যারা অনেকদিন আগে আমার আত্মজ পরিচয় পড়েছিলেন তাদের জন্য । (ক্ষমা প্রার্থী অনেক বড় লেখা বলে, তৃতীয় বা শেষ খন্ড অচিরেই দেব)
আজ দুদিন দু’রাত কি করে কাটছে নন্দিতার , তা শুধু সেই জানে । সারা শরীরময় অবসাদ , বুকের ধুকপুকানিটা বেড়েছে অনেক । ঘুম নেই চোখে একবিন্দুও । ভুল হচ্ছে, ভুল হচ্ছে সকল কাজে । নন্দিতা কি বেচে আছে ? নিজেকে নিজের কাছে কেমন যেন অসার, মৃত মনে হচ্ছে । নিজের কাঠগড়ায় নিজেই দাঁড়াচ্ছে , কখনো আসামী হয়ে, কখনো বিচারক হয়ে ; বাদী হতে পারছেনা কিছুতেই । বাদীর জায়গায় দাড়িয়ে আছে অনন্য, মেয়ে অনন্যা আর এই সমাজ ।
আজ ত্রিশ বছর পর কি ভয়ঙ্কর সত্য মুখ ব্যাদান করে হাসছে তার দিকে । একি সত্যের নির্মমতা না’কি নিয়তির পরিহাস । না পাপ বলবে না কিছুতেই, নন্দিনী পাপ করেনি কোন ভাবেই । তাহলে , তাহলে আজ এত ভয় , এত শঙ্কা কেন ? কি বলবে তাকে যখন সে তার পিতৃ পরিচয় জানতে চাইবে ।
আছে নন্দিনীর মেয়ে অনন্যা , তাকেই বা কি বলবে নন্দিনী? বলবে এই ওর জীবনের কাহিনী । এক দুর্বৃত্ত বন্ধুত্বের খোলসে ওর বিশ্বাসকে হরন করে । সব কিছু গোপন রেখে শুধু পরিবারের মুখ চেয়ে জীবন সত্যকে মেনে নিয়েছিল নন্দিনী । কি’বা করার ছিল ওর । সব গোপন করে একটা সুন্দর সুস্থ পারিবারিক জীবনের লোভ কি খুব দোষের ।
সমাজ বলবে ভুল হয়ত ছিল কিন্তু তাই বলে জলজ্যান্ত সন্তান হবে ? কেন , কেন হতে পারে না ? মেয়েরা সহজেই সন্তান ধারন করে, তা ইচ্ছায় হউক বা অনিচ্ছায় ; আর পুরুষদের সেই সম্ভাবনা নেই বলেই কি তারা সব কিছু থেকে মুক্ত ?
তাই বলে তুমি সন্তান জন্ম দেবে ? কেন অকালে মেরে ফেলনি তাকে ?কেন একটা জারজ জন্ম দিলে ? এটা কি করে সম্ভব ! একটা জলজ্যান্ত প্রাণ ওর ভেতরে গড়ে উঠছে , তাকে ও হত্যা করে কি করে ? এই সন্তান কি শুধু সেই বন্ধুবেশি দুর্বৃত্তের ? ওর সন্তান নয় ? কি করে পারে একজন মা তার সন্তানকে হত্যা করতে ? এও কি সম্ভব ?
আত্মজিজ্ঞাসায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে যেন খানিকটা । কিন্তু না তাকে স্থির হতেই হবে। মুখোমুখি দাঁড়াবে সে আত্মজ পরিচয় নিয়ে, তাতে কেউ তাকে গ্রহণ বা বর্জন করুক কিছু যায় আসে না তার। আত্মাকে সে অস্বীকার করতে চায় না, করবে না ।
রাত অনেক বিছানায় উঠে বসে , ঠিক তখনি সাইড টেবিলে টেলিফোন বেজে ওঠে । হতচকিত হয়ে পড়ে নন্দিতা । এত রাতে কে টেলিফোন করলো ? কে আছে ওর ? নাকি আত্মীসব্জন কারো কোন বিপদ হল ! ফোনটা তুলে ধরে কানে
-হ্যালো ।
-জানি তুমি জেগে আছ, ঘুমাওনি, ঘুমাতে পারছনা ।
-জাহিদ ভাই , জী আমি জেগেই আছি। ঘুমাতে আর পারছি কই!
