আমাদের পরিবারটা বেশ বড়। আমরা প্রতি বছর একবার বাড়িতে যাই সবাই মিলে। উদ্দেশ্য পরিবারের প্রতিটি সদস্য বছরে একবার আন্তত একত্রিত হওয়া । আমরা রাতের ট্রেনে করে সবাই মিলে ঢাকা থেকে এলাম। এটা একটা মজার যাত্রা। এবার আমাদের সাথে এসেছে আমার মেঝবোনের ছেলে ও তার বউ বাচ্চা, যে চাকুরি সূত্রে সৌদীআরবে থাকে । সে অনেক দিন পর তার নানা বাড়ীতে এল বেড়াতে। বড়ভাই এর ছেলে যে থাকে আমেকিরাতে সে আর ওর ছোট বোন এ অস্ট্রেলীয়াতে থাকে, অনেক দিন পর এল। ওরা আসাতে আমাদের এবারের বাড়িতে অবস্থানটা বেশ জাঁকজমক পুর্ণ। চোখে পরার মতো। আমারা বাড়িতে গেলে এম্নিতেই সমস্ত গ্রামে সাড়া পরে যায়।
আমাদের এখানে কখনও চুরি ডাকাতির কথা শোনা যায়নি। আর আমাদের বাড়িতে তো প্রশ্নোই উঠে না। আমাদের বাড়ি মোটামুটি খোলাই থাকে দিন রাত। আমরা আসাতে গ্রাম শুধু কেন, আশে পাশের গ্রাম থেকেও অনেকে আসছে যাচ্ছে। এত মানুষ এসছে যে কে কখন আসছে আর কে কখন যাচ্ছে তার ঠিক নেই।আমরা এমনিতেই আড্ডাবাজ তার উপরে এতগুলি প্রিয়জন একসাথে হও্য়া মানে, যার কোন অর্থ নেই কিন্তু মূল্য অনেক।
সবাই মিলে হইচই করা, এই ক্ষেত থেকে পটল তুলা, সেই পটলের জাঙীর নিচে শেলীপা ছোট মানুষের মত ঢুকে হামাগুড়ি দিয়ে পটল তুলতে যেয়ে সত্যি কারের পটল তোলার দশা, এর ক্ষেতে ক্ষিরা, ওর ভূমির বেগুন, তার জমির শাক, কে মালিক? কে খোঁজ নেয়। বাচ্চারা মুরগীর বাচ্চা ধরছে, হাঁসের বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে,কবুতর ধরছে, এর হাঁস নিয়ে এসে বলছে পিকনিক করবো, ওর ছাগলের বাচ্চা ঢাকা নিয়ে যাব। পুকুরগুলি ক্লান্তিহীন সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, মাছ তো দিচ্ছেই সেই সাথে এত্ত মানুষের দাপাদাপি। এটা ওদের দাদা বাড়ি ওদের অবারিত দ্বার। এখানে কেউ ওদের বাধা দেবার নেই। আমরা মোটামুটি যে কয়দিন থাকি গ্রামে ত্রাহী ত্রাহী দশা শুরু হয়ে যায়। আসার সময় সব ক্ষতিপূরন করে দিয়ে আসা হয়, কারন তারা তো আমাদের মত স্বচ্ছল নয়। যারা অবস্থাপন্ন তাদের কথা আলাদা ,তারা আরও বেঁধে ছেদে দেয়। সারাদিনের ও রাতের এই সব হুটোপূটির ফল হল এর গা চুলকাচ্ছে এর কোমরে ব্যাথা, সে খোঁড়াচ্ছে।
রাতে শুতে শুতে প্রায়ই দুইটা তিনটা বেজে যায়। মাঝে মাঝে ফজরের আজান পড়ে যায়, তখন হায় হায় করে বিছানার দিকে দৌড়। বিছানায় শুয়েও এঘর ওঘর থেকে এর ওর সাথে টীক্কা টিপ্পনি করতে করতে কখন যে কে ঘুমায় তার কোন ঠিক নেই। শোবার ব্যাপারে আর কি বলব? যে যেখানে পারছে শুচ্ছে।
