বেদনায় বলা কথা
*********************
কিছুদিন আগে শেষ হওয়া অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষার খাতা দেখানো চলছে। ক্লাস ফোর- এ পড়া একজন বাচ্চা তার খাতায় প্রাপ্ত নাম্বার দেখে চরম হতাশ। হঠাৎ করে সে সবার অলক্ষ্যে চলে গেলো ছাদে। উদ্দেশ্য, ঝাঁপিয়ে পড়ে দিয়ে দেবে নিজের জীবন। সৌভাগ্যক্রমে একজন শিক্ষক দেখে ফেলেন এবং বাচ্চাটিকে ছাদ থেকে নিয়ে আসেন।
আজ দুপুরে স্কুল ফেরত মেয়ের মুখ থেকে কথাটা শুনে ভীষণভাবে অবাক হয়েছি। হয়েছি মর্মাহত। একটি কথাই তখন থেকে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, কী অসহনীয় জীবন পার করছে আমাদের সন্তানরা! এই নির্মল শৈশবে যখন তাদের প্রজাপতির মতো নিশ্চিন্তে উড়ে বেড়ানোর কথা, তখন কিনা তারা আত্মহত্যার মতো কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে? কারণ কী?
বেশ কিছুদিন আগে একবার কোচিং সেন্টারে গিয়েছিলাম। আমি যেদিন গেছি সেদিন আবার ওখানে পরীক্ষার খাতা দেখানো চলছে। বাচ্চাদের মায়েরা উদগ্রীব হয়ে নিজের নিজের বাচ্চার খাতা দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কারো বাচ্চা হয়তো অকারণেই ভুল করে দুই এক নাম্বার কম পেয়ে গেছে সহপাঠীর চেয়ে। কেন কম পেলি? কেন এতবার করে শেখানোর পরও এই সামান্য জিনিস ভুল হয়? মায়ের আস্ফালন। অতঃপর দুম দুম পিঠের ওপর দু’চার ঘাঁ। তারপর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে, ” বাড়ি চল, দেখাচ্ছি মজা।” জলে টইটুম্বুর চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই বাচ্চার। সত্যিই তো, ভুল তো সে করেছে! ছিঃ!
আজ যখন স্কুলের ছাদে গিয়ে বাচ্চাটির আত্মহত্যা প্রচেষ্টার কথা শুনি, চোখে ভেসে ওঠে সেদিনের কোচিং সেন্টারের সেই দৃশ্য। নিশ্চয়ই এ বাচ্চাটির মা-ও জানতে চাইবে, অর্ধ-বার্ষিক পরীক্ষায় তার সন্তানের নাম্বার। আর নাম্বার যেহেতু আশানুরূপ হয়নি, মায়ের কিংবা বাবার মুখোমুখি হওয়ার সাহস সে পাচ্ছে না। আর পাচ্ছে না বলেই এই কঠিনতম সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার কচিমন।
কী ভয়াবহ অবস্থা!
আরও আরও ভালো নাম্বার, আমার বাচ্চাই সেরা, আমার বাচ্চাই প্রথম হবে….. আমাদের এই দাবি মেটাতে গিয়ে শেষ করে দিচ্ছি যে আমাদের সন্তানদের মধুর শৈশব, সেকথাটা কেন একবারও ভাবছি না আমরা? কেন ভাবছি না, আমাদের সন্তানদের জীবন সংশয় উপস্থিত আমাদেরই কারণে? আজ সৌভাগ্যক্রমে বাচ্চাটি বেঁচে গেলো, কিন্তু যদি যথাসময়ে শিক্ষক সেখানে উপস্থিত না হতেন? হারিয়ে যেতো শিশুটি পৃথিবী থেকে। পরীক্ষার খাতায় হয়তো আগামীতে ফিরে আসবে ভালো নাম্বার, কিন্তু শিশুটিকে ফেরানো যেতো না কোনোভাবেই। কোমল শিশুমনে কঠিন এক বেদনা নিয়ে হারিয়ে যেতো সে চিরতরে।
স্বীকার করি, আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির জটিলতার কারণেই তৈরি হচ্ছে বাড়তি চাপ। সেটুকু আমাদের সন্তানরা সামলে নিচ্ছে কষ্ট করে। কিন্তু আমরা অভিভাবকরা কেন এত অসহনীয় হয়ে উঠছি? কেন সেই চাপের ওপর আরও চাপ প্রয়োগ করছি? সবাইকে সব পরীক্ষায় প্রথমই হতে হবে কেন?ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারই কেন হতে হবে সবাইকে? প্রকৃতিপ্রেমী হোক, হোক শুদ্ধ মানুষ, দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসুক। পরীক্ষায় একটু নাহয় কম নাম্বারই পাক! দু’লাইন কবিতা লিখে চমকে দিক সবাইকে। লিখে ফেলুক সুখেন মরমু নামক কোনো সাঁওতালের সুখ দুঃখের কাহিনী। বাঁচুক ওরা প্রাণখুলে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে। একদিন ঠিক ওরা দাঁড়িয়ে যাবেই নিজের পায়ে। দাঁড়াবেই!