-সরি নন্দিতা, সবার আগে ভুলটা আমার । আমারই আসলে বলার স্টাইলটা ঠিক ছিল না। আসলে এবার অনেকদিন পরে এসেছি । আমি কিন্তু একাই এসেছি এখন। কিছু বৈষয়িক কাজ ছিল, সেগুলো নিয়ে খুব ব্যাস্ত। তোমার সাথে কথা বলেই দেশে চলে গিয়েছিলাম। আজ রাতের ট্রেনে এসেছি । একটানা কথাগুল বলে একটু দম নিলেন যেন জাহিদ স্যার মানে জাহিদ ভাই । দেশে ফিরে আসবার আগেই জাহিদ স্যার নিজেই সম্বোধনটি সংশোধন করে দিয়েছিলেন এবং নিজেকে ওর বড় ভাই’র জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
মুহূর্তে বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় নন্দিতা।ওঃ তাহলে অনন্য এখনো আসেনি আর ও ভেবেছিল আজকালের মধ্যেই যে কোন সময় সামনে এসে হাজির হবে ।
-ও আমি ভাবছিলাম আপনারা সবাই বুঝি এসেছেন। দু’একদিনের মধ্যে এখানে আসবেন। কেমন আছে সবাই ?
-সবাই খুব ভাল আছে । ওসব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই । তার পরেও
-তারপরেও কি ? কেন সে সামনে আসতে চায় ? আপনি কি সব বলে দিয়েছেন ?
-কই আমিত বলিনি কেউ এখনি তোমার সামনে যাবে। আমি কি তাই যেতে দিতে পারি ? তবে হ্যা , তোমার সাথে আমার কথা আছে ।
-বলুন জাহিদ ভাই, আমি শুনছি । কিন্তু আপনিত বাসায় আসতে চেয়েছিলেন।
-চেয়েছিলাম কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম , বাসায় কথা না বলাই ভাল। তোমার মেয়ে আছে ওখানে । আমিত জানি তুমি কেমন , এখান থেকেই বুঝতে পারছি কি অবস্থা তোমার ।
-তাহলে ?
-তাহলে আবার কি ? শোন ননী, পৃথিবী এখন অনেক বদলে গেছে । এই বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাথে নিজেকেও পাল্টাতে হবে। আর যদি না পাল্টাতে পার তাহলে মুখ থুবড়ে পড়বে। কেউ টেনে তুলবে না তোমায় ।
-কি বলতে চান জাহিদ ভাই? আমি যে কিছুই বুঝছি না ।
-বলছি , বলছি । আগে বল তোমার আসেপাশে কেউ নেইত !
-না কেউ নেই । আমি আমার ঘরে একা । এত রাতে আর কে জেগে থাকবে। অনন্যা , ওর রুমে ঘুমাচ্ছে ।
-খুব ভাল হল । এক কাজ কর ননী , তোমার যদি কিছু করার থাকে করে নাও । আমি একটু কল করবো কানাডায় । করেই দশ মিনিট পর ফোন করছি ।
-আচ্ছা ।
ফোন রেখে কিছুটা হতবিহবল হয়ে রইল নন্দীতা। ফোনের পুরো আলাপটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে । কি বলতে চায় জাহিদ ভাই , কিসের ইঙ্গিত দিল পৃথিবী পরিবর্তনের কথা বলে । নাহ আর যে সইতে পারে না ও। মাথাটা গরম হয়ে গেছে, প্রেশার বাড়ল কি’না কে জানে । এমনিতে নীরোগ দেহ ওর। ছুটে গেল বাথরুমে। খুব ভালকরে মুখহাত ধুয়ে ওজু সেরে নিল । ফ্রিজ খুলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেল । হাত মুখ না মুছেই বিছানার উপর ফ্যানের তলায় বসল । ফোনের মোবাইল কানেকশনটি বালিশের পাশে রাখল।
