একজন জাতীয় বেঈমান আবদুল আলীম

১৯৭১ এ আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সমস্ত বাঙ্গালী একাত্ম হয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন। এমনকি অনেক বিদেশী বন্ধুও এই মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কাজ করেছেন। একই সময় কিছু স্বাধীনতা বিরোধী এই মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে। তারাই মুলত পাক সেনাদের পথ প্রদর্শক ছিলো। এরা রাজাকার, আলবদর, আলসামস বাহিনীর নামে হত্যা সন্ত্রাস ধর্ষনে লিপ্ত হয় এবং পাক সেনাদের সহায়তাকারী হিসেবে কাজ করে দেশের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়।

এদেরই একজন নেতা হচ্ছে রাজাকার আবদুল আলীম। পরবর্তিতে জিয়াউর রহমানের সময়ে সে মন্ত্রী হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তার অপরাধ প্রমানে আদালত তার বয়স বিবেচনায় জাবজ্জীবন কারাদন্ড প্রদান করেন। গত ৩০ আগষ্ট শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। তীব্র ঘৃণা এই জাতীয় বেইমানের প্রতি।

উল্লেখ্য, গত ১৮ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। রায়ে বলা হয়, একাত্তরে হত্যা, গণহত্যা ও লুটপাটের মতো ঘৃণিত অপরাধের ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই যুদ্ধাপরাধীর উপযুক্ত সাজা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য। কিন্তু বয়স, শারীরিক অবস্থা ও পঙ্গুত্ব বিবেচনা করে ৮৩ বছরের আলীমের সাজা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আমৃত্যু (স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত) কারাদণ্ড দেওয়া হলো। বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-২ এ রায় ঘোষণা করেন।

জয়পুরহাটের সাবেক মুসলিম লীগ নেতা আলীমের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগের মধ্যে ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে কড়ই-কাঁদিপুর-চকপাড়া ও সোনাপাড়ায় গণহত্যা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যা, খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজের নিচে ১০ জনকে হত্যা, জয়পুরহাট কলেজে নিয়ে ২৬ যুবককে হত্যা এবং আক্কেলপুরে ফজলুল করিমসহ তিনজনকে হত্যার (অভিযোগ ২, ৮, ১০ ও ১২) অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। ৬, ৭, ৯ ও ১২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর করে এবং ১ নম্বর অভিযোগে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ৪ ও ৫ নম্বর অভিযোগে সাক্ষী হাজির করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ। রায়ের পর কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি রাষ্ট্রপক্ষ। তবে রায় পর্যালোচনা করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

