দিনদিন গ্রাম থেকে মানুষ আসছে শহরে, ভীড় বাড়ছে রাস্তাঘাটে, লাইন লম্বা হচ্ছে ব্যাংকে বাস কাউন্টারে লঞ্চ-স্টিমারে রেলস্টেশনে । লোকে লোকারণ্য হচ্ছে হাটবাজার সহ বড়বড় মার্কেটের শপিংমগুলো, বাড়ছে যানবাহনের গাড়ি, বাড়ছে চুরি-ডাকাতি ছিনতাই আহাজারি, বাড়ছে রোগবালাই, বাড়ছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম । তবু কি থেমে আছে আমাদের জীবন চলা? মোটেও না, বরঞ্চ আগের চেয়ে বর্তমানে আমরা খেয়েদেয়ে ভালোভাবেই আছি । এই ভালো থাকার মাঝে সেই আগের দিনগুলোর কথাও মনে পড়ে সময় সময়, যখন সস্তার আমলে টাকার মুল্য অনেক বেশি ছিলো । তখন মানুষের মনে ভয় ছিল, মানুষ সৎভাবে আয়-রোজদার করতো, হাটবাজারে সব খাঁটি জিনিষ বিক্রি হতো । এখন সবই ভেজাল, সবাই স্বার্থপর ।

যখন ছিলো টাকার অভাব ।

সময়টা ১৯৮৬ সালের, সবে মাত্র ইয়ে করে বিয়ে করেছি । চাকরি করি টেক্সটাইল মিলে, বেতন ১৭০০শ টাকা মাত্র । তখন চাউলের মূল্য ৫ টাকা থেকে সাড়ে ৫ টাকা । ঘরে নতুন বধু আমার, বিয়ে করেছি গ্রামের মেয়ে । গ্রামের মেয়ে শহরে আসলে তো কত-না-বাহানা তার, এটা চাই, ওটা চাই, শুধু চাই আর চাই, চাওয়ার যেন শেষ নাই । কিন্তু এই চাওয়া পূরণের জন্য তো চাই টাকা, টাকা পাই কোথায়? বেতন মাত্র ১৭০০শ’ টাকা, তা দিয়ে কি সংসার চলে? যে চালায় সে বুঝে, তবু চাই চাই, দিতে হবে, করতে হবে, আনতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি । সেসময়টা পার হয়েছে, দেশে কর্মসংস্থান বেড়েছে, আয়-রোজগারও ভালো হচ্ছে, দেশ থেকে মঙ্গা মনে হয় চিরতরে বিদায় নিয়েছে । তবু আগেকার দিনগুলির কথাই শুধু মনে পড়ে, যখন অভাব ছিল।  তখন মানুষ একে অপরকে ঠকানোর চিন্তা করতো না, মানুষ সৎ ছিল ।

আগেকার সময়ে মানুষ ছিল অভাবে, মন ছিল সৎ।

স্বাধীনতা পরবর্তি সময়ে আমি নিজেও দেখেছি কাপড়ের অভাবে মানুষকে মানুষকে দোপাট্টা লেংটি পড়ে থাকতে, আমি নিজেও ছোটবেলায় কোনো একসময় লেংটি পড়েছি । স্কুলে বা কোনো জায়গায় আসাযাওয়ার জন্য মায়ের হাতে সেলাই করা শার্ট-পেন্ট পড়ে যেতাম, স্কুল থেকে এসে সেই শার্ট-পেন্ট খুলে সারাদিন লেংটি পড়েই থাকতাম । আমার মাকে দেখতাম, কাপড় কাটার কেচির অভাবে ঘরের মাছ-তরকারি কুটার বোটিদাও দিয়ে শার্ট-পেন্টের কাপড় কাটিং করতে । সেসময়ে একটা কাপড় কাটার কেচি খুব কম মানুষের বাড়িতেই ছিল, যাদের টাকা-পয়সা ছিল তাদের বাড়ি ছাড়া আর কারোর বাড়িতে কেচি পাওয়া যেত না । শুধু কেচি-ই-নয়, দশ গ্রামে খুঁজেও একটা রেডিও টেলিভিশন পাওয়া বড়ই মুশকিল ছিল, এইতো সেইদিনের কথা, পুরো গোদনাইল এলাকায় একটা টেলিভিশন ছিল চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিকদের ক্লাবে ।