মনের পর্দায় সিনেমার সেলুলয়েড ফিতায় পুরানো দৃশ্যগুলো ভেসে উঠতে লাগলো। কি নিদারুন কষ্টের সেই দিনগুলো। হাযার কিলোমিটার দূরে, একা একটি অল্প বয়সী মেয়ে, তায় অবিবাহিত মা । দেশে এক্সিডেন্টে সদ্য বাবা ও ভাইর মৃত্যু । কি করবে মেয়েটি ? কি করতে পারত? যতই অনাকাঙ্ক্ষিত হউক সন্তান সেত সন্তানই । আত্মার অংশ, আত্মজ । তাকে কি অবলীলায় পরিত্যাগ করে চলে এল দেশে । অবশ্য উপযুক্ত এবং অধিক স্নেহশীল আশ্রয়ে রেখে এসেছিল । নিশ্চিত করেছিল তার একটি পরিচয় । কান্ডারি হয়ে দাড়িয়েছিল সদ্য বিধবা মা এবং ইউনিভারসিটির পড়ুয়া বোনটির পাশে । না আত্মীয়স্বজনের কমতি ছিল না মোটেই , কিন্তু কে কার দায় নেয় ? আজকাল নিজের সমস্যা নিয়ে সবাই ব্যাতিব্যাস্ত, বাড়তি ঝামেলা কে নেয় ? কেউ না । সবাইকে সুখি রাখতেই নন্দিতা সেদিন নিজের সাথে আপোষ করেনি ? কিন্তু সে কথা কে বুঝবে?
নিশ্চয়ই সে ভাবছে কেমন মা নন্দিতা ? নন্দিতা কি শুধুই মা হয়েছিল ? না, নন্দিতার ঘাড়ে তখন উপযুক্ত সন্তানের দায় এক বিরাট বোঝা হয়ে ছিল। আর তাই না ছুটে এল তড়িঘড়ি । নয়ত আরো পড়াশুনার অজুহাতে তাকে বুকে নিয়ে ওখানেই থেকে যেতে পারত নন্দিতা । কিন্তু তা সে করেনি । কেন করেনি ? নন্দিতা কি খুব স্বার্থপর ?
একবিন্দুও স্বার্থপর নয় ও, আর তা নয় বলেই ফিরে আসা । নাড়ী ছেড়া আত্মজ টুকরো একরত্তি ফুটফুটে শিশুকে হাযার হাযার কিলোমিটার দূরে ফেলে এসেছিল ।ইচ্ছে করলে অঙ্কুরেই যাকে শেষ করে দিতে পারত, কিন্তু না অমোঘ মায়ায় সেদিন তাকে বয়ে বেড়িয়েছে, জন্ম দিয়েছে । আর দেবে না কেন ? সেই নিস্পাপ শিশুর কি দোষ ? সেকি তার অবৈধ জন্মের জন্য দায়ী? মোটেই না ।
আর ভাবতে পারেনা নন্দিনী। আবারো টেলিফোন বেজে ওঠে । শুয়েই ছিল বিছানায়, হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় রিসিভার।
– হ্যা জাহিদ ভাই বলুন।
– শান্ত আছত ?
– হ্যা হ্যা বলুন। আমি শুয়েই আছি ।
– গুড, যা বলছি মন দিয়ে শোন । কেননা সত্য এখন দিনের আলো আলো দেখতে চাইছে । তোমাকেই সাহসের সাথে সেই আলো দেখাতে হবে ।
– জানি ভাবছ, কি এমন ঘটল যে আজ সত্য প্রকাশ জরুরী হয়ে পড়ল ।
– জী বলুন।
জাহিদ সাহেব খুলে বলেন সব । বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে অনন্য বুঝতে পারে সে বাঙালিজাত নয় , অথচ তার বাবামা দুজনেই বাঙালি । অনেক অনেক প্রশ্ন করেছে সে , কেন সে এমন ? কেন তার গায়ের রঙ টুকটুকে ফরসা, চোখ নীলা অথচ চুল ঘন কালো । জাহিদ সাহেব বুঝিয়েছেন, তার পূর্বপুরুষ ব্রিটিশ মেম সাহেব বিয়ে করেছিলেন তাই তার জিনে এই চরিত্র বিদ্যমান এবং তা অনন্যর মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে । ধীরে ধীরে অনন্য মেনে নিয়েছিল ব্যাপারটা । আর এদিকে জাহিদ সাহেবও টরেন্টো বদলি হয়ে চলে এসেছিলেন। ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছিলেন যেন । কিন্তু এখন অনন্য বড় হয়ে হয়ে গিয়েছে, লেখাপড়া শিখে মস্ত শিক্ষিত। সে তার পিতৃভূমিতে ফিরে আস্তে ইচ্ছুক, বাঙালি মনমানসিকতায় গড়ে উঠা অনন্য ঠিক করেছে বাংলাদেশে ফিরে বাঙালি কোন মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করবে, এখানেই থাকবে।
