আফঘানিস্তানের ঘটনায় আমরা কেউ স্তম্ভিত, কেউবা হতাশ । কেউ বা ভাবছি , যাক ভাই আমাদের এখানে বোধকরি এমনটা হয় না ।না ,এমন ধারনা মটেও সঠিক নয় । হয়, আমাদের এখানেও হয় ; লজ্জা আর সামাজিক হেনস্থা , উপরন্তু ধিক্কৃত জীবনের কথা ভেবে মেয়েটি অথবা তার পরিবার সব গোপন করে যায় ।দেশ জাতি কাল ভেদে সারা বিশ্বে এক শ্রেণীর পুরুষের কাছে মেয়েরা বা মহিলাদের আভিধানিক পরিচয় হল “মেয়ে মানুষ”।
আমি তখন বেশ ছোট , কিশোরী । বেশ স্পষ্ট মনে আছে ঘটনাটি । তৎকালীন ইত্তেফাক এবং সংবাদ নামক পত্রিকায় খবর হয়েছিল । সত্তুর উরধ দাদার পাশবিক লালসার স্বীকার হয়ে মাত্র বার বছরের নিজ নাতনী গর্ভবতী । ঘটনাটি ঘটে ছিল নীলফামারীর এক গ্রামে। খবরে শুধু এই টুকুই ছিল। খুব সবাভাবিকভাবেই বলা যায় , এর কোন বিচারিক প্রক্রিয়া হয়নি। হলে অবশ্যই দৃষ্টান্ত হয়ে প্রচার পেত। ধারনা করা যায় , মেয়েটির অবশ্যই গর্ভপাত ঘটানো হয়েছিল আর না হলে মেয়েটি যে কোন ভাবে মরতে বাধ্য হয়েছিল।
আমি আমার চিকিৎসক জীবনের একটি সত্য ঘটনার কথা লিখছি । আমি তখন ডাক্তার হয়েছি বেশিদিন নয় । দু’তিন বছর; হাস্পাতালে চাকুরীর পর বিকালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি । এক মহিলা একদিন তার মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে এলেন। মেয়েটির বয়স নয়/দশ হবে। মেয়েটির যে সমস্যার কথা মহিলা আমাকে বললেন , শুনে খুউব খটকা লাগলো । কিছু প্রকাশ না করে আমি মেয়েটিকে পরিক্ষা করে দেখার জন্য নির্ধারিত রুগীর কক্ষে নিয়ে গেলাম। নার্সকে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এর পর মেয়েটির সাথে খুব নরম ও মিষ্টি ভাষায় আলাপ করে আসল কথা বললাম । বললাম, তোমার যা হয়েছে তা তোমার হবার কথা নয়, কেননা তুমি ছোট মানুষ এবং তোমার বিয়ে হয়নি । এই রোগ তাদেরই হয় , যারা পুরুষের সাথে খারাপ কিছু করে। এমনিতেই বাচ্চাটি খুব ভিত সন্ত্রস্ত ছিল, আমার কথায় একদম ভেঙ্গে পড়ে নিদারুনভাবে কাঁদতে শুরু করলো । তখন যথাসম্ভব আদর ভালবাসা দিয়ে ওকে নিবৃত করি। মেয়েটি যা বলল, শুনে স্তম্বিত আমি । মেয়েটির আরও দুটো ছোট ভাই আছে, ছোটটি একদম কোলের । একান্নবর্তী পরিবারে ওরা থাকে। বাবা খুব ছোট চাকরী করে , আলাদা থাকার ক্ষমতা নেই । প্রায় প্রতিদিন সংসারে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে এবং প্রায় দিনই ওর মায়ের কপালে পেটপুরে ভাত জোটে না । এমতাবস্থায় ওর বাবার অবিবাহিত এক ছোট ভাই, সংসারে যার দারুন দাপট ; প্রায়ই প্রতি দুতিনদিন অন্তর ওকে বাড়ীর ছাঁদে চিলে কোঠায় নিয়ে এই পাশবিক অত্যাচার করে। প্রথম করে যখন ওর ছোট ভাইটি হবার জন্য ওর মা হাসপাতালে ভর্তি ছিল । প্রথমদিন ওর খুউব কস্ট হয়েছিল, রক্ত পড়েছিল অনেক জ্বর এসেছিল। চাচা তখন ভাতিজির যত্ন আত্তি করছে এমনভাবে ওকে নিজের ঘরে রেখেছিল । এরপর হতে নিয়মিত এই অত্যাচার চলে আসছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবামাকে কেন বলনি, কেন চিৎকার করনি । ঊত্তর ছিল, আমাকে বলেছে তাহলে মাকে আর খেতে দেবেনা আর আমার ভাইকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে।
