদের জন্য আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে উপহার বোধহয় এটাই। খারাপদের কর্তৃক লাঞ্ছিত হওয়ার আগেই নিয়ে যান তার কাছে। দোয়া করবেন স্যারের জন্য। আল্লাহ তার বেহেশত নসীব করুন। আমীন
প্রহেলিকা
ভাল লেখা। স্যারের জন্য শ্রদ্ধা। ভাল থাকুক তিনি যেখানেই থাকুক।
ইকরাম মাহমুদ
ধন্যবাদ, আপনাদের দোয়া, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা শ্রদ্ধেয় স্যারের পাথেয় হবে পরপারের।
অরণ্য
গোলাম কিবরিয়া স্যারের রূহের শান্তি কামনা করছি।
সময়ে আমরা এমন শিক্ষকদের পাব এবং সাথে অনেক ইকরাম – সেই আমার আশাবাদ।
ইকরাম মাহমুদ
প্রতিজন্মে আমি এমন শিক্ষকদের সান্নিধ্য পেতে চাইব। আপনাদের দোয়া আল্লাহ কবুল করুন। আমীন
শুন্য শুন্যালয়
প্রকৃত মানুষগুলো প্রকৃত ভালবাসা ও শ্রদ্ধা কিন্তু পায়, হোক তা দেরি করেই। খারাপ লাগছে এই ভেবে যে মানুষটা যদি এই চিঠি দেখে যেতে পারতেন!
অনেক শ্রদ্ধা আপনার স্যারের জন্য। উনি ভালো থাকুক ওপারে।
অনেক আবেগ দিয়ে লেখা চিঠি।
ইকরাম মাহমুদ
এ চিঠি স্যারের কাছে পৌঁছুবে না, জানি।
যদি পৌঁছাতো তবে ব্যথিত চিত্ত একটু হলেও প্রশান্তি পেত। যত্নে গড়া মহিলা কলেজটির অবস্থা জেনে নিশ্চয়ই খুশি হতেন তিনি।
ছাইরাছ হেলাল
এমন স্যার এখন বিরল,
শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি,
চিঠির মাধ্যমে হলে এমন গুণীজনের কথা জানতে পারে ভালোও লাগল।
চিঠি সুন্দর হয়েছে।
ইকরাম মাহমুদ
গুণীজনের গুণ কখনো আড়ালে থাকেনা। আমি ইকরাম ছাড়াও স্যারের অনেক গুনগ্রাহী রয়েছেন যারা স্যারকে এভাবে মিস করে অথবা লিখেও। এমন গুণী শিক্ষকের ছাত্র হতে পারিনি তবে সান্নিধ্য পেয়েছিলাম স্যারের। আপনাদের দোয়া স্যারের পরজীবনের পথের পাথেয় হয়ে থাকবে।
নীহারিকা জান্নাত
একজন শিক্ষকের সফলতা এখানেই যখন কেউ তাকে মনে রাখে। চলে যাবার পরেও ভাবে তাঁর কথা। সন্মান জানায়। এমন শিক্ষক হতে পারা বিরাট গুণের ব্যাপার।
আল্লাহ আপনার স্যারকে বেহেশত নসীব করুন।
আমীন।
ইকরাম মাহমুদ
আমীন
ইঞ্জা
মনটা কেঁদে উঠলো, এমন জনপ্রিয় স্যারকে মানুষ কিভাবে অপমান করতে পারে ভেবেই পাইনা, মানুষ যে অমানুষ হয়ে গেছে এ যে তারই প্রমাণ, স্যারের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি, আমীন।
ইকরাম মাহমুদ
ঐ গ্রামের বাসিন্দা হিসেবে আমি নিজে খুবই লজ্জিত। স্যারের সাক্ষাত পেলে ক্ষমা চেয়ে নিতাম নিজেও।
মিষ্টি জিন
ভাল লোক মানুঁষ কেন জানি পৃথিবীতে বেশী দিন থাকে না।
স্যারের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা আর দোয়া।
অনেক ভাল হয়েছে লেখা।
ইকরাম মাহমুদ
সত্যিই তাই। ভালোরা আসেন স্বল্প সময়ের জন্য। ভালোত্বই ভালোদের বাঁচিয়ে রাখে অনন্তকাল।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
স্যারের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলী।
আল্লাহ্ তাঁকে বহেশত নসীব করুন……… আমীন।
ইকরাম মাহমুদ
অামীন
গাজী বুরহান
হয়। আমাদের সমাজে এ গুলো অহরহ হয়। ভালোরা থাকেনা।
.