আমাদের গ্রামে কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি নেই। আমার শেলীপার বরের নাম জামান। আর বড় ভাইয়ে অস্ট্রেলিয়ান জামাইএর নামও জামান। যাই হোক একজন কে আমরা দুলাভাই বলি আর একজন তো জামাই। কাকে দুলাভাই আর কাকে জামাই নিশ্চই বুঝতে পারছেন।
আমি আমার বাচ্চাদের পাশে শুয়ে সবার গল্পে আংশগ্রহন করছি। সবাই বাড়ীর ভিতরে উঠানে গোল হয়ে বসে গল্প করছে, গল্পের বিষয় অবশ্যই সবার ছেলেবেলার পাকামি, বোকামি। আর হাসা হাসি করছে। সবাই সবার পিছনে লেগে রয়েছে। কে কবে কি করেছে, না করেছ, এই সব নিয়েই ভাই বোনদের খুনটুসি । ভাইবোনদের কারো কারো সাথে বছরে হয়তো একবারই দেখা হয়। এটাই সবচেয়ে আনন্দের ব্যপার । একে একে ধীরে ধীরে সবাই শুতে চলে যাচ্ছে । যে ঘুমাবার সে ঘুমাবে আর যে আড্ডা মারার সে বিছানা থেকেই চিৎকার করছে।
শেলী আপার বর হোচ্ছেন জামান দুলাভাই। দাদার স্ত্রীকে বড়ভাবী বলি। বড়ভাবী শেলী আপাকে আমাদের ডানপাশের ঘরটা দেখিয়ে বলল “জায়গাতো নাই, এই রুমে মামুন আর তোর দাদা শুয়েছে, তুই জামানের পাশে শুয়ে পড় যা। জামান ওই ঘরে আছে।” শেলীপাকে আমাদের ঘরের বাম দিকের ঘরে যেতে বলায় আমি ক্ষিণকন্ঠে বললাম “কে বলল জামান দুলাভাই ওই ঘরে ?!”
ভাবী বলল “আমি তো নিজে দেখে এলাম। হারিকেন নিয়ে নিজের চোখে !!” লাবনীও বললো –“ফুপু ফুপার পাশে জায়গা আছে, ছোটকাকা আসার আগেই দখল কর।” এখানে আর কিছু বলা যায় না। যার স্বামী সেই ভাল চিনবে আমি কেন তর্ক করি। আমি তো খালি শুনেছি। দেখিনি! তবে আমার মনে হল, আমি যেন শুনলাম যে দাদা বলছে জামাইকে “তুমি ফ্রী হয়ে ঐ ঘরে থাক, আমরা এদিকে ব্যাবস্থা করছি, যদি যায়গা না হয় তখন না হয় লাবনী বাচ্চাদের নিয়ে তোমার ঘরে যাবে।” আমার কথা বলার দরকার কি, একে মহিলা মহলে ঢুকেছি যদি বেড় করে দেয়।?
শেলী আপা তো চললেন অন্ধকারে তার বর জামানের কাছে শুতে। বড়ভাবী এলেন আমার বিছানায়,বললেন-“তুই মরতে বচ্চাদের পাশে কেন?” এতবছর বিয়ে হয়েও আলাদা শুতে পারিস না”
বললাম পায়ে ধরি ভাবী মেয়েজামাই/ছেলেরবউ সবাই শুনবে, চুপ করে ওর পাশে শোও । অন্ধকার আমি কিছু দেখব না।” হঠাৎ শুনি পাশের ঘর থেকে মামুন হো হো করে হাসছে। সঙ্গে জামান ভাই শেলীআপা দাদা সবাই। ব্যাপার কি ভাই বাপার কি? খোঁজ নিয়ে জানলাম,ব্যাপার আর কি ?