এই পর্যন্ত সবকিছু ভালই চলছিল । জাহিদ সাহেব বা মালা ভাবি সরল ভাবেই দেশে ফেরার প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন।এবং সেই অনুযায়ী সব গোছগাছ করতে শুরু করেন। কানাডায় ভালই অবস্থা উনার, বাড়ীটা রেখে সব বিক্রি বাটা শুরু করেছেন। উনারা জানতেন না , পৃথিবীতে এক শ্রেণীর মানুষ থাকে যারা নিজেদের কোনরকম লাভ অর্জন ছাড়াই অন্যের ক্ষতি করে আনন্দ পায়। হ্যা তেমন এক একজন পুরানো সহকর্মী এসেছিল টরেন্টো উনাদের বাসায়। তিনদিন ছিলেন ভদ্রলোক । সারা দিনমানে কাজে অকাজে অনেকবারই তার সাথে অনন্যর কথা হয়েছে । উনি চলে যাবার পর অনন্য খুব শান্ত হয়ে যায়, এমনিতে সে খুউব প্রাণ উচ্ছল ছেলে। আরও কদিন পর হটাত একরাতে যেন বজ্রপাত হল । এক টুকরো কাগজ, ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে দাঁড়ায় বাবামায়ের সামনে। হ্যা, জাহিদ সাহেব, মালা ভাবি আর নিজের টেস্ট করিয়েছে অনন্য। জেনে গেছে অনন্য, সে ওদের রক্ত সম্পর্কের কেউ নয়, শুধুই পালক পুত্র মাত্র।
একটু যেন থামলেন যেন জাহিদ ভাই, জাহিদ ভাই কাঁদছেন । এপাশ থেকে বুঝতে পারে নন্দিনী, অঝরে নিঃশব্দে কাঁদছেন বুক ভেঙ্গে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পিতা জাহিদ ভাই।
কি বলবে নন্দিতা, নন্দিতার গলা শুকিয়ে কাঠ । রিসিভারটি ধরেই থাকে।
কিছুক্ষন পর আবার বলতে থাকেন জাহিদ ভাই । মালাভাবির সাথে অনেক আলাপ আলোচনা করে ঠিক করলেন ওকে সত্য ঘটনা খুলেই বলবেন। কথামত উনারা অনন্যকে নিয়ে বসলেন । নন্দিতার ছবি ছিল এ্যালবামে , দেখিয়ে মায়ের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আশ্বস্ত করলেন, অনন্য এতিম নয়। পৃথিবীতে ওর আপনজন আজও বিদ্যমান । তার চোখে এক অসীম ক্ষুধা, হৃদয়ে হাহাকার যদি আর একবার দেখতে পান প্রাণের টুকরাকে। সেই থেকে এক্কেবারে শান্ত এবং প্রান উচ্ছল অনন্য । মাকে দেখতে চায়, আসতে চায় মায়ের কাছে । বাবাকে চরম ঘৃণা করে, তাকে সে স্বীকৃতি দেয় না মোটেই।
-ননী , শুনছ ।
-হ্যা জাহিদ ভাই । আমি আছি । গলাটা শুকিয়ে কাঠ , না তৃষ্ণা নয় । এ এক ভিন্ন অনুভূতি । একদিকে ভয় অন্যদিকে অপার আনন্দ । আপন জঠরের সন্তান তাকে চিনতে চায়, চায় কাছে আসতে। অন্যদিকে সমস্ত সংসার, মুখমুখি দাঁড়িয়ে সমাজ আর একান্ত আপনজনেরা । মা নেই , নেই কাছে নায়না কিন্তু একদম কাছে, হৃদয়ের দুয়ার আগলে বসে আছে অনন্যা । কে বলবে ও অনন্যাকে ? আর অনন্যই বা কিভাবে নেবে ব্যাপারটা ? অনন্য কানাডায় মানুষ , আর তাই বুঝি মায়ের এই ত্যাগ আর বিচ্ছেদ ওর কাছে অনেক সহজ কিন্তু আদ্যপান্ত বাঙালি অনন্য ? না আর যেন পারে না নিজেকে ধরে রাখতে।