২৩টি মন্তব্য
তৌহিদ
আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির অবশ্যই গলদ আছে যার কারনে বাড়তি অমানুষিক চাপে থাকে বাচ্চারা। আর গার্জিয়ানরাতো প্রতিমুহূর্ত চাপ দেয় গোল্ডেন জিপিএ পেতেই হবে, না হলে মান সম্মান সব গেলো বলে! কি আশ্চর্য! আপনার লেখায় বাস্তবিক অনেক কিছু এসেছে।
ধন্যবাদ এমন সুন্দর একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্যে।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন ভাই।
শিরিন হক
যখন অভিভাবক কে বলতে শুনি ভাবি আর বইলেন না ছেলের রেজাল্ট শুনলে লজ্জা পাবেন কাউকে আমি মুখ দেখাতে পারছিলনা। তখন জিগ্যেস করতে মন চায় এই ক্লাসে আপনার নম্বর কত ছিলো? প্রথম হওয়ার প্রতিযোগীতায় আমরাই আমাদের সন্তনদের ভবিষ্যৎ নস্ট করছি।শুধু আত্মহত্যা ই নয় বাচ্চাদের বখে যাওয়া বিগরে যাওয়া ও এর একটি কারন।
প্রথম নয় যেনো শিখতে জানতে এবং বুঝতে পারে আমাদের সন্তানরা এই চিন্তা টুকু থাকলে এতো চাপে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নস্ট হতোনা।
শুভকামনা আপু। খুব ভালো পোস্ট একটা।
রেহানা বীথি
অনেক ভালোবাসা।
জিসান শা ইকরাম
চতুর্থ শ্রেনীর এক ছাত্রের আত্মহত্যা চেস্টা!
কত ভয়াবয় এক চিন্তা, অবস্থা। ঐ ছেলের বাবা মা ছেলেকে পড়াশুনার জন্য তিরস্কার করেন বুঝাই যাচ্ছে।
অসুস্থ এক প্রতিযোগীতা শিশুদের মাঝে সংক্রামিত করে দিচ্ছে মা বাবা।
পরীক্ষায় নাম্বার চাই বাচ্চাদের, প্রকৃত শিক্ষা চাই না, এই হচ্ছে সন্তানদের মা বাবার মনোভাব।
প্রতিটি শিশু বড় হোক তার আনন্দের মাঝে।
ভালো লিখেছেন।
রেহানা বীথি
একদম।
অনেক ধন্যবাদ
বোকা মানুষ
খুব সময়োপযোগী একটা লেখা! এই কারনেই আমি আমার বাচ্চাকে পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়ে বিচার করি না! পড়াশোনার গুরুত্ব তাকে বোঝাই, উঠসাহ দিই। কিন্তু রেজাল্ট আশানুরূপ না হলে বলি “সমস্যা নেই, পরের বার ভাল হবে!” এতে যদি সিস্টেমের সামনে আমার ছেলে অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে তো হোক। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ তাকে একজন হ্যাপি ও ভাল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। এটুকু করতে পারলে বাকিটুকু সে নিজেই করে নিতে পারবে।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ
প্রদীপ চক্রবর্তী
আমাদের শিক্ষাপদ্ধতিতে প্রচুর গলদ রয়েছে।
ছেলে ডাক্তার হবে ইন্জিনিয়ার হবে তাই পরীক্ষার খাতায় বেশি বেশি মার্ক চাই।
আর এই অসুস্থ প্রতিযোগীতার জন্য দায়ী শিশুর পরিবার।
এই অসুস্থ সংক্রামক প্রতিযোগীতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে পরিবারের প্রধানদের। আর তা না হলে প্রতিটি শিশুর সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ঘটবে না।
.
প্রতিটি শিশু সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত হক।
প্রতিটি শিশুর সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ঘটুক।
প্রতিটি শিশু আপন ছন্দে বেড়ে উঠুক।
.
