৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ , শত্রু মুক্ত হয়েছিল এই দিন আমাদের জেলা ।
৭ ডিসেম্বর সকাল থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে জড়ো হতে থাকে বিভিন্ন বয়সের মুক্তিযোদ্ধারা । ২৭ এপ্রিল থেকে জেলা শহরটি পাকিস্তানি হানাদার আর রাজাকারদের দখলে । দীর্ঘ এই সময়ের অবরুদ্ধ , দখল হয়ে যাওয়া শহরটি মুক্তির দ্বারপ্রান্ত । পাকিস্তানি হানাদার আর রাজাকারদের পরাজয় এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
শহর সংলগ্ন বাসন্ডা নদী শহুরের পশ্চিম পাশে । দক্ষিন দিকে সুগন্ধ নদী । পূর্ব দিকে সুতালরী খাল , উত্তর দিকে কোন নদী বা খাল নেই , তবে দুর্গম পথ । চতুর্দিকে প্রস্তুত মুক্তিবাহিনী ।
আমাদের গ্রামের বাড়ী বাসন্ডা নদীর প্রায় সাথেই। ধান খেতে নামলেই শহর দেখা যায়। খুব সকালেই প্রায় ২৫ জন এর একটি মুক্তিবাহিনী গ্রুপ বাড়িতে এসে হাজির । স্বপ্নের যোদ্ধাদের মন হচ্ছে দেবদূত এক একজন । বড় হয়ে যাওয়া চুল , গাল ভর্তি দাঁড়ি প্রায় সবার। কালো জামা , কেউ প্যান্ট পরা কেউ কেউ লুঙ্গী । বাড়িতে উৎসবের আমেজ । রুটি , হাসের গোস্ত , খেজুর রসের ফিরনি খাচ্ছে সবাই । আগের দিন আব্বাকে জানানো হয়েছে আসবেন তাঁরা । আম্মা বাড়ীর বারান্দায় মাদুরে বসা মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়াচ্ছেন । কতদিন পেট ভরে খেতে পারেননি এরা । চোখে পানি আম্মার – তাঁর দু ছেলে এখনো ফিরে আসেন নি । সেই ২৭ এপ্রিল থেকে দেখা নেই তাঁদের। বেঁচে আছেন এইত সান্তনা ।
দশ বছরের জিসান ছুয়ে দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের কালো জামা । তাঁদের পায়ের কাছে রাখা এসএলআর এ হাত স্পর্শ করে । কি ঠান্ডা । নাম জিজ্ঞেস করে আর্মস গুলোর । কর্কশ , গলা ভাঙ্গা একজন মুক্তিযোদ্ধা জানিয়ে দেন , কোনটা এলএমজি , এসএমজি , এসএলআর , থ্রিনটথ্রি রাইফেল , পিস্তল । গলা জড়িয়ে ধরে এক মুক্তিযোদ্ধার ” আমিও যুদ্ধ করবো , আমিও রাজাকার পাকিস্তানি খুন করবো , আমিও যাবো তোমাদের সাথে ” । হেসে উত্তর দিলেন একজন দেবদূত ” আচ্ছা তোকেও যুদ্ধে নেব ” ।
৭ ডিসেম্বর মাগরেবের আজানের কিছুক্ষণ পরেই ‘ বাসন্ডা নদীর পূর্ব পারে পজিশন নেন মুক্তিযোদ্ধারা । ফুড গোডাউনে পাক সেনাদের অবস্থানের উপর চালায় এক পশলা গুলি। বালির বস্তার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ৬ জন রাজাকার রাইফেল বাইরে নিক্ষেপ করে দুই হাত উচু করে দৌড় দিয়ে পালায় । মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকে জিসান মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে । সবাই বুঝে যায় , পাক সেনারা আর পাহারা দিচ্ছেনা । রাজাকাররা দিচ্ছে। সাড়া রাত থেমে থেমে চলে গুলি । থেমে থেমে সবাই একযোগে দিতে থাকেন রণধ্বনি ” জয় বাংলাআআআআআ ‘ ।