– আমি এখন কি করবো জাহিদ ভাই।
-কি করবে তা তোমাকেই ঠিক করতে হবে । তবে আমি বলব চেস্টা কর যথাসম্ভব সহনীয় পরিবেশে তোমার মেয়েকে সব জানাতে।
না আর কথা বাড়ায় না নন্দিতা । ফোন রেখে পানি খায় দুগ্লাস । লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ে । এ শুধু শুয়ে থাকা , ঘুম সে হারিয়ে গেছে অতলান্ত চিন্তার মহাসমুদ্রে।
খুব ভোরে বিছানা ছেড়ে উঠে পরে। নামাজ পরে,কোরআন তেলয়াত করে,খুব করে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে। একমাত্র তিনি পারেন ওকে সবকিছু থেকে বাচাতে বা সুন্দর একটা সমাধান করে দিতে।
না আর বসে থাকা নয়। রান্নাঘরে যায়, অনন্যার পছন্দের নাস্তা বানায় । গোসল সেরে সদ্য প্রভাতের খবরের কাগজ নিয়ে বসে । ঘড়িতে মাত্র সাতটা , এখনো ঘন্টা খানেক বাকি ও দরোজা খুলে বাইরে আসবে । সকালেই উঠে মেয়েটা কিন্তু কি অভ্যাস , একেবারে গোসল সেরে তৈরি হয়ে তবেই দরোজা খুলবে।
প্রতিদিনের মত একেবারে যেন ঘড়ির কাটা ধরে দরোজা খুলে বেড়িয়ে আসে অনন্যা , নন্দিতার মেয়ে অনন্যর বোন । অনন্যর বোন , অনন্যা কি ওকে ভাই বলে মেনে নেবে ?
যথাসম্ভব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে , মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করে,
–কিরে রাতে কেমন ঘুম হল ?
–ভালই , কেন আম্মু ?
–না এমনি । আজ কোথাও বের হবি নাকি ?
–হু ভাবছি, একবার একটু লাইব্রেরীতে যাব সেখান থেকে একটু শপিং এ।
–কখন যাবি?
–কেন ? কিছু দরকার আছে নাকি ?
–হ্যারে, তোর সেই জাহিদ মামার কথা মনে আছে। ঐযে কানাডায় পড়ার সময় আমার জন্য অনেক করেছিলেন । আব্বা আর ভাইয়া মারা যাওয়ার পর তাকেই ভাই ডেকেছিলাম।
–হ্যা আম্মু , খুব মনে আছে । এত বলতে হবে না । কেন কি হয়েছে তার ?
— না কিছু হয়নি, উনি আজ একটু পরে আসবেন । তোর সাথে নাকি কি কথা আছে ।
–আসুক না। আমি যদি বের হই, তাও সে ওবেলা ।
–তাহলেত খুবই ভাল হয়।
জাহিদ ভাইকে নিয়ে আলোচনা বাড়ায় না ।অনন্যার পছন্দের নাস্তা বানিয়েছে আজ। মেয়েটা খুব দেশি মুরগির কষানো গোস্ত আর খাস্তা পরোটা খেতে ভালোবাসে ।সকাল সকাল গোস্ত রান্না করেছে । আটার খামি করে রেখেছে , মেয়েটা বের হলেই ভেজে দেবে। মেয়েকে বস্তে বলে পরোটা ভেঁজে নিয়ে এল । মা মেয়ে দুজনে এ কথায় সে কথায় নাস্তা সেরে ফেলল। এর মধ্যে কাজের ঠিকা বুয়া হাজির।
পারলনা না নন্দিতা, পারলনা নিজের কথা নিজের মেয়ের কাছে খুলে বলতে। অনন্যা খাওয়া শেষে ড্রয়িং রুমে যেয়ে ভোরের খবরের কাগজ নিয়ে বসল । নন্দিতা নিজের ঘরে ধুকে দরোজা বন্ধ করে জাহিদ সাহেবকে ফোন করলো । ওপাশে জাহিদ ভাই।
–হ্যালো , হ্যালো কে?
