ফিরে আসা

নীলাঞ্জনা নীলা ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ১০:০৬:২৩পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, বিবিধ ৪৮ মন্তব্য

কতোকাল পর মনে হচ্ছে নিজের ঘরে এসেছি। অনুভূতিটা কেমন জানি, ঠিক বলে বোঝাতে পারবোনা। আজই বাসায় ফিরলাম। সেই যে ৮ জানুয়ারি আমাকে পৃথিবী থেকে কতো দূরে যে নিয়ে গিয়েছিলো। একেকটি মুহূর্ত মনে হতো জেলখানা কি এমনই? কি সুন্দর একটা ভোরে বাসা থেকে বের হয়েছিলাম। সেদিনকার সকালটা আমার জীবনের দেখা সবথেকে সুন্দরতম সকাল। বেশ কিছু ছবি তুললাম সকালের। তারপর ক্লায়েন্টের বাসায়। সকালের ক্লায়েন্ট শেষ করার পথে, ২ নম্বর বাস ধরলাম ব্রাম্পটন স্ট্রীটে যাবো। ক্লায়েন্টকে ফোনও দিলাম, দুপুর ১ টার মধ্যে আসছি। বাস থেকে নেমে ৪ নম্বর বাসের অপেক্ষা, রাস্তার অন্যপাশে। সিগনালের অপেক্ষায়, সিগনাল পড়তেই রাস্তা ক্রস করছিলাম। হঠাৎ প্রচন্ড জোরে হর্ণের শব্দ। একেবারে স্ট্যাচু। তারপর দেখি আমি উপর থেকে নীচে পড়ছি। নাহ জ্ঞান হারাইনি। আমার ফোন খুঁজছিলাম, অফিসে জানাতে হবে আমার এক্সিডেন্টের কথা। ফোন দিলো কে এক পথচারী। ঐ অবস্থাতেই কো-অর্ডিনেটর পামেলার এক্সটেনশন নাম্বার দিলাম, আমি বললাম জ্যাকুলিনের কাছে কোনো নার্স পাঠাও, আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে। তারপর বলছি নিজেকে হুইল চেয়ার আমার জন্যে না। আমার বাপি-মামনির জন্যে আমাকে এই পায়েই দাঁড়াতে হবে। একজন মহিলা এসে আমাকে বললো, “হান একটু অপেক্ষা করো, এম্বুলেন্স আসছে। আমি একজন নার্স। মনে হয় তোমার হাড় ভেঙ্গেছে।” ওই অবস্থাতেই জিজ্ঞাসা করলাম আমি দাঁড়াতে পারবো তো? বললো মহিলা যে পারবো। ঘটনা ঘটার ২ মিনিটের মধ্যে এম্বুলেন্স, পুলিশ, ফায়ার কন্ট্রোল সব এসে পড়লো। ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে, নিজের অজান্তেই চিৎকার বেড়ুচ্ছে গলা থেকে। যতো বোঝাই নিজেকে চুপ, কিন্তু পারছি কই?

তারপর এমার্জেন্সি। সোশ্যাল ওয়ার্কার, আমার সুপারভাইজারকে দেখলাম। বলতে লাগলাম ঊর্মীকে ফোন দিতে। টেনে নিলাম আমার ফোন। ঊর্মী আমি এক্সিডেন্ট করেছি। ঊর্মী আমার অমন কথা শুনে ভেবেছিলো তেমন কিছু না। ঊর্মী ওর মেয়ে কাঁকন মামনিকে নিয়ে হ্যামিল্টন জেনারেল হাসপাতালে এলো। ঊর্মীকে নিয়ে যখন আইসিইউ-এর দিকে যাচ্ছিলো ডাক্তার, তখন ও বুঝলো কতোটা সিরিয়াস। ওকে দেখেই জড়িয়ে ধরে বললাম, “বাপি-মামনিকে কে দেখবে রে ঊর্মী?” ও বললো, “আমি যা খাবো ওরাও তাই খাবে। জেঠু-জেঠিমনির জন্য একটুও চিন্তা করিস না।” বালিশে রক্ত, ঊর্মীকে বলছি এই এতো রক্ত মাথা কেটেছে? ৬টা সেলাই দেয়ার আগে প্রশ্ন করলো, এনেস্থেসিয়া দিয়ে করলে তারপর ডাবল ব্যথা হবে। বললাম এনেস্থেসিয়া ছাড়াই করো। তারপর তো আস্তে আস্তে এই আমি আজ এখানে। ফিজিওথ্যারাপিষ্ট স্যু-এর কাছে কৃতজ্ঞ অনেক সাহায্য করেছে। এই যে ওয়াকার নিয়ে হাঁটছি, তারই সৌজন্যে।