৮ ডিসেম্বর , খুব সকাল থেকেই চলে প্রচন্ড গুলি বর্ষণ । শহর থেকে দু একটা রাইফেলের গুলি ছুটে আসে । দুপুর ১২ টার দিকে পাকসেনারা গান বোট নিয়ে শহর ছেড়ে চলে যায় । পালাতে থাকে রাজাকাররা । মুক্তিযোদ্ধারা প্রবেশ করতে থাকেন শহরে । তবে খুব সাবধানে চলাচল। রাজাকারদের হাতে তখনো রাইফেল , তারা সংখ্যায় কত জানা যায়না ।
বিকেল ৪ টা রাজাকাররা রাইফেল ফেলে পালাতে থাকে । রাজাকার কমান্ডার কুখ্যাত বারেক রাজাকার ধরা পরে সাধারণ মানুষের হাতে। কিল ঘুষি খেতে খেতে ঝাঁপ দেয় বাসন্ডা নদীতে । সাঁতরিয়ে ছোট নদীর পশ্চিম পাড়ে ওঠে। বারেক রাজাকারের জন্য অপেক্ষা করছিল সাধারণ মানুষ । ধরে ফেলে তাকে । মারতে মারতে নিয়ে আসা হয় ইছানীল স্কুলের মসজিদের সামনে । গ্রামের মানুষ ভেঙ্গে পরছে স্কুলের মাঠে । সবাই সুযোগ চাচ্ছে রাজাকার কমান্ডার কে মারার । লাথি , কিল , ঘুষি খেতে খেতে এক সময় সে মাটিতে পরে । বয়স্ক এক মহিলা তাঁর সাথে নিয়ে আসা ঝাড়ু শক্ত করে ধরে বারেকের কাছে চলে আসেন । কেউ একজন যেন বুঝতে পারে তাঁর মনের ইচ্ছে , শক্ত করে চিত হয়ে শোয়া বারেকের মাথাকে চেপে ধরেন তিনি । অন্য দুজন বারেকের দুচোখের পাতা খুলে ধরেন । মহিলা ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে ওঠেন ‘ কুত্তার বাচ্চা তোর ঐ দুচোখ অনেক নারীকে শেষ করে দিয়েছে , অনেক মা এর বুক খালি করেছে , এই চোখ আর দেখব না ” – বলেই ঝাড়ুর শলা ঢুকিয়ে দেন চোখে । রক্ত গড়িয়ে পরতে থাকে দু গাল বেয়ে । সমবেত জনতা রণধ্বনি দিতে থাকেন ” জয় বাংলাআআআআআআআআ ‘ ।
মানুষের লাথি খেতে খেতে একসময় নেতিয়ে পরে বারেক রাজাকার । এই ক’মাসের অমানুষিক কষ্ট , চাচাত ভাইকে পাক বাহিনী খুন করা , প্রিয় রমাদি , সপ্নাদিকে ধর্ষণ এবং খুন , আমাদের সমস্ত কিছু ধংস হওয়া , পুড়িয়ে দেয়া , বাড়ী লুট করে নেয়া , আব্বার উপর পাক সেনাদের টর্চার সব কিছু মিলিয়ে যে ক্রোধ সৃষ্টি হয় জিসানের মনে – তাতে ঐ বয়সেই সে ছুটে যায় বারেক রাজাকার এর কাছে । শরীরের উপর উঠে পাগলের মত পায়ের গোড়ালি দিয়ে আঘাত করতে থাকে সে । একটি সময়ে সবাইকে সরিয়ে নেয় জনতা । মরে গিয়েছে বারেক রাজাকার ।
অন্তত একজন রাজাকার হত্যায় জিসান অংশীদার – এই আত্মতৃপ্তি তার ।
৩৩টি মন্তব্য
মা মাটি দেশ
(y)
জিসান শা ইকরাম
🙂 -{@
শিশির কনা
আপনি কেন এসব লিখছেন না ? আপনি কথা দিয়েছিলেন যে লিখবেন ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো ।
এমন লেখা থেকে আমাদের বঞ্চিত করা কি উচিৎ ?