বেশ ভালো লেখনী দিদি।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ
মাসুদ চয়ন
মৌলিক সত্যতা তুলে আনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ লেখিকাকে
রেহানা বীথি
শুভকামনা সবসময়
মনির হোসেন মমি
লেখাটি আগে নিজের ওয়ালে সেয়ার দিয়েছি। বর্তমান লেখা পড়ার যে সিষ্টেম তাতে ছেলে মেয়েদের ভবিষৎ অন্ধকার। এতো অল্প বয়সে এতো চাপ ওদের মানষিক ভাবে নির্যাতন করার সামীল।আর অভিভাবকদের চিন্তা করার কারনও আছে সন্তান যদি ভাল রেজাল্ট না করে তবে ভাল কোন স্কুলেও ভর্তি হতে পারবে না।এ ক্ষেত্রে আমি মনে করি আমাদের বর্তমান শিক্ষানীতির পরিবর্তন দরকার। চমৎকার লেখা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ
নাজমুল হুদা
লেখাটি পড়ে আমার অতীত মনে পড়লো ।
আমি কোনোদিন ক্লাসের মেধাবী ছাত্র ছিলাম। সব সময় স্যারদের একটা খসড়ায় দ্বিধান্বিত ভাবে স্থান পেতাম। আবার কখনও খারাপ ছাত্র বলেও গালি পেতাম না। রেজাল্ট খারাপ করলে একটু স্বাভাবিক শাসন করতেন, যা স্বাভাবিকভাবে সবাই করেন।
কিন্তু বর্তমানে কিছু অভিভাবক আছেন তাদের কোমলমতি কচি ছেলে মেয়েগুলো একটু রেজাল্ট খারাপ করলেই যেন মনে হয় যেন সম্মানের নৌকা ডুবে গেছে। এর থেকে মনে হয় আর রক্ষা নাই।
এক্ষেত্রে মনে করি, ছোটদেরকে ততদিন অনুপ্রেরণার গল্প শুনাতে হয়, যতদিন সে অন্য কাউকে অনুপ্রেরণার গল্প শুনাতে না পারছে।
আমার জীবনে সবচেয়ে স্মরনীয় ঘটনা, যখন ক্লাস সিক্সে ভর্তি হই তখন থেকে এস এস সি পর্যন্ত ফাইনাল পরীক্ষা ব্যতিত কোনো পরীক্ষায় গনিতের পাশ করতে পারতাম না।
শুধু অলৌকিকভাবে যেন বোর্ড ফাইনাল এবং স্কুল ফাইনাল গুলো পাশ করে ফেলতাম।
এজন্য প্রথমে অভিভাবকরাই হতে পারে শিশুদের বা সন্তানদের আর্দশ । তাছাড়া জেনেটিক প্রভাব তো আছেই, থাকবেই।
ধন্যবাদ আপনাকে অনুপ্রেরণামূলক পোস্টের জন্য।
রেহানা বীথি
আপনাকেও ধন্যবাদ
ছাইরাছ হেলাল
পরীক্ষা পদ্ধতি না পাল্টালে পরিণতি ভয়াবহ।
উন্নত বিশ্বের কাছে কত্ত কিছু শিখছি শুধু শিক্ষা পদ্ধতির বেলায় বালুতে মুখ গুজে থাকছি।
আপনি বাস্তবতা তুলে ধরেছেন আপনার সুন্দর লেখনিতে।
রেহানা বীথি
একদম ঠিক।
ধন্যবাদ অনেক।
রাফি আরাফাত
কিছু সত্য বলাটাই আজ লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছে । তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকবেন।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন আপনিও
ইঞ্জা
আমার ছেলে একটা সাবজেক্টে খুবই কম নম্বর নিয়ে পাশ করার পর ও ভয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে, সে সিউর ওর বাবা অফিস থেকে এসেই মাইর দেবে, আমি অফিস থেকে সন্ধ্যায় না ফিরে দুপুরেই ফিরে এসে ওর সাথে একান্তে বসে বুঝায়, যে সাবজেক্টে সে খারাপ করেছে তার প্রশ্ন আমি আগেই দেখে বুঝেছিলাম এ বড়ই ছন্নছাড়া টাইপের ছিলো, বইটা ভালো করে পড়লে এই সমস্যা হতোনা, অসুবিধা নেই আগামী পরিক্ষাতে ভালো ফল করলেই হবে, ছেলে আমার আস্বস্ত হলো।
আমার কথা হলো যা চলে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে লাভ কি, আগামী যেন ভালো হয় তার খেয়াল রাখতে হবে সবাইকে।
ধন্যবাদ আপু, খুব ভালো পোস্ট দিলেন।
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ ভাইয়া
ইঞ্জা
শুভেচ্ছা আপু