সময়টা ২০০৩। জুন মাসের চমৎকার একটি দিন।
আমার প্রথম সন্তান রিয়াসাত জন্মালো। তাঁর জন্মের একমাস আগ অবধি আমি জব করি। জবটি জরুরি ছিল। শরীরের ভেতর আরেকটি শরীর বহন করে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু খেয়ে রওয়ানা দিতাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। এরপর পথিমধ্যে বমি করতে করতে যাওয়া। ট্রেনে উঠে মনে মনে দোয়া করতে থাকি, আজ যেন রুজভেল্ট এভিনিউর এস্কেলেটরটা সচল থাকে। বলা বাহুল্য, ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই সেটি মেরামতের কাজ চলতো। কাজ থেকে ফেরার পথে পথিমধ্যে ট্রেন বদল করতে হতো। গ্রাউণ্ড ফ্লোর থেকে অনেক উপরে ৭ নং ট্রেন। কয়েক সিঁড়ি উঠি। দাঁড়িয়ে থাকি। শ্বাস নেই। আবার খানিক উঠি। উপরে উঠার সিঁড়ি যে আর শেষ হয় না ! একদিন গুনে দেখি সবমিলে ৯৭ টি স্টেপ ! এভাবেই দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে বাড়ি ফিরতাম প্রতি রাতে। দশ মাস পর সন্তান জন্মদানের সময়কার কষ্টের কথা আর না-ই বলি। শুধু বলি, পৃথিবীর কোন কষ্টের সাথেই একজন মা’য়ের সন্তান জন্মদানের কষ্টের তুলনা হতে পারে না। ভয়াবহ এক অন্ধকার। সেখান থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না ।
এ কষ্ট কেমন করে ভুলে যায় প্রতিটি মা ! কেমন করে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়জন জন্মায় ! ক’বছর বাদেই উত্তর পেয়ে যাই। মনে হতে থাকে, এত কষ্ট করে যাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে এলাম, তাঁর কোন ভাই-বোন থাকবে না, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার কিংবা বাবা-মা’র অবর্তমানে বিপদে এগিয়ে আসার কেউ থাকবে না, এ কেমন করে হয়। এরপর আবারও সেই কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। তখন ২০১০। এবার ভয়াবহ আরেক অভিজ্ঞতা। পুরো দশমাসই যমের সাথে লড়াই চলে। যম নিয়ে যেতে চায়। আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার ছয় বছরের ছেলেটির জন্যে। আটমাস লড়াই করে করে ক্লান্ত আমি জ্বরে পুড়ে যেতে থাকি। ডাক্তার চিন্তিত হয়ে উঠে। হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে পাঠানো হয় ইন্টেনসিভ কেয়ারে। মুখে অক্সিজেন,হাতে পা’য়ে, আঙুলে, সমস্ত শরীরে নানান রকম যন্ত্রপাতির তার আর নলে জড়িয়ে পেঁচিয়ে রাখা হয় আমায়। এক একটি মেশিন শরীরের এক একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যকারিতা জানান দেয়। স্যালাইন দেয়া, ব্লাড নেয়া সহ প্রতিদিন অগনিতবার সুঁই এর আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হই। ডাক্তার, নার্স, সবাই মাস্ক মুখে দিয়ে রুমে ঢুকে। আমি কারো মুখের অভিব্যক্তি দেখতে পাইনা। শুধু কুচ্কে থাকা কপালটুকু দেখে আন্দাজ করি, আমি সম্ভবত মারা যাচ্ছি। বাবা-মা’কে খুব মনে পড়ে। ভাইবোন দুটোর মুখ ভেসে উঠে। ছয় বছরের একমাত্র সন্তানকে খুব দেখতে মন চায়। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। কতদিন ছুঁয়ে দেখা হয় না ! কিন্তু ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিটে কারো ঢুকতে মানা। বিধায় ছোট্ট রিয়াসাতকে নিয়ে ওর বাবা দূরের রাস্তায় এক গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়, যেখান থেকে আমার রুমের জানালা দিয়ে আমি তাকে এক নজর দেখতে পাই। আরও ভালো করে দেখাবার জন্যে ওর বাবা ওকে কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দূরের সবকিছুই অস্পষ্ট। সেই অস্পষ্ট ছোট্ট রিয়াসাত’কে দেখে ভেতরটা হুহু করে উঠে। হাসপাতালের সাদা বালিশ অশ্রুজলে ভিজে উঠে।