পাঠক আসুন জানি ১৯৭১ এ এই নরপশু কত নৃসংস অপরাধ করেছিলো:
১ / মেহের উদ্দিনের বাড়িতে লুটপাট-আগুনঃ একাত্তরের ২০ এপ্রিল বিকেল ৫টার দিকে আলীমের নেতৃত্বে পাঁচবিবি থানার দমদমা গ্রামের মেহেরউদ্দিন চৌধুরীর বাড়িতে হামলা চালায় রাজাকার বাহিনী। এরপর বাড়ির সব মালামাল লুট করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। ওই ঘটনার পর মেহেরউদ্দিন তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন।
২ / হিন্দু স¤প্রদায়ের ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যাঃ ১৯৭১ সালের ২৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলীমের নেতৃত্বাধীন রাজাকার বাহিনীসহ পাকিস্তানী সেনারা জয়পুরহাটের কড়ইকাদিপুর এলাকার কড়ই, কাদিপুর প্রকাশ কাদিপাড়া, চকপাড়া, সোনার পাড়া, পালপাড়া ও যুগীপাড়া হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামে হামলা চালায়। এরপর সেখানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের পর অনেককে আটক করে তারা। পরে কাদিপুর আখের চুল্লির কাছে ৭০ জন, কাদিপুর ডোমপুকুরে ৯০ জন, চকপাড়ার কুড়ালপুরে ২৬ জন ও চকপাড়া কুড়ালপুরের কাছে রাস্তার উত্তর পাশে ৫ জনকে সহ মোট ৩৭০ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয় ।
৩ / পাহনন্দা গণহত্যাঃ একাত্তরের আষাঢ় মাসের প্রথম সপ্তাহে আলীমের পরামর্শ ও প্ররোচনায় এবং চিরোলা গ্রামের শান্তি কমিটির সদস্য রিয়াজ মৃধার সহাযোগিতায় ১১ জন পাকিস্তানি সেনা নওপাড়া, চরবরকত ও চিলোরা গ্রামের আনুমানিক ৫০০ জনকে আটক করে। এরপর আলীমের দেওয়া তালিকা দেখে আওয়ামী লীগ, মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের আত্মীয় ২৮ জনকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ওই ২৮ জনকে পিছমোড়া করে বেঁধে আফাজের বাড়ির মাটির ঘরে নিয়ে গুলি করা হয়। তাদের মধ্যে ২২ জনকে নিহত হলেও ৬ জন প্রাণে বেঁচে যান।
৪ / পাঁচবিবিতে ১৯ জনকে হত্যাঃ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একদিন আব্দুল আলীম একটি ট্রেনে করে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে পাঁচবিবি বকুলতলা রেললাইনের কাছে নামে। এরপর বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে কোকতারা, ঘোড়াপা, বাগজানা ও কুটাহারা গ্রামে হানা দিয়ে বাড়িঘরে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। সেখান থেকে ১৯ জনকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যাও করা হয়।
৫ / মিশন স্কুলে ৬৭ জন হিন্দুকে হত্যাঃ একাত্তরের বৈশাখ মাসের শেষ দিকে জয়পুরহাটের দক্ষিণ পাহুনন্দা মিশন স্কুলে আসামি আব্দুল আলীমের নির্দেশে ও প্ররোচনায় ৬৭ জন হিন্দুকে হত্যা করা হয় । এরপর স্থানীয়দের ডেকে এনে স্কুলের পশ্চিম পাশে বাঙ্কার খুঁড়িয়ে ওই ৬৭ জন হিন্দুর লাশ মাটি চাপা দেওয়া হয়।
৬ / ছালামসহ ৯ জনকে হত্যাঃ
একাত্তরের মে মাসের প্রথম দিকে জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে ফজলুর রহমানসহ ১০ জনকে আটক করা হয়। এরপর তাদের পাকিস্তান সেনাবহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে এদের পাঁচবিবি থানার বাগজানা পুরনো রেলওয়ে স্টেশনের কাছে কোকতারা বকুলতলার পুকুর পাড়ে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এদের মধ্যে মোফাজ্জল নামে একজন প্রাণে বেঁচে যান।
৭ / ইলিয়াসসহ ৪ জনকে অপহরণ করে হত্যাঃ একাত্তরের ২৬ মে নওদা গ্রামের চার জনকে অপহরণ করা হয়। এরপর আলীমের পরামর্শে ও প্ররোচনায় ওই দিন সন্ধ্যায় কালী সাহার পুকুর পাড়ে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করে লাশ মাটিচাপা দেওয়া হয়।
৮ / ক্ষেতলাল গণহত্যাঃ একাত্তরের মে মাসের শেষের দিকে ক্ষেতলাল হিন্দুপল্লী, উত্তরহাট শহর, হারুনজাহাটসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে রাজাকার বাহিনী। আলীমের নির্দেশে দশ জনকে হত্যা করা হয়।
রোজার ঈদের আগে ক্ষেতলাল থানার উত্তরহাট শহরহাটের পশ্চিম পাশে একটি জনসভার আয়োজন করা হয়। পাকিস্তন সেনাবাহিনীর মেজর আফজালসহ বহু সেনাসদস্য ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। আলীম ওই জনসভায় বলেন, “আগামী ঈদে আমরা কলকাতা গড়ের মাঠে নামাজ পড়ব। সাধারণ মানুষের সাহস বৃদ্ধির জন্য হিন্দুদের ক্ষমা করা যাবে না। এদের যা পাও লুট করে নাও।”