শেলী আপা সব সময় জামান দুলাভাইএর সাথে ধমকানোর সুরে কথা বলে। (এই অভ্যাস শুরু হয়েছে নাতি নাতনীরা হবার পর থেকে।) সেই সুরে সে বিছানায় যেয়ে দুলাভইকে বলল “সরো তো। বাপের বাড়ি এসেও তোমার যন্ত্রনা। তুমি জানো যে আমি সামনের দিক ছারা শুই না । সরো সরো ।” বলে দুই হাত দিয়ে বেশ জোড়েই ঠেলা। সদ্য ঘুম ভেঙ্গে দুলাভাইএর তখন ছেড়াবেড়া অবস্থা। দুলাভাই আর একবার ধাক্কা খেয়ে ধাতস্থ হলেন এবং বিন্দু মাত্র দেরী না করে বলে উঠলেন “ ফুপু আমি এখনও ঘুমাই নি। আমি যাচ্ছি, আমি যাচ্ছি।” আর যায় কোথায়? মামুন আর জামান দুলাভাই এই ঘর থেকে হা হা হা করে হেসে উঠল। ওই ঘরে দাদাও হাসতে হাসতে হেচকি তুলছে। আর শেলীপা হি হি হি করে হিক্কা তুলতে তুলতে বলছে “হায় হায় ছিঃছিঃ, লাবনী তুই মানুষ, ছিঃছিঃ জামাই এটা ? ভাবী তোমার আক্কেলের বলিহারি,।” জামাই সেই যে ঘর ছাড়লো, কোথায় যে গেল? পরে শুনেছি শালাদের সাথে ছিল।
আর কি সারা রাত ঘুম হয়। হা হা হি হি করতে করতে রাত ভোর হয়ে গেল। আজান পরল । সবাই নামাজে গেল। চা চলে এল। এভাবেই একটা রাত গেল।
কাল বলব দ্বিতীয় রাতের গল্প
৩২টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
বেশ সুখকর পরিবার চলুক সমান তালে সমান হাসিতে।অপেক্ষায় ২য় রাতের।
খসড়া
সত্যিই এমন জীবন মাঝে মাঝে খুব প্রয়োজন হয় বেঁচে থাকার জন্যই। ধন্যবাদ।
স্বপ্ন
:Overjoy: :Overjoy: হাসতে হাসতে আমারও আজ রাতে ঘুম হবেনা ভাইয়া। প্রথম দিকে আনন্দ উল্লাস গুলো খুব চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন।
খসড়া
ধন্যবাদ। বাঙ্গালী খুব সুখি জাতি কারন বাঙ্গালী হাসতে জানে। ভাল থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
এই মহানন্দ দেখে হিংসে হচ্ছে ।
পরের পর্বের অপেক্ষায় । আমাদের দাওয়াত দিলে মন্দ হত না ।
খসড়া
দাও্যাতের অপেক্ষায় যে থাকে সে হল হতভাগা। তার চেয়ে গন্ধ পেলেই সেখানে হাজির হতে হয় তবেই না জ়িবন।
ছাইরাছ হেলাল
হতভাগারাও দাওয়াত চায় । গন্ধ শুঁকে গেলে কোথায় না কোথায় গিয়ে পড়ি ঠিক আছে কিছু ।
তাই দাওয়াতের ভরসা ই থাকি ।
খসড়া
ঠিক আছে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ডাকছি আসুন আবার ঈদ চলে এসেছে। আজ সকালেই ঠিক হল যাচ্ছি ঈদে বাড়ি। আসুন মজা হবে, অনেক রেস্টলেস আনন্দের চারটি দিন।
আগুন রঙের শিমুল
😀 😀
খসড়া
:D)
ব্লগার সজীব
হাহাপগে :v
খসড়া
আমাদের ও হাহাপগে :D)
শুন্য শুন্যালয়
আমি ঈর্ষান্বিত। এমন আনন্দ আমাদের ছাড়া উপভোগ করা ঠিক না।
