ওই যে যেখানে নি:শব্দ শুয়ে আছে, তার ঠিক একটু সামনে এগিয়ে একটা গলি। সেই গলি পেরিয়ে সামনে এগোলে ডান দিকে পড়বে বড়ো রাস্তা। সেই রাস্তার ধার ঘেঁষেই একটা সবুজ লেক। ঠিক ওখানেই আজ অভিজাত কোলাহলের উৎসব। হুম কোলাহল কোনো মানুষের নাম নয়, আমার নাম। আমি কে? সেই পরিচয় দিতে গেলে যে কাহিনী সংক্ষিপ্ত থাকবে না। আর আমি চাইওনা আমাকে নিয়ে আরও কোনো কোলাহল হোক। যাক সেসব কথা! ওই যে দিনের বেলাতেও মেঘলা আকাশ কেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে! আর এই ফায়ারওয়ার্কসের শব্দে নি:শব্দের বিরক্তি প্রকাশ। নাহ পারছে চোখ বুজে ভাবতে, না ঘুমোতে। নিঃশব্দ আমার একমাত্র শত্রু। ওকে দেখলেই আমার অসহ্য লাগে। ওর কাছে বিষণ্ণতা থাকে, তাই ঘেণ্ণা করি।

ওসব কথা থাক! ওই যে ওদিকে রঙিন পানীয় হাতে নরনারী; কয়লায় পুড়ছে মাংস, সুস্বাদু খাদ্য গ্রহণের অপেক্ষায় লোলুপ জিহ্বা। এটা কিন্তু বারবিকিউ উৎসব নয়, তার পাশেই হট ডগেরও ভ্যান। আজ এখানে খাবারের মিছিল চলছে যেনো। আমার মধ্যে গান বেজে চলছে। বিভিন্ন ধরণের গান। গানের জন্য কোনো পাসপোর্ট-ভিসার প্রয়োজন পড়েনা, তাই সমস্ত পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের সুরে ভরে আছে আমার প্রাঙ্গণ। আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলে শোনা যাবে “মেলায় যাই রে!” আমি এমনই এক কোলাহল, যার কোনো দেশ নেই, সংস্কৃতি নিয়ে ভাববার জন্য কোনো নিউরণ নেই।

দেখে যাচ্ছি, আজকের উৎসব পহেলা বৈশাখকে নিয়ে। আরেকটু সরে এগিয়ে গেলে পান্তা-ইলিশ বাঙ্গালীর ঐতিহ্য। কবে থেকে কে জানে পান্তার সাথে ইলিশের বন্ধন হলো! কাঁচা লঙ্কা, লবণ, চা-মুড়ি, ছোলা, চানাচুর, ফুচকাও রাখা আছে। আভিজাত্যপূর্ণ ডলারের জাতে উঠেছে এরা। আঙুল, হাতের তালু সব ঢাকা গ্লাভসে। নাক সিটকানোর কোনো কিছুই নেই। ধুলো-বালি নেই, মাছিদের উড়াল নেই। একা একা আমি হাসি, দেখি! কোলাহলের কাজই হলো নিঃশব্দে দেখে যাওয়া। বোমা মারলেও দেখি, সাম্বা নৃত্যও দেখি। কে যায়, কে আসে, কে কি বলে, কে চুপ করে থাকে ওসব নিয়ে ভাবার মতো আমার মেধা নেই যে!

সাদা-লাল পোষাক পরিহিত নারী ভরে আছে চারপাশ, মাথার উপর অবশ্য ইরানী পরিচ্ছদ। পুরুষদের দেখছি পাঞ্জাবি-প্যান্ট। একদিন অন্য আরেক উৎসবে কেউ একজন বলে উঠলো নারীদের উপরই বর্তায় ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধারণ করা। আমি কোলাহল, চুপ করে সবকিছুই শুনি, বলতে কিছু পারিনা। আসলে হঠাৎ করে এলে বোঝাই যাবেনা বৈশাখী নাকি ইরানী কোনো উৎসব! পঞ্চাশ শতকের এক দম্পতি লাঠিতে ভর দিয়ে এসে চারিদিক চেয়ে দেখছেন। ভদ্রলোক দাড়িতে হাত বুলিয়ে বলছেন, “পহেলা বৈশাখে ইরানী নারীরাও দেখি শাড়ী পড়েছে! বাহ বাহ দেশীয় ঐতিহ্য সারা পৃথিবী জুড়ে, বেশ বেশ!” সাথে সাথে কে একজন বলে উঠলো, “ও দাদু কি বলছেন ওরা ইরানী নয়, বাঙ্গালী।” বয়ষ্ক ওই দম্পতি ম্লান হাসলেন, ভদ্রমহিলা বললেন, “যুদ্ধ করে কি এনেছি আমরা, স্বাধীনতা নাকি ধর্মের মাধ্যমে জাতিবিদ্বেষ?” ভদ্রলোক নিশ্চুপ। কিন্তু আরেকজন বলে উঠলেন, “আজ নাকি পহেলা বৈশাখ, আসলে তো এটা বিধর্মীদের উৎসব।” তর্ক শুরু হলো। চলছে তো চলছেই।

এতো কিছুতেও উৎসব থেমে থাকেনি, আমিও না। আমার নাম কোলাহল। কোথাও ভীড় হলেই আমাকে থাকতে হয়। মন্দির, মসজিদ, গির্জা, প্যাগোডা, কবরস্থান কিংবা শ্মশান, হাসপাতালে জন্ম কিংবা মৃত্যুতে, বোমার শব্দে, চিৎকারে, কান্নায়, হাসিতে সবকিছুতে আমাকে থাকতেই হয়। আমার যে কোনো ধর্ম নেই।

 হ্যামিল্টন, কানাডা
২৮ মার্চ, ২০১৭ ইং।
৬৯৫জন ৬৯৫জন
0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