৯ / পশ্চিম আমট্রা গ্রামে গণহত্যাঃ একাত্তরের ১৪ জুন বগুড়ার খোকন পাইকারসহ ১৫ জন যুবক জয়পুরহাটের আক্কেলপুর হয়ে ভারতে যাওয়ার পথে শান্তি কমিটির লোকজনের হাতে ধরা পড়েন। এরপর আলীমের নির্দেশে আক্কেলপুরের পশ্চিম আমট্রা গ্রামে এনে তাদেরকে হাত-পা বেধে নির্যাতন শেষে হত্যা করা হয়। এরপর ওই গ্রামের ময়েন তালুকদারের ছেলেকে ধরে এনে গর্ত করে লাশগুলো মাটি চাপা দেওয়া হয়।
১০ / জয়পুরহাট কলেজে ২৬ যুবককে হত্যাঃ একাত্তরের জুন মাসের শেষের দিকে আব্দুল আলীম জয়পুরহাট সদর রোডের শওনলাল বাজলার গদিঘরে শান্তি কমিটির অফিসে বসে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সন্দেহে পাহাড়পুর থেকে ধরে আনা ২৬ যুবককে হত্যার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর দুটি ট্রাকে করে ওই যুবকদের জয়পুরহাট রেলস্টেশনের পশ্চিমে ফাঁকা জায়গায় নিয়ে গিয়ে হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে ছবি তোলা হয়। ছবিসহ নেগেটিভগুলো আলীম নিয়ে গেলেও স্থানীয় ‘আলোখেলা’ স্টুডিওর মালিক এইচ এম মোতাছিম বিল্লাহ কয়েকটি ছবি নিজের কাছে রেখে দেন। ছবি তোলার পর ওই ২৬ যুবককে ট্রাকে তুলে জয়পুরহাট সরকারী কলেজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় ।
১১ / গাড়োয়ালদের হত্যাঃ মুক্তিযুদ্ধের সময় জুন মাসের শেষের দিকে কয়েকজন গাড়োয়াল এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনসহ মোট ২৬ জনকে আটক করা হয়। এরপর আলীমের নির্দেশে খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১২ / ডা. আবুল কাশেম হত্যাঃ একাত্তরে ২৪ জুলাই ডাক্তার আবুল কাশেমকে অপহরণ করা হয়। এরপর তাকে আটকে রেখে ব্যাপক নির্যাতন করা হয়। আলীমের নির্দেশে ২৬ জুলাই তাকে খঞ্জনপুর ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৩ / ১১ যুবককে হত্যাঃ একাত্তরের সেপ্টেম্বরে দুটি ট্রাকে করে মুখে কালিমাখানো ১১ জন যুবককে জয়পুরহাট থানা রোডের আজিমউদ্দিন সরদারের বাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা তাদের সরকারি ডিগ্রি কলেজে নিয়ে যায়। সেখানে আব্দুল আলীমের নির্দেশে ওই ১১ যুবককে ট্রাক থেকে নামিয়ে বারঘাটি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী।
১৪ / ফজলুল করিমসহ ৩ জনকে হত্যাঃ একাত্তরের ৭ অক্টোবর আক্কেলুপুর সদরের ফজলুল করিম ও অন্য ২ জনকে আটক করে আলীমের নির্দেশে মুখে চুনকালি লাগিয়ে জয়পুরহাট শহর প্রদক্ষিণ করানো হয়। পরে তাদের খঞ্জনপুর কুঠিবাড়ি ঘাটে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয় ।
১৫ / চিনিকলে হত্যাঃ একাত্তরের ২৫ আগস্ট পাঁচবিবি থানার সোলেমান আলী ফকির এবং তার দুই বন্ধু আব্দুস সামাদ মণ্ডল ও উমর আলী মণ্ডলকে পাঁচবিবি বাজারে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এরপর আলীমের নির্দেশে তাদের ওপর নির্যাতন চলে। পাকিস্তানি সেনাদের ওই ক্যাম্পে আরও ২৫ জনকে আগে থেকেই আটকে রাখা হয়েছিল। আসামি আলীম ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল চিনি কলের ক্লাবঘরে ‘কোর্ট’ বসিয়ে তাদের ‘মৃত্যুদন্ড’ দেয়। ওই ২৫ জনের মধ্যে ৮ রাতে পর্যায়ক্রমে ২৩ জনকে হত্যা করা হয়। সোলেমান ফকিরসহ বাকি ৪ জনকে ছেড়ে দিলে তারা নিরাপত্তার জন্য ভারতে চলে যান।
১৬ / আক্কেলপুরে উস্কানিমূলক বক্তব্যঃ আব্দুল আলীম একাত্তরে আক্কেলপুরের বিভিন্ন স্থানে উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেন। তিনি সোলায়মান আলী ফকিরের মিল প্রাঙ্গণ, আক্কেলপুর রেলওয়ে স্টেশন, বিভিন্ন মাদ্রাসায় স্থাপিত সেনাক্যাম্প, শান্তি কমিটির অফিস ও দুর্গাবাবুর দালানঘরে উস্কানিমূলক রাখে। এতে করে রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যরা মানবতাবিরোধী অপরাধে উৎসাহিত হয় ।
১৭ / জব্বল হত্যাঃ চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ১৭ উইংয়ের ইপিআর সুবেদার মেজর জব্বল হোসেন মুক্তিযুদ্ধে গুরুতর আহত অবস্থায় পাঁচবিবি ধুরইল গ্রামের নাজিমউদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খবর পেয়ে রাজাকাররা ওই বাড়ি ঘেরাও করে জব্বলকে অপহরণ করে। পরে আব্দুল আলীমের নির্দেশে তাকে হত্যা করা হয় ।

আমরা আমাদের এই জাতীয় বেঈমানকে ভুলবো না। মীরজাফরের নাম যেমন ঘৃনায় উচ্চারন করি, তেমনি এর নাম উচ্চারিত হবে আগামীতে।

৭০১জন ৭০১জন
0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