দেশে মা রাতভর দীর্ঘ প্রার্থনায় বসে থাকে। আমার মৃত্যুপথ যাত্রী বাবা মসজিদে দোয়া পড়ায়। ফোন দিলে অস্পষ্ট স্বরে বলে, “মা’রে, তোর জন্যে মসজিদে দোয়া পড়াইসি, এতোগুলা মানুষের দোয়ায় ভালো হইয়া যাইবি “। এদিকে শারীরিক যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে আমার জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যেতে থাকে। জীবনকে বিষাক্ত মনে হয়। মনে হতে থাকে, যত তাড়াতাড়ি মৃত্যু, ততো তাড়াতাড়ি মুক্তি। অজ্ঞাত সেই ফ্লু এর কারনে যখন সারা বিশ্বেই শতশত মানুষ মারা যাচ্ছিল, তখন আমি সবার দোয়া, ডাক্তারদের নিবিড় চিকিৎসা আর সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে উঠি।
হাসপাতাল থেকে যেদিন রিলিজ পাই, সেইদিন যেন বহু বহু যুগ পরে বাইরের মুক্ত আলো-বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেই। পৃথিবীটাকে আগের চাইতে আরো সুন্দর,ঝলমলে মনে হতে থাকে। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে আসে। অতঃপর জুলাইয়ের এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে দ্বিতীয়জনের জন্ম হয়। তাঁর নাম রিহান।
প্রতিটি মা’য়েরই সন্তান জন্মদানের দুঃসহ কিছু গল্প থাকে। গল্পগুলোর মাঝে ভিন্নতা থাকে হয়তো। তবে অসহনীয় কষ্টগুলোতে ভিন্নতা নেই। আমার, আপনার, আমাদের সকলের মা’য়েরা এমন কষ্ট করেই আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন নিশ্চিত। এখন ২০১৭। আমার বাবা-মা কেউই বেঁচে নেই। রাত জেগে দীর্ঘ প্রার্থনা করবার কেউ নেই। ফোনের অন্যপ্রান্ত থেকে কেউই বলে উঠে না, ” মা’রে, তোর জন্যে মসজিদে দোয়া পড়াইসি, এতোগুলা মানুষের দোয়ায় ভালো হইয়া যাইবি “।
প্রতিবার জন্মের এইদিনে মা’কে, বাবাকে খুব মনে পড়ে।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
২৭টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
খুব সুন্দর বিষয় তুলে এনেছেন আপু।
মনে হতে থাকে, এত কষ্ট করে যাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে এলাম, তাঁর কোন ভাই-বোন থাকবে না, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার কিংবা বাবা-মা’র অবর্তমানে বিপদে এগিয়ে আসার কেউ থাকবে না, এ কেমন করে হয়
-{@
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন। সুস্থ থাকুন। শুভকামনা রইলো -{@
ইকরাম মাহমুদ
আমার, আপনার,
আমাদের সকলের মা’য়েরা এমন কষ্ট
করেই আমাদের পৃথিবীতে এনেছেন
নিশ্চিত।
আমার জন্মের সময় আম্মুর জীবনের গল্পটাও এমনই ছিল হয়তো। বোধকে নাড়া দেওয়ার মতো একটি লেখা।
রিমি রুম্মান
আপনার বাবা-মা যেখানেই থাকুক, ভালো থাকুক । ভালো থাকুন আপনিও।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
যত কষ্টই হউক মা যখন সন্তানের মুখ দেখেন তখন তার সব কষ্ট ঐ সুখের কাছে ম্লান এটা বলতে পারেন এ জীবনের চিরসত্য নিয়ম।নারী বা মায়েরা সন্তান জন্মাতে অসহনীয় কষ্ট করেন সত্য এ সত্য অন্য কোন কষ্টের সাথে তুলনা হয় না।আবার নারীরা এমন কষ্ট না করলে সমাজ তাকে বন্ধা বলে তিরস্কার করেন।পৃথিবীতে সব দিক দিয়েই নারীদের সীমাহীন কষ্ট সইতে হয়।আর সে সন্তানরা যখন মা বাবার অবাধ্য হন তখন সন্তান জন্মদানের চেয়েও বেশী কষ্ট হয় তাদের।