জানিনা , আমার পাঠক/পাঠিকারা কি বলবেন । চাচা কি বাবার চেয়ে কম? তাহলে কি আমরা সিদ্ধান্ত নেবে বাচ্চাদের আর চাচামামার কোলে দেয়া যাবে না।
জানি জানতে চাইবেন আমি কি করেছিলাম সেদিন । আমি ওর মাকে ডেকে তার সামনে মেয়েটিকে পরীক্ষা করি এবং সব দেখিয়ে দেই। তাকে সব বলি এবং তার স্বামীকে আমার কাছে নিয়ে আসতে বলি। মহিলা অল্পশিক্ষিত হলেও মেধাবী ছিলেন।খানিকটা কাদলেন খুব , তারপর শান্ত হলেন। পরদিন স্বামী ও কন্যাসহ এলেন। আমি সবিস্তারে সব বুঝিয়ে বললাম। পরে জানলাম বাবা খুব কস্ট করে একটা ছোট বাসা ভাড়া করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। এরপরও আমাকে বেশ কিছুদিন , মেয়েটির চিকিৎসা করতে হয়েছিল ।
এখন কথা হল , আমি না হয় মেয়েটির শারীরিক চিকিৎসা করেছিলাম, কিন্তু ওর যে উন্নত মানসিক চিকিৎসার দরকার সেটা কে বা কেমন করে করবে ? কি হবে এই অবোধ শিশুর ভবিষ্যৎ ।
প্রথম পর্বঃ ও আমার বাবার সন্তান –১
চলবে…………………………………………।।
২৪টি মন্তব্য
অনিকেত নন্দিনী
কিছু বলার ভাষা নেই আপু। 🙁
পারভীন সুলতানা
জানি ভীষণ কস্ট হয়। লিখলাম আপনাদের মাঝে যদি একটু সচেতনা বাড়ে।
খেয়ালী মেয়ে
এই নিউজগুলো ভালো লাগে না, সত্যি ভালো লাগে না………..খুব কষ্ট হয় প্রতিটা অসহায় মেয়ের জন্য…………..
পারভীন সুলতানা
আপ্নার কি মনে হয়, আমরা নিজেরাও কি একটা অধ্যায় এমন শঙ্কায় পার করিনি। হতে পারে তার পটভুমি ভিন্ন ছিল । মেয়েরা কখনই নিরাপদ নয়।
সিকদার
ভাষা নেই।
পারভীন সুলতানা
কেন ভাষা থাকবে না। আপনারাত আমাদেরই কারো না কারো সবামী, ছেলে, ভাই, পিতা , চাচা কিংবা মামা ইত্যাদি ইত্যাদি । আপনাদেরকে যথাযথ সম্মান করে আমরা আপনাদের কাছে নিরাপদে বাচতে চাই। আপনারা আওয়াজ তুলুন।
লীলাবতী
” দেশ জাতি কাল ভেদে সারা বিশ্বে এক শ্রেণীর পুরুষের কাছে মেয়েরা বা মহিলাদের আভিধানিক পরিচয় হল “মেয়ে মানুষ”। সত্যি বলেছেন আপু।এমনি ভাবে নিগৃহীত হবার কাহিনী প্রায় সব মেয়েরই আছে।কিন্তু সামাজিক অবস্থার চাপে মেয়েরা এসব নির্যাতনকে চেপে যায়।মানসিক ভাবে দুর্বলতার বীজ ছোট বেলায়ই বপিত হয় তার মাঝে।
পারভীন সুলতানা
একদম সত্যি বলেছেন । আপনাদের সহযোগিতা আশা করছি , আরও কিছু লিখতে চাচ্ছি।
জিসান শা ইকরাম
মেয়েদের অনেক অধিকার দেয়া হয়েছে বলে যতই আমরা আত্মপ্রসাদ লাভ করিনা কেন,
মেয়েদের আমরা মানুষ বলেই গন্য করিনা।
এ লজ্জা আমাদের সকল পুরুষদের।
পারভীন সুলতানা
খুব কম পুরুষের মাঝেই এই উপলব্ধি আছে । ধন্যবাদ জিসান।
ছাইরাছ হেলাল
এমন অনেক কঠিন বাস্তবতার আমাদের জানার আড়ালে লুকিয়ে থাকে, প্রকৃত মুক্তির রেখা সুদূরে ই মনে হচ্ছে।
খুব ভাল করেই তুলে ধরেছেন।
পারভীন সুলতানা
কেন যেন মনে হল নিজের অভিজ্ঞতার কথাই লিখি। ডাক্তার হওয়ার সুবাদে যা দেখেছি, শুনেছি তাই বা কম কিসের?