সেই টেলিভিশন দেখতে শীতলক্ষ্ম্যা নদীর ওপার থেকে আসতাম কত কষ্ট করে, দেখতে এসে সময়সময় মারও খেতাম সেখানকার বড়দের হাতে । আর এখন, রাস্তার পাশে পিঠা-পুলির দোকানেও কালার টেলিভিশন দেখা যায়, টেলিভিশন পাওয়া যায় শহরের ডাস্টবিনেও । সবই যুগের পরিবর্তন, পরিবর্তন ঘটেছে টেলিগ্রাফ টেলিফোনেও, এখন আর পোস্ট মাস্টারের কাছে যেতে হয় না আমাদের, হাতের মুঠোয় থাকে অত্যাধুনিক মোবাইল ফোন, তার ভিতরে থাকে পৃথিবীর সব তথ্য, ঘরে বসেই পৃথিবীর যেকোনো জায়গায় মুহূর্তে যোগাযোগ করা সম্ভব । রড-সিমেন্টের শহরে মাটি না থাকলেও খাদ্যের অভাব নাই, নাই তরিতরকারির অভাব, কৃষকের জমির পরিমাণ কমে গেলেও বাজারে চাউলের অভাব নাই, বস্ত্র শিল্পের বিলুপ্তি ঘতলেও বস্ত্রের অভাব নাই, সবই পাওয়া যায় শুধু টাকা থাকলেই হলো । তবু সেই আগের দিনগুলির কথা মনে পড়ে, যখন শত কষ্টের মাঝেও মানুষ অমানুষ হতো না, থাকতো সৎ ।

বর্তমান সময়ে কোনো অভাব নাই, তবু কেন স্বার্থপর?

এখন আর টাকার অভাব নেই, ধনী-গরীব সবার কাছে টাকা আছে । আজকাল একটা ভিক্ষুকেও দৈনিক চার পাঁচ‘শ’ টাকা কামাই করে, গরীবের চাউলের কেজি ৫০টাকা, তবু কি কেউ না খেয়ে মরে? আগে যার দু-চারটা মেয়ে থাকতো সে নাকি পোড়া কপাইল্লা, এখন যার মেয়ে বেশি সে রাজ কপাইল্লা । গার্মেন্টস্‌ বা পোষাক তৈরি কারখানায় একটা মেয়ের বাতন প্রায় ১০/১২ হাজার টাকা, গ্রাম থেকে কোনরকম শহরে আসতে পারলেই হলো, পোড়া কপাইল্লার আর টাকার অভাব নেই । জিনিসপত্রের দাম যতই হোক না কেন কোনো সমস্যা নেই, শহরের বাড়িতে বাসা ভাড়া করে দিব্বি আরাম আয়েশে তারা থাকছে খাচ্ছে । ওইসব গ্রামছুট শহরমুখি মানুষের ভীড়ে আমাদের মত মানুষের চলা বড় কষ্ট, তবু চলছি, থাকছি, খাচ্ছি । কী খাচ্ছি? আগে যেসব শাকসবজি কেটে গরু-ছাগলকে খাওয়ানো হতো, সেসব এখন আমরা বাজার থেকে কিনে খাচ্ছি । বাজারে পাওয়া যায় টাকাপাতা, সেচিরশাক, কচুশাক, বাগানের পেঁচড়া আলু, ঢেকিশাক, পাদরাপাতা, কলারথোড়,  গীমাশাক, মিষ্টিকুমড়ার ফুল, বকফুল, ফুল-তুলসী সহ সবই এখন বাজার থেকে কিনে নিতে হয়, খেতে হয় ।

শহরের বাড়িতে কেউ যদি শখ করে গরু-ছাগল পালন করে, সেই গরু-ছাগলের খাবারের জন্যও ঘাসের অভাব হয় না, ঘাসও বাজারে বিক্রি হয়, কিনে নেয় যাদের বাড়িতে গরু-ছাগল আছে তাঁরা । এসবের সাথে সাথে এখন পরগাছাও বাজারে বিক্রি হয়, পরগাছা বলতে আমরা জানি স্বর্নলতাকেই বুঝায়, পূরাণো আমগাছে একপ্রকার পরগাছা জন্মে, তা দেখতে হুবহু মিষ্টি আলুর মত, ওইগুলিও এখন বাজারে বিক্রি হয়, মানুষেও কিনে নেয় । অনেক সময় শোনা যায়, আগেকার মত দেশীয় মাছ এখন পাওয়া যায় না, কেউ বলে ওসব মাছ এখন চোখেই পড়ে না । আসলে কিন্তু তা নয়! টাকা হলে দেশী বিদেশী সবই পাওয়া যায়, টাকা দিয়ে কিনে খাওয়া যায় । তবে এরমধ্যে আছে আসল-নকলের ছড়াছড়ি, তার ওপর আইনও আছে কড়াকড়ি, তবু দেখা যায় ফরমালিনের ছড়াছড়ি । মানুষের খাদ্যে বিষ মেশানো মরণাস্ত্র ফরমালিন যুক্ত খাবারও আমাদের খেতে হয় বাধ্য হয়ে, না খেয়ে উপায় নাই, তাই আমরা খাই । তবু মনে পরে যায় সেই ১৯৭৪ সালের অভাবের কথা, শত অভাব আর অনটনের মাঝেও মানুষ সৎ পথে থাকার চেষ্টা করতো । স্বার্থের কোমড়ে রশি বেধে টানাটানি করতো না, একচুলুম তামাক ফুঁকে নিজের সম্পত্তি অপরকে লিখে দিতেও দ্বিধা করতো না।