আমারও মা বাবা নেই পৃথিবীর সব মায়েরা ভাল থাকুক এই কামনা। -{@
রিমি রুম্মান
ভালো থাকুন আপনিও। ভালো থাকুক সকল বাবা-মা। শুভকামনা … -{@
গাজী বুরহান
চোখের জল স্পর্শ করে বুঝলাম, অনুভূতি গুলো ভালোই জানানো দিয়েছে।
রিমি রুম্মান
ভালো থাকুন, অনেক ভালো।
শুভকামনা রইলো… -{@
নীহারিকা জান্নাত
শুভ জন্মদিন আপা।
অনেক অনেক শুভকামনা।
রিমি রুম্মান
আপনার জন্যেও শুভকামনা। -{@
ছাইরাছ হেলাল
এক জন মা-ই জানে গভীরতম যন্ত্রণার উপলব্ধি,
আল্লাহ আপনাকে সহি-সালামতে রাখুক এই কামনাই করি।
রিমি রুম্মান
আল্লাহ্ আমাদের সকলকে ভালো রাখুক, সুস্থ রাখুক।
জিসান শা ইকরাম
কিভাবে এই লেখায় মন্তব্য করবো বুঝতে পারছিনা।
সন্তান জন্মে মায়ের কষ্টটা যেন দেখতে পেলাম আপনার লেখার মাঝে।
একজন সন্তানের ভাবনাতে এটি থাকা উচিৎ যে তাঁর জন্মে মা যে কষ্ট করেছেন, এই কষ্টের কারনে আমৃত্যু মায়ের পদতলে বসে থাকা উচিৎ।
শুভ জন্মদিন দিদি ভাই -{@
জন্মদিনের আনন্দে কাটুক তোমার সারা জীবন
চারজনে সব সময় ভাল থেকো।
রিমি রুম্মান
তোমাদের সকলের দোয়ায় এমনই ভালো থাকতে চাই।
নীরা সাদীয়া
খুব কষ্ট ছোঁয়া অনুভূতি।
রিমি রুম্মান
এই অনুভূতিটুকু আমাদেরকে মা’কে মনে করতে বলবে, মায়ের কষ্টটুকু বুঝতে শিখাবে।
প্রহেলিকা
খুব টাচি লেখা। পড়তে পড়তে কোথায় যেন একটা ভার অনুভব করলাম।
শুভেচ্ছা জানবেন জন্মদিনের। ভালো থাকুন।
রিমি রুম্মান
অনেক শুভকামনা রইলো।
ভালো থাকুন আপনিও । -{@
অরণ্য
লেখাটি পড়েছি আগেই; মন্তব্য করা হয়নি। কি কি লিখতে চেয়েছিলাম।
এখন আপাতত শুভেচ্ছা জানাই।
বই মেলায় সোনেলা বাহিনীর সাথে স্টল খুঁজে “পুবের আকাশে ভোরের অপেক্ষায়” কেনা – এ এক দারুন অনুভুতি। যখন বললাম “আমরা একই পরিবারের”, সাথে সাথে আমার কাগজের খামটি পরিবর্তিত হয়ে গেল কাপড়ের ব্যাগে! রিমি রুম্মান যে আমাদের!
ভাল থাকবেন। (y)
রিমি রুম্মান
জেনে ভালো লাগলো যে আমার খুব কাছের মানুষগুলো (সোনেলা পরিবার) বইটির সন্ধানে দলবেঁধে গিয়েছে, নিয়েছে।
কোন এক বইমেলায় স্টলে থাকবো বলে স্বপ্ন দেখি।
শুন্য শুন্যালয়
শুভজন্মদিন প্রিয় আপু।
আইসিইউতে শুয়ে জানলা দিয়ে দূর থেকে রিয়াসাত কে দেখা! তুমি যে কিভাবে লেখো আপু, ভেতর টা কেঁপে ওঠে। ভালো থেকো প্রিয় আপু।
ভালো থাকুক প্রিয় মা -বাবারা। -{@
রিমি রুম্মান
ছেলেটিকে ক’দিন দেখতে না পেয়ে সে যে কি অসহায় অনুভুতি, ভাষায় প্রকাশ করার নয়। আমার শাশুড়ি লেখাগুলো পড়ে আফসোস করে। বলে ইস্ রিয়াসাত যদি বাংলা পড়তে পারতো শুধুমাত্র এই লেখাগুলো পড়বার জন্যে ! আমি সান্তনা দিয়ে বলি, আম্মা, আমি লেখাগুলো ইংরেজিতে লিখে রাখবো।
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু দেরী হয়ে গেলো শুভেচ্ছা জানাতে।
শুভ জন্মদিন প্রিয় আপু। -{@
ভালো রেখো।
রিমি রুম্মান
তোমাদের শুভেচ্ছা, শুভকামনা সবসময়ই আমার সাথে আছে, আমার বিশ্বাস।
ভালো থেকো, নীলা’দি। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
আমার খুব প্রিয় একটা গান তোমার জন্য।
https://www.youtube.com/watch?v=OQHZ5CgFbTw&list=FLoDmHe3lLRwTgxQJdBjMIDQ&index=28
সিনেমাটিও দেখো, যদি না দেখে থাকো।
রিফাত নওরিন
অসাধারন লাগলো আপু, এতো মায়া জড়ানো আছে আপনার লিখায় পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিলো এ যেন আমারও অনুভূতি!!
ভালো থাকুন, শুভকামনা রইলো…., -{@
রিমি রুম্মান
ভালো লাগলো জেনে।
অনেক শুভকামনা রইলো । -{@