–হ্যালো জাহিদ ভাই !
–কি হয়েছে ? কি হয়েছে নন্দিতা ? তুমি ঠিক আছত ?
–আমি ঠিক আছি , ভাল আছি । কিন্তু পারলাম না। কিছুতেই পারছিনা । আপনি আসুন।
–ঠিক আছে। আমি আসছি ।
বেলা দশটা নাগাদ জাহিদ ভাই চলে এলেন । অনন্যার মুখমুখি বসে অনেক কথাই আলাপ করছেন । আলাপের মুল বিষয় কেরিয়ার নিয়ে কি ভাবছে অনন্যা, কি করতে চাও ভবিষ্যতে । হায়ার এডুকেশনের জন্য বাইরে যাবে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি।আর নন্দিতা , একাজ সেকাজের অজুহাতে একবার কিচেন, একবার ডাইনিং হল , শোবার ঘর হেটে বেড়াচ্ছে । আসলে কান তার এখানে । বুঝতে চাচ্ছে, জাহিদ ভাই কি বলেন এবং অনন্যার প্রতিক্রিয়া কেমন হয়। আর যে সইতে পারছে না , মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।
জাহিদ সাহেব খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নন্দিতাকে ডাকলেন , বললেন
–বস, তোমাদের মা মেয়েকে একটা ঘটনা বলব। ঘটনাটি খুব মন দিয়ে শুনবে এবং পরে আমাকে আলাদা করে তোমাদের মতামত বলবে।নন্দিতা বুঝতে পারে জাহিদ ভাই আসল কথায় ফিরে এসেছেন।
জাহিদ সাহেব তার স্বভাব অনুযায়ী গাম্ভীর্য পরম নিপুণতায় নন্দিতা উপাখ্যান সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে কানাডায় ঘটেছে বলে বর্ণনা করলেন। এবং এখন উদ্ভুত পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করে জান্তে চাইলেন , ঐ মহিলা এখন কি করা উচিত ? মেয়েকে সব বলে দেবে না’কি গোপন করে যাবে ।
অনন্যা খুব বুদ্ধিমতী তা জানাই ছিল, কিন্তু এতটা প্রগতিবাদী ভাবেনি জাহিদ সাহেব। অনন্যার মতে সমাজ, সংসার, ঘটনাবলী এবং পরিস্থিতির শিকার উল্লেখিত মহিলা কোন অপরাধ করেনি। তা ছাড়া এমনও হতে পারত মহিলার আগেও একটা বিয়ে হয়ে থাকতে পারত স্বাভাবিক নিয়মে সে ঘরেও একটা সন্তান থাকতেও পারত। সবচেয়ে বড় কথা নির্দোষ মহিলা কেন শাস্তি পাবে ?
জাহিদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,
–তাহলে তুমি বলছ, মহিলার এখনকার মানে বিবাহিত জীবনের যে সন্তান , সেই সন্তানের উচিৎ মায়ের জীবনের এই ঘটিনাকে সহজভাবে মেনে নেয়া !
–অবশ্যই । সেটাই স্বাভাবিক এবং উচিৎ ।
–আর ইউ শিওর ? তুমি বলছ ?
–ইয়েস মামা, হান্ড্রেড পারসেন্ট।
কি জানি কি মনে করলেন । পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা ছবি বের করলেন । বললেন,
–দেখ এই সেই ছেলেটার ছবি ।ছবিটা হাতে নিয়ে দেখল অনন্যা ।
–বাহ কি সুন্দর ছেলেটা, খুব মায়াভরা চেহারা ।
ইশারায় নন্দিতাকে কি বললেন কে জানে ।পাষাণ প্রতিমা নন্দিতা নিথর হয়ে গেছে যেন।সামান্য নড়েচড়ে বসল যেন। এগিয়ে এসে বললেন
–কি হল খালি পেটে আর কতক্ষন বসিয়ে রাখবে , দুপুরের খাবার কি বিকালে খাওয়াবে ?