রিমি রুম্মান
পুরনো শকুনের দল আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তবুও আমরা হতাশ নই। ভাল থাকবেন।
জিসান শা ইকরাম
ঠিক , পূরানো শকুনের দল আবার নখ বসাচ্ছে । আপনিও ভালো থাকুন রিমি রুম্মান ।
জিসান শা ইকরাম
আসলে লেখার মানসিকতা আর নেই । শুধু রাজাকারদের বিচার চাওয়ায় দেশ আজ জিম্মি হয়ে গিয়েছে । স্বাধীনতার এত বছর পর এসে খুন হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধারা , রাজাকারদের হাতে । রাজাকারদের প্রতি সহমর্মিতা অবাক করে আমাকে । শিশিরকনা ।
আদিব আদ্নান
যে বোধ থেকে আপনি লিখছেন তা তো আমরা হারাতে বসেছি ।
আমাদের বোধোদয় হোক সামান্য হলেই এই প্রত্যাশা করি , এ সময়ে যা আমাদের খুবই জরুরী ।
জিসান শা ইকরাম
এই বোধ চির জাগরুক থাকবে আমার মাঝে 🙂
তন্দ্রা
আপনার কলম থেকে আরও মুক্তিজুদ্বের কাহিনী শুনতে চাই, বঞ্চিত করবেন না, নিশ্চয়।
জিসান শা ইকরাম
চেস্টা করবো তন্দ্রা ।
ছন্নছাড়া
স্যালুট স্যার আপনাকে ………………. (y)
আফসোস লাগছে আপনার গল্প পরে আমার কেন জন্ম হোল না ৭১ এ ……
বিজয়ের মাসে বিজয়ের গল্প …… অনেক ভালো লেগেছে ………
৭১ এর অনেক অনেক গল্প শুনতে চাই
জিসান শা ইকরাম
চেষ্টা করবো লিখতে ,
তবে মন সংযোগের অভাব
কত লেখা ১৯৭১ কে নিয়ে , কতজন আমরা পড়ি , উপলব্দি করি।
আমি কোন স্যার নই কিন্তু
সবার মত একজন সাধারন মানুষ 🙂
ছন্নছাড়া
স্যার রাউ তো মানুষ ভাইয়া …………… ওকে নো স্যার জিন ভাই 😀 \|/
জিসান শা ইকরাম
হা হা হা হা হ 🙂
ছন্নছাড়া
🙂
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের এ চেতনা সারা জীবন বয়ে বেড়ান দরকার ।
জিসান শা ইকরাম
ইনশ আল্লাহ্ বয়ে বেড়াবো তা ।
অনুশঙ্কর গঙ্গোম্যাক্সিম
আপনার কলম থেকে উঠে আসুন আমাদের না জানা কিছু মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের কাহিনী। -{@
জিসান শা ইকরাম
ধন্যবাদ ভাই
চেষ্টা করবো —
এই মেঘ এই রোদ্দুর
আপনি যুদ্ধ দেখছেন । বাহ ভাল লাগল শুনে
জিসান শা ইকরাম
যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখেছি।
৮ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি নিক্ষেপ দেখেছি ।
শুন্য শুন্যালয়
আপনি মুক্তিযোদ্ধা দের ছুয়ে দেখেছেন ..মুক্তিযোদ্ধা র ভাই আপনি, অনেক সৌভাগ্যবান..এমন লেখা আরোও শেয়ার করুন..কেমন উত্তেজনা ভর করে এসব জানতে পারলে.
আরও লিখুন ভাইয়া.
জিসান শা ইকরাম
জি দেখেছি , ছুয়ে দেখেছি সে সব দেবদূতদের
আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা – আমি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারিনি।
লিখবো আশাকরি ।
লীলাবতী
আপনার অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করছি জিসান ভাই। দেশে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ চাই আমরা । আরো লেখা চাই ১৯৭১ এর উপরে ।
জিসান শা ইকরাম
চেষ্টা করবো লিখতে ।
তার ছেঁড়া
বলার ভাষা খুজে পাচ্ছি না , যদি একটা রাজাকাররে পাইতাম..……
জিসান শা ইকরাম
ব্লগার হারিয়ে গিয়েছে 🙂
খসড়া
চলুক ভাইয়া এই তো চাই প্রতিটি ইতিহাস।প্রতিটি হিরক খন্ড।
জিসান শা ইকরাম
প্রতিটি ইতিহাস একটি হিরক খন্ড (y)
দুই বছর দুই মাস পরে জবাব দিলাম 🙂
কত স্মৃতি এই সোনেলাকে নিয়ে। কত যে পরিশ্রম করেছেন আপনি আপনার এই সোনেলার জন্য।
স্বপ্ন
কি লাভ হলো দেশ স্বাধীন হয়ে ? পরাজিত শক্তি অবরুদ্ধ করে রেখেছে দেশকে।
জিসান শা ইকরাম
কত ভাবে যে লাভ হলো তা নিয়ে না হয় একটি পোষ্ট দেবো।
নতুন কিছু লিখছেন না যে ……
নীলকন্ঠ জয়
এমন গল্প আমরা শুনতে। শকুনদের বিচার চাই এই বাংলায়। এমন কথিত স্বাধীনতা চাই না। আমরা মুক্তি চাই। জয় বাংলা।
জিসান শা ইকরাম
জয় বাংলা
ব্লগার হারিয়ে গিয়েছে 🙂