আমারা সবই খাই। শুধু সততা নাই ।

আমরা শুধু ভাত, মাছ, মাংস, ফলফলারি, শাকসবজিই খাই না, আরও অনেক কিছুই খেয়ে থাকি । গত বছর একটা পত্রিকায় দেখলাম, ভারতের এক নারী নিয়মিত বালু খেয়ে বেঁচে আছে । বর্তমানে তাঁর খাদ্য বলতে বালু, অন্য কোনো খাদ্য নয় । মহিলার নাম সুধামা দেবী, ভারতের কাজরি নুরপুর এলাকায় ৯২ বয়সের এই https://thedhakatimes.com/61632/story-of-a-woman-eating-sand/>সুধামা দেবী । আরও খায় গাছের পাতা, শুধু পাতা খেয়েই জীবন চলে, এটাও ভারতের এক পরিবারের কাহিনী । আমরাও গাছের লতাপাতা খাই, তবে কাঁচা না, সেদ্ধ করে বা তরকারি রান্না করে খাই । খাই বনবাদাড়ের পোকামাকড়ও, ক্ষুধা নিবারণের জন্য মানুষ যখন হায়না হয়ে ওঠে, তখন হাতের কাছে যা পায় তাই গিলে পেলে নির্দিধায় ।

কয়েক বছর আগে কুমিল্লার এক লোক মালয়েশিয়া যাওয়ার পথে থাইল্যান্ডের সীমান্তে আটকা পড়ে যায়, ওই লোক দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডের জঙ্গলে আটকে থাকার ফলে ক্ষুধা নিবারণের জন্য বনের পোকামাকড়কে খাদ্য হিসেবে বেঁচে নিয়ে জীবনধারণ করে । এমনই অদ্ভুত কাহিনীর গল্প আমাদের মানুষকুলে বহু আছে । শুধু এগুলো কেন, আমরা মানুষেরা সাপ খাই ,জোঁক খাই, ব্যাঙ খাই, টাকা খাই, পয়সা খাই, ঘুস খাই, সুদ খাই, মার খাই, লাথি খাই, থাপ্পর খাই, চাকরি খাই, ব্যবসা খাই চালান খাই, শহর খাই, গ্রাম খাই, দেশ খাই, নিজের চরিত্রটাকেও ধুয়ে-মুছে খাই,  কী না খাই? সবই খাই । তবু নাই-নাই, খাই নাই, পাই নাই, দেয় নাই, করে নাই, শুধু নাই-নাই এর মধ্যেই আছি আমরা সকলে । এখন আমাদের উদর বড় হয়ে গেছে, অল্পসল্পতে আমাদের মন ভরেনা, শুধু চাইচাই আরও চাই । আগেকার সময় মানুষের এতকিছুর দরকার হতো না, সৎ পথে থেকে অল্পসল্প দিয়েই চলতে পছন্দ করতো, নিজেকে বিক্রি করে বেশির আশা করতো না ।

যা চাই সবই আছে হাটবাজারে, নাই শুধু সততা।

হাটবাজারে বিক্রি হয় হাঁস-মুরগী, গরু-ছাগল, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী, প্রেমপ্রীতি ভালোবাসা, মানুষও কেনাবেচা হয় সময়সময় । অনেক সময় নিজের ভালোবাসাকেও আমরা বিক্রি করে দেই স্বার্থের টানে । নিজের নীতিটাকেও বিক্রি করে দিতে আমরা দ্বিধাবোধ করিনা, হেরে যাই অর্থের কাছে । সমাজের কিছু মানুষ স্বার্থের টানে অর্থের কাছে হেরে গিয়ে গোটা দেশ ও দেশের সমাজটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে । যারা অর্থের কাছে হার মেনে নিজেকে বিজয়ী মনে করছে, তারাই আবার কোনএক সময় পরাজয় বরণ করে শূন্য হাতে বিধায় নিচ্ছে । সবকিছু ফেলে রেখে চলে যায়, না ফেরার দেশে। যাওয়ার আগে সময় থাকতে নিজের ভুলটাকে কেউ সংশোধন করতে চায়না নিজের স্বার্থের টানে । বেঁচে থাকতে আমরা নিজেরাই হাটবাজারের পণ্য হয়ে যাই, বিক্রি হয়ে যাই সচরাচর । আগেকার সময় মানুষ নিজেকে বিক্রি করে দিতো না, বজায় রাখতো সততা, থাকতো সৎ । এখন অসৎ মানুষের সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে সৎ মানুষদের দেখা মেলেনা, সৎ মানুষেরা আড়াল প্রিয়তাকে ভালোবেসে গা-ঢাকা দিয়েই থাকতে পছন্দ করে। কিন্তু সমাজ তাদের মনে রাখে, কাছে ডাকে। 

 

 

 

৩৭৮৮জন ৩৭৮১জন
0 Shares

৪৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