জাহিদ ভাইর আন্তরিকতায়, খাবার টেবিলে কিছুক্ষন আগে আলাপের বিষয়বস্তুর লেশমাত্র ছায়াও পরলো না। খাবার কেমন হয়েছে, কে কি খেতে পছন্দ , কোথায় কি খাবার সুস্বাদ । খাওয়া শেষে জাহিদ সাহেব লিভিং স্পেসে এসে বসলেন , পিছনে পিছনে অনন্যা । নন্দিতা গেল কিচেনে একটু কড়া করে চায়ের জোগাড় করতে।
চায়ের টেবিলে আবার একপ্রস্ত আলোচনায় এল নারীর অসহায়ত্ব এবং অধিকার । এল নারী পুরুষের সতীত্ব নিয়ে মতামত। কেন শুধু নারীকেই সতীত্বের মুল্য বইতে হবে? কেন পুরুষকে নয় ? একই সুরে নিজের মতকে প্রাধান্য দিয়ে নারীর পক্ষ্যে মত দেয় অনন্যা । জাহিদ সাহেব চেষ্টা করেন, ওকে ভাল করে ঝালিয়ে নিতে। চোখে চখে নন্দিতার সাথেকথা বলেন। যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে গ্যাঁট হয়ে বসেন, নন্দিতাকেও সামনে বস্তে বলেন। অনন্যাকে বলেন,
–আচ্ছা মনে কর এমন একটা ঘটনা যদি তোমার পরিবারের মধ্যে হয় , তোমারই কোন আপনজনের জীবনে হয় । তখনো কি তুমি পারবে, এমন করেই সাপোর্ট করতে।
মুহূর্ত মাত্র দ্বিধা না করে বলে উঠে অনন্যা,
–বিন্দু মাত্র দ্বিধা করবোনা আমি তার পাশে দাড়াতে ।
কিছুটা মুহূর্ত একদম চুপ করে থাকেন জাহিদ সাহেব। হয়ত ভাবেন এর পরে কি করণীয় । উঠে দাড়ান এবং হাত ধরে ওঠান নন্দিতাকে। যন্ত্রচালিত মেশিনের মত উঠে আসে নন্দিতা, যেন একটা প্রাণহীন রোবট ও। এগিয়ে আসেন অনন্যার দিকে বলেন,
–একটু দাড়াও মামনি । অনন্যার ডান হা্ত্টা টেনে নন্দিতার হাতটি ওর হাতে দিয়ে বলেন,
–মা এই হতভাগী আর কেউ নয়, তোমার মা । বড় দুখী , এবং এক নিরবচ্ছিন্ন জীবন সংগ্রামী । তবে মনে রেখ সে তোমার বাবাকে ঠকায়নি এতটুকু , প্রিথিবীতে আর কেউ না জানলেও তোমার বাবাকে ও সব জানিয়েছিল বিয়ের আগেই ।তিনি সব জেনেই ওকে গ্রহন করেছিল , এমনকি এক সময় অনন্যকেও গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অনন্য শুধু আমাদের ছেলে।
মানুষের জীবনে কিছু মুহূর্ত আসে যার ব্যাখ্যা দিতে সকল ভাষা অপারগ । নাহ এই মুহূর্তে মা আর মেয়ের অবস্থা বর্ণনা করতে অপারগ দুনিয়ার সকল ভাষা। হতবিহবল অনন্যা বাকরুদ্ধ , আর অনন্যা ? আত্মজার সামনে কুণ্ঠিত লজ্জিত নত মস্তকে পুতুলের মত দাঁড়িয়ে , তার দুচোখে শুধু নিঃশব্দ অবিরল নোনা অশ্রুধারা। মায়ের হাত ছেড়ে ধপাস করে বসে পরে অনন্যা । নন্দিতা মাথা নিচু করে ফিরে যায় নিজের ঘরে। জাহিদ সাহেব আরও কিছুতা সময় বসে থাকেন চুপচাপ । সন্ধ্যা তখন জেঁকে বসতে শুরু করেছে , উঠএ পরেন জাহিদ সাহেব।অনন্যার মাথায় হাত রাখেন
–জানি মা , অনেক কিছুই অন্যের জীবনে ঘটলে আমরা সহজেই রায় দিতে পারি কিন্তু নিজের জীবনে হলে…না আর বলা হয় না।
–আমি যাই মামনি। এখন সময় তোমাদের , তোমাদের মা বেটির।
