দ্বিধাদ্বন্দের কৈশোর সময়

রিমি রুম্মান ৪ আগস্ট ২০১৯, রবিবার, ০১:০২:৪২পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ১০ মন্তব্য

নিউইয়র্ক নগরীর স্কুলগুলোয় এখন গ্রীষ্মকালীন ছুটি চলছে। দীর্ঘ দুই মাসের ছুটি। বছরের বাকি সময়টায় স্কুল, লেখাপড়া আর ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে একটা নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে হয় আমাদের সন্তানদের। আর তাই গ্রীষ্মকালীন ছুটির সময়টাতে সাধ্য অনুযায়ী ঘুরে বেড়াতে, আনন্দময় সময় কাটাতে চেষ্টা করেন বেশিরভাগ পরিবার। বলা চলে, দুই মাসের এই আনন্দই বাকি দশ মাস প্রাণ খুলে বেঁচে থাকার রসদ। কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাদের সন্তানদের যে বিষয়টি বেশি ভাবায়, অর্থাৎ যে বিষয়ে আমার বেশ কিছু বন্ধুর অভিযোগ, তা হলো, একটু বড় হবার পর বিশেষ করে কিশোর বয়সি সন্তানেরা সবখানে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কোন পারিবারিক পার্টি কিংবা আত্মীয়ের বাসায় যেতে চাইলে একের পর এক প্রশ্ন তাদের। কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, সেখানে কারা আসবে, আমার সেখানে গিয়ে কাজ কী, আমাকে কেন সেখানে যেতে হবে… ইত্যাদি। বাবা-মায়ের চাওয়াকে তোয়াক্কা করতে চায় না এদেশে বেড়ে উঠা অনেক কিশোর বয়সী সন্তান। আবার কিছু পরিবার সেই ছোট্টটি থেকেই তাদের সন্তানদের নিয়ে আত্মীয় কিংবা বন্ধুদের পরিবারে এমনভাবে মিশেছে, চমৎকার সব স্থানে ভ্রমন করেছে যে, তাদের সন্তানরা অধির হয়ে অপেক্ষায় থাকে, প্রশ্ন করে অবিরত, এ সপ্তাহে আমরা কোথায় যাচ্ছি, কখন রওয়ানা হচ্ছি, কে কে যাচ্ছে… ইত্যাদি।

সপ্তম গ্রেডে পড়ুয়া তুষার আমার বন্ধুপুত্র। শীতের শুভ্র তুষারের মতোই নরম, কোমল হৃদয়ের শান্ত, চুপটি করে থাকা ছেলে সে। বাবা-মা দিনভর ব্যস্ত নিজনিজ কর্মস্থলে। রাতে বাড়ি ফিরে খোঁজ নেন তুষার ঠিকমতো খেয়েছে কিনা, হোমওয়ার্ক করেছে কিনা, স্কুল থেকে কোন অভিযোগ এসেছে কিনা। পরদিনের স্কুলের প্রস্তুতি স্বরূপ ঘড়ির সময় ধরে তুষার আর তৃণা দুই ভাইবোনকে ঘুমাতে তাগাদা দেন। বাবা-মা হিসেবে তারা তাদের সব দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু দিনের দীর্ঘ একটা সময় স্কুলে অতিবাহিত হলেও মায়ের সাথে তাদের কতো কী শেয়ার করার কথা ! স্কুলে ঘটে যাওয়া আনন্দের কিংবা বিষাদের বিষয়গুলো শেয়ার করা থেকে বঞ্চিত দুই ভাইবোন। প্রতিটি পরিবারের নিজস্ব কিছু নিয়ম থাকে। তুষারদের পরিবারে এটিই নিয়ম, এটিই রুটিন জীবন। রোজ ভোরে একাকি নিজের ব্রেকফাস্ট করা, দুপুরে বাড়ি ফিরে মাইক্রোওয়েভে খাবার গরম করে খাওয়া, হোমওয়ার্ক করা, সন্ধ্যায় ক্লান্ত বাবা-মা বাড়ি ফিরলে প্রতিটি কাজের হিসেব দেয়া, অতঃপর ঘুমিয়ে পড়া। একদিন আমার বন্ধুর পুত্রকন্যা যখন কিশোর হয়ে উঠলো, তখন এদেশীয় বন্ধুদের সাথে মুভি দেখতে থিয়েটারে যাবার বায়না ধরলো, বন্ধুদের বাসায় বেড়াতে যাবার বায়না ধরলো। কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হল না। শুরু হলো বাবা-মায়ের সাথে দ্বন্দ্ব। তুষারের বাবা-মায়ের উপলব্ধি হলো, গ্রীষ্মের ছুটিতে সবাই সপরিবারে কতোখানে যাচ্ছে, আমরা যাচ্ছি না কেন ! যেই কথা, সেই কাজ। তুষার, তৃণাকে নিয়ে ছুটলো দূরের চমৎকার এক দর্শনীয় স্থানের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সারাটা পথ তুষার যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করতে লাগলো। তার প্রশ্ন হলো, তাকে সেখানে কেন যেতে হবে ! অবশেষে বাধ্য হয়েই সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে আসতে হলো পরিবারটির।