দুই জামান নিয়ে আরো কাহিনী হবার আশংকা দেখা যাচ্ছে। আপনার লেখায় ঈদ ঈদের আনন্দ পাচ্ছি। এবার দ্বিতীয় রাতের অপেক্ষা।
খসড়া
ঠিকই ধরেছেন ঈদের কাহিনী। এবার ও ঈদে যাব। কি ঘটবে কে জানে? প্রতিবারেই কিছুনা কিছু ঘটে।
পুষ্পবতী
আত্মীয়স্বজনরা এক সাথে হলে অনেক আনন্দ হয়।আপনাদের আনন্দ মুহুর্তগুলো পড়ে আনন্দিত হলাম। -{@
পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
খসড়া
ধন্যবাদ , পড়েছেন আনন্দিত হয়েছেন এতেই আমি কৃতার্থ।
নুসরাত মৌরিন
হাহাহা।
আপনার গল্প পড়তে পড়তে আমার নানু বাড়ি যাওয়ার স্মৃতি মনে পড়ে গেল। একই অবস্থা হয় যখন পাঁচ খালা আর ছয় মামার সব আন্ডা বাচ্চা এক হই… 😀
খসড়া
সবাই একসাথে হলে আর জায়গা হয় না, মাটিতে বিছানা তাতেও হয় না, কাজের লোকগুলির ত্রাহি মধুসূধন দশা।
স্বপ্ন নীলা
আমিও খুবই মজা করে প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত পরলাম,,,যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি — আন্তরিক ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য ——–
খসড়া
এই সময়টা এত্ত মজা হয় যা আসলে বলা যায় না। আর কোথাদিয়ে যে এই দিন গুলি চলে যায়। ক্লান্তি বিহীন। যখন ভাঙ্গে মিলিনমেলা তখন শরীর ভেঙ্গে পরে ক্লান্তিতে। তা কাটাতেই সময় লাগে এক সপ্তাহ।
ওয়ালিনা চৌধুরী অভি
এত আনন্দময় লেখা পড়ে নিজেও তাতে ডুবে গেলাম। কার গাছের , কার বাড়ির হাস মুরগী খাসি – এই অংশটুকুই যথেষ্ট আনন্দ বুঝানোর জন্য। ঘুমানোর পর্বে যে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি এটিই আশ্চর্য ।
খসড়া
জামাই শ্বাশুরীর এই ঘটনা কি যথেষ্ট দুর্ঘটনা নয়। :p
মিসু
এমন আনন্দের অভিজ্ঞতা ভাগ্যের বিষয়। আপনি অনেক ভাগ্যবান ।
খসড়া
ধন্যবাদ। আপনারাও তৈরী করুন এমন জগৎ দেখবেন এর কাছে থিম পার্ক বা রেস্টুরেন্টে খাও্যা পানসে লাগবে,।
মিথুন
খুব মজা করে বর্ননা করলেন ভাইয়া। আমার তো আপনাদের সাথে জয়েন করতে ইচ্ছে করছে।
খসড়া
চলে আসুন এই তো আবার যাব ২ অক্টোবর।
বনলতা সেন
আপনাকে হিংসে করি।
খসড়া
কেউ আমাকে হিংসা করে এটা শুনেও নিজেকে ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। 😀
জিসান শা ইকরাম
এমন আনন্দময় পরিবেশ এর কথা এই প্রথম শুনলাম।
অসাধারন ।
রাতের গল্প পড়ে হাসতে হাসতে শ্যাষ ।
খসড়া
জিসান ভাই আমাদের এই মিলন্মেলায় একবার আসলে বার বার আসতে চাইবেন, আপনাকে আমরা ফাইভস্টার আরাম দিতে পারব না কিন্তু একজন মাটির মানুষের সব সমস্যা দিয়েই আনন্দে রাখব।
লীলাবতী
শুধু হাসতেই আছি ভাইয়া 🙂
খসড়া
হাসিতেই বাঁচিতে চাই। খুব সুন্দর মন্তব্য।