আর কথা না বাড়িয়ে বেড়িয়ে যান জাহিদ সাহেব । পিছনে পরে রইল এক যুদ্ধক্লান্ত নিয়তি পীড়িত অসহায় মা , মায়ের স্নেহের চুড়ান্ত পরীক্ষার উৎকণ্ঠা আর একমাত্র আদরের কন্যার সত্যমিথ্যার গোলোক ধাধায় ঘূর্ণিপাকে আবদ্ধ মমতার বিচার ।
১৪টি মন্তব্য
অরুনি মায়া
দুটো পর্বই পড়লাম আপু | ভাল লেগেছে অনেক | আসলেই সন্তান জন্মদানের প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল | আর এই জটিলতার দায়টাও শুধুই মায়েদের |
সন্তান যখন অনাকাঙ্ক্ষিত হয় তখন মেয়েদের আর কষ্টের সীমা থাকেনা | জানিনা নন্দিতার ভাগ্যে কি আছে | অপেক্ষায় রইলাম |
পারভীন সুলতানা
যত তাড়াতাড়ি পারি তৃতীয় পর্ব পোষ্ট করবো । আমি চেষ্টা করি একটু হলেও সমাজের কথা বলতে,
অরুনি মায়া
জি আপু তা আমি দেখেছি, আপনি প্রতিনিয়ত নারী জাতির বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা গুলোকে লেখার মাধ্যমে তুলে ধরছেন | কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে | শুভ কামনা রইল আপু -{@
জিসান শা ইকরাম
সতীত্ব শব্দটিই সৃষ্টি করা হয়েছে নারীদের জন্যই
পুরুষদের একপেশে মনোভাবের কারনেই নারীকেই সতীত্বের মুল্য বইতে হয়
আর কত শত বছর এই অবস্থা চলমান থাকে জানা নেই আমাদের।
ভালো লিখেছেন।
অপেক্ষা পরের পর্বের।
পারভীন সুলতানা
আপ্নারা এগিয়ে এলে আমরা সমান্তালে পাশে দাড়াতে পারব।
অনিকেত নন্দিনী
সমাজের কাছে, শক্তির কাছে হেরে যাওয়া মাতৃত্ব জীবনের এই মোড় কেমন করে মোকাবেলা করে তা দেখার অপেক্ষা।
বি.দ্র”এপাশ থেকে বুঝতে পারে নন্দিনী, অঝরে নিঃশব্দে কাঁদছেন বুক ভেঙ্গে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পিতা জাহিদ ভাই। কি বলবে নন্দিতা, নন্দিতার গলা শুকিয়ে কাঠ ।” একবার নন্দিনী আরেকবার নন্দিতা হয়ে যাচ্ছে আপু।
পারভীন সুলতানা
নন্দিনী আমার ভীষণ প্রিয় নাম। আব্বা আদর করে বলতেন আমায় “আমার নন্দিনী” আর তাই বুঝি এই ভুল । অনেক ধন্যবাদ ঠিক করে নেব সামনে।
ছাইরাছ হেলাল
হ্যা, বরাবরের মতই আপনি আমাদের চারিপাশের অসংগতি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
দেখি শেষটায় কী ভাবে সামাল দেন।
পারভীন সুলতানা
এটুকু ভরসা দিতে পারি, হতাশ হবেন না, খুশি হবেন উপরন্তু।
হতভাগ্য কবি
কেন বারবার এমন মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনে হানা দেয় কে জানে, রঙ বদলানো অনুভূতিগুলোকে ভয় পাই,
লেখায় মুগ্ধতা, অপেক্ষা করছি পরের টুকুর
পারভীন সুলতানা
এমন করে বললে লজ্জা পাই । খুব তাড়াতাড়ি আসবো শেষটা নিয়ে
হতভাগ্য কবি
অপেক্ষা চলছে চলবে 🙂
রিমি রুম্মান
আগের পর্বের লিঙ্ক থাকলে বেশ হতো। ভালোলাগা রইলো এ পর্বে।
শুভকামনা।
পারভীন সুলতানা
ীক্টু আমার ব্লগে দেখুন, পেয়ে যাবেন