নীলাঞ্জনা নীলা
আমি বাসে বসে বসে পড়ি, তখন মন্তব্য করতে পারিনা। লেখাটা পড়ে মন ভিঁজে গেলো, কিন্তু চোখের জল ঝরে পড়লোনা।
পারভীন সুলতানা
জল কেন পড়েনি, জানেন কি ? আমি জানি । কারণ আপনি অনন্তর জানেন সত্য আরও নির্মম ।
ব্লগার সজীব
শিউরে উঠলাম আপু লেখা পড়ে। ৯-১০ বছরের মেয়ে কতটুকু আর! ক্লাস ফোর এ পড়তে পারে।এটুকু মেয়ের সাথে এমন কিছু করা ভাবাই যায় না আপু।মেয়েরা আসলে খেলার কোন দ্রব্য,যেমন বল,লুডু,দাবা। ইচ্ছে হলেই পুরুষ এসব খেলা খেলবে, খেলার আবার ইচ্ছে অনিচ্ছা কিসের?
পারভীন সুলতানা
একদম ঠিক বলেছেন, আমার মনে আছে এখনো । মেয়েতা তখন ক্লাস ফোরে পড়ত। ঠিক বলেছেন খেলার আবার ইচ্ছে অনিচ্ছে ।
মেহেরী তাজ
আপু লেখা গুলো পড়লে অসুস্থ বোধ করছি। কিন্তু তারপরেও আপনার লেখা চলুক। যা জানা দরকার।
পারভীন সুলতানা
ধন্যবাদ । আমি জানাতে চাই এক্টাই কারণে , যাতে আপ্নারা নিজেদের জীবনে কন্যা সন্তাঙ্কে নিয়ে ভুল না করেন। তাকে শক্তিশালি করেন ।
শুন্য শুন্যালয়
এরকম কতো ঘটনা যে আমাদের অগোচরে ঘটছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। বিকৃতমনাদের উন্নত মানসিক চিকিৎসা যে কিভাবে সম্ভব তাইতো জানিনা আপু। ছোট ছোট মেয়েগুলো খেলনা বয়স থেকেই কি জঘন্য এক পৃথিবীর সম্মুখীন হয় ভাবতেই ঘেন্না হচ্ছে। লিখুন এমন আপু।
পারভীন সুলতানা
আমাদের চারপাশে, আমাদের চোখের সামনেই এমন ঘটনা ঘটছে, আমরা যা দেখিনা। চিকিৎসা বিজ্ঞান পড়তে যেয়ে জেনেছি এদেশে মেয়েদের গায়ে যার প্রথম হাত পড়ে তারা চাচা, কাকা মামা শ্রেনীই বেশি । এর পর আশে প্রেমঘটিত কারণে কাজিন ভাইয়েরা এবং তারপর বোনের স্বামী বা দুলাভাই । অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
মিথুন
কি ভয়ংকর ঘটনা আপু। আপনি আরো লিখুন, যত লিখবেন আমরা ততোটাই শক্ত হবো। রাস্তাঘাটে যখন কোন পুরুষ মেয়েদের স্পর্শ করে, আমরা লজ্জায় এড়িয়ে অন্য পথ ধরি, উচিৎ হচ্ছে ঘুরে অইখানেই ওকে শায়েস্তা করা। এ শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে………
পারভীন সুলতানা
বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা , খুউব ছোটবেলা থেকে মানে ৬/৭ বছর বয়স