যে কিশোর তুষারের গল্প তুলে ধরেছি, আমাদের চারপাশে ঘরে ঘরে এমন তুষারদের বসবাস। আমরা বাবা-মায়েরা ভুলে যাই, জন্ম থেকে যে শিশুটি কোথাও ঘুরতে, বেড়াতে যায়নি, শুধুই নিয়মের বেড়াজালে ব্যস্ত বাবা-মায়ের সংসারে নিজের মতো করে বেড়ে উঠেছে, কিশোর বয়স অতিবাহিত করছে, সে তো একাকি নিজের মতো করে নিজের জগত তৈরি করে নিয়েছে, যেখানে কেবলই তার একার বিচরণ। তার তো হুট করে স্বভাব বদলানো যাবে না। আচমকা একদিন তাকে ডিজনিল্যান্ড নিয়ে গেলে তো সে আনন্দিত হবার কথা নয়। সে তো এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেনি ! সে তার ফেলে আসা সময়ের মতোই নিরিবিলিতে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। আমরা বাবা-মায়েরা ভুলে যাই, কৈশোর সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বের সময়। ছোটবেলা থেকে পরিবার থেকে দেখে আসা, শিখে আসা বিষয়গুলোকে পুঁজি করে ব্যক্তিত্ব গঠনের উপযুক্ত সময়। সময়টি জীবনকে সামনে এগিয়ে নেবার, অপার সম্ভাবনার। আবার শারীরিক ও মানসিক চ্যালেঞ্জেরও। শিশু বয়সে বাবা-মা সন্তানদের ভালো-মন্দ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারলেও কিশোর বয়সে তারা নিজের মত প্রকাশ করতে শুরু করে। নিজের চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্ব দিতে শুরু করে। আমরা অভিভাবকরা তাদের কাছে লাগামহীন প্রত্যাশা করি। কথায় কথায় অন্যদের উদাহরণ টানি। আমরা ভাবি না, আমার সন্তান অ্যাংজাইটি কিংবা ডিপ্রেশনের মতো কোন সমস্যায় ভুগছে কিনা। নিজের কিশোর সময়ের কথা মনে করলে আমার এখনো দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার মনে পড়ে, আম্মার দীর্ঘশ্বাসমাখা মুখখানা। হতাশার স্বরে বলতেন, ‘ অমুকের মেয়ে অভাব অনটনের মাঝে থেকেও কতো ভালো রেজাল্ট করেছে। না চাইতেই সব পাইয়াও তোরা যদি ভালো রেজাল্ট না করছ এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের আর কী আছে ! ‘ আমার ভেতরে তখন সেই অমুকের মেয়ের প্রতি কিঞ্চিৎ হিংসার উদ্রেক হতো, ক্লাসে তার পাশে বসতে সংকোচবোধ হতো। নিজের অক্ষমতার কথা ভেবে হীনমন্যতায় ভুগতাম। হতাশায় পেয়ে বসতো। নিজের উপর বিরক্তি চেপে বসতো। রাতে সকলের অগোচরে ফুঁপিয়ে কাঁদতাম নিজের এই তুমুল খারাপ লাগার অনুভূতির কথা কাউকে বলতে না পারার বেদনায়। এই যে আমার কিশোর মনের বিষণ্ণতা এবং মানসিক অবসাদগ্রস্ত জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে এসেছি, এ কেবল আমিই জানি। এখনো সেইসব কঠিন বাস্তবতার দিনগুলো মনে হলে ক্লান্তি লাগে খুব। সন্তানের সবচেয়ে বড় বিশ্বাসের জায়গা তাদের বাবা-মা। তাই বাবা-মাকে হতে হবে সন্তানের সবচেয়ে বড় এবং কাছের বন্ধু, যার কাছে মন খুলে বলা যায় সকল আনন্দের এবং বিষাদের গল্প। ছোটবেলা থেকেই তাদের নিয়ে সময় সুযোগ করে সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে গেলে পরবর্তীতে ঘুরে বেড়ানোটা তাদের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠে। সেই সাথে পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন মজবুত হয়ে উঠে। জর্জ বার্নস এর উক্তি দিয়ে শেষ করছি, ” তখনই সুখি হবেন, যখন আপনার থাকবে একটি যত্নশীল, আদুরে, দৃঢ় বন্ধনসম্পন্ন যৌথ পরিবার, যারা আপনার থেকে দূরে বাস করে”|

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

 

৬০৪জন ৫১৪জন
0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