.
ভিন্ন রকম চিটি পড়ে ভালো লাগল।
ইকরাম মাহমুদ
ভালোদের জন্য অন্য জায়গা।
ধন্যবাদ ভাই
নীরা সাদীয়া
হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেল। মনে হচ্ছে যেন শ্রদ্ধেয় স্যারকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এরকম কিছু ভালমানুষ থাকেন নীরবে নিভৃতে।।
ইকরাম মাহমুদ
আমি এখনো দেখতে পাই। ঝাকড়া চুল, ফ্রেন্স গোঁফ, মাথায় জিন্নাহ টুপি, সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা, হাতে একটা ছোট্ট ব্রিফকেস।
আবু খায়ের আনিছ
আধিপত্য বিস্তারকারীদের কাছে বারবার পরাজিত ভালো মানুুষগুলো। শিক্ষক মহোদয়ের কি প্রয়োজন ছিল সেই সময়ে তা সেই মানুষগুলো উপলব্দি করতে পেরেছিল কিনা জানিনা কিন্তু তাদের স্বার্থের প্রয়োজনযে খুব বড় ছিল তা অনুমান করতে পারি।
সমাজের কিছু চিহ্নিত কীট থাকে, এদের কিছু করা যায় না বরং বিষ ফোড়াঁর যন্ত্রনার মত এদের সহ্য করতে হয়।
স্যারের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। সেরা চিঠিগুলোর একটি এই চিঠি। শুভ কামনা ।
ইকরাম মাহমুদ
সমাজের কীটগুলোই কিভাবে যেনো সমাজে টিকে যায়। ভালোরা ঝরে যায় অকালে। এ কেমন বিচার? কীটের ধ্বংস দেখার অপেক্ষা করছি কিন্তু দিব্যি সে কীটগুলো সমাজটাকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে।
শ্রদ্ধেয় স্যারকে সোনেলায় পরিচয় করিয়ে দিতে পেরেছি তাই আমি অনেক গর্বিত। সবার দোয়া ও ভালোবাসা নিশ্চয়ই আল্লাহ পৌঁছে দিবেন।
আবু খায়ের আনিছ
কীর্তিমানের মৃত্যু নেই, কথাটা মনে পড়ে গেলো, তোমার মত ইকরামদের মনে স্যারেরা জায়গা করে বেচেঁ থাকবে অনন্তকাল।
মোঃ মজিবর রহমান
একজন শিক্ষন তাঁর প্রাপ্য সন্মান তো পেলেন্নি না আবার বিতাড়িত।
সন্মানীয় শিক্ষক তাঁর প্রাপ্য সিন্মান ফিরে পাক কোথাও সেই কামনা করি।
ইকরাম মাহমুদ
স্বার্থান্বেষী ক্ষমতাধর কীটের থেকে সম্মান পাবার চেয়ে ভোরের আলো ফুটার আগেই চলে যাওয়াই বোধকরি সম্মান রক্ষার মতোই ভেবেছিলেন। আর এই স্যারের বাড়ি ভোলা জেলায়। উনি টাংগাইল জেলার হলে হয়তো তার পক্ষে কথা বলার মানুষের কমতি থাকতোনা। স্যারের পক্ষে আমার বাবা ছাড়া কেউ ছিল না। যারা ছিল তারাও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। স্যারের প্রাপ্য সম্মান তিনি পাবেন। দোয়া করবেন তার জন্য সম্মানিত জায়গায় যেন রাখেন সৃষ্টিকর্তা।