এবারে আসি এক্সিডেন্টে আমার কিচ্ছু হারায়নি। ব্যাগে টাকা, কার্ড কতোকিছু ছিলো। কিভাবে যে নিজের চিকিৎসা হলো, কোথা থেকে টাকা এলো আমি জানিনা। ওহ আরেকটা কথা এখনও পুরোপুরি সুস্থ হইনি। সময় লাগবে ২/৩ মাস। কড়া ডোজের ঔষধ খেয়ে ঘুম ঘুম চোখে ল্যাপু অন করেছি। বলেছিলাম যেদিন ল্যাপু পাবো, সেদিন সোনেলার নীড়ে আসবোই। সব বন্ধুদের অফুরান ভালোবাসা, তা নইলে ফিরে আসার কথা ছিলোনা। সকলেই অবাক হয়েছে ওভাবে কেউ বাঁচেনা। হয় কোমায় চলে যায়, নয়তো প্যারালাইসড। যাক এই এক্সিডেন্টে মানুষ চিনলাম। সিবিআই অফিস থেকে বিশাল বড়ো ফুলের তোড়া, একেবারে উপর মহল থেকে। আমার সুপারভাইজার লিয়া ব্যক্তিগতভাবে কতোবার যে এলো, খবর নিচ্ছে রোজ। আমায় বলেছে চাকরী নিয়ে না ভাবতে। আমায় নাকি অফিস ওয়ার্ক দেবে। আমার কো-অর্ডিনেটর পামেলা কি কান্না! নার্সিং ম্যানেজার মিশেল আমার বাসায় উপস্থিত তাও ফুল-কফি-ম্যাগাজিন নিয়ে। প্রথমে ভেবেছি এসব বুঝি অফিসিয়ালি। পরে জানলাম এসব ব্যক্তিগত। পামেলা আমায় বললো আমি এতো সুইট কেন? এক্সিডেন্টে ডান পায়ের প্যালভিস বোনস ভেঙ্গে আমি ক্লায়েন্টের কাছে নার্স পাঠানোর কথা কিভাবে বললাম? আজ বাসায় এসেছি লিয়ার ফোন সন্ধ্যার সময় নার্স যাবে। এদিকে প্রচুর বন্ধু-বান্ধবের অস্থিরতা। আমি কৃতজ্ঞ আমার সুস্থতার জন্যে সকলের প্রার্থনায় যে ছিলাম। এতো ভালোবাসা কোথায় রাখি?  নাহ আর পারছিনা লিখতে। অনেক ছবি আছে, একদিন দেবো। আজ এটুকুই থাক। কয়েকদিন আগের লেখা কয়েকটি লাইন,

আমি তোর বালিয়াড়ির নীল;
ঢেউয়ের জলে
নিশ্চিহ্ন করে একেবারে মুঁছে দেয়া নামের আখর।
আমি তোর সোঁদা মাটির কাছে লেপ্টে থাকা খরস্রোতা নদী
সেই নদীর বুকে ধাক্কা খেয়ে এক কোণায় পড়ে থাকা নুড়ি-পাথর।
আমি সেই নারী যার প্রত্যাখ্যানে তুই বিষ হয়ে উঠিস,
আদরে আহ্লাদী।
আর কি বলবো বল!
আমি সেই ত্রেতা যুগের সীতা, দ্বাপরের রাধিকা ছিলাম।
আর এ সময়ের বিশাল বড়ো বিপ্লবী এক আখ্যান,
যাকে পাওয়া যায় শুধুই মানুষ হিসেবে।
শুধুই নারী, উহু, নাহ!

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ ইং।

৬৯৫জন ৬৯১জন
0 Shares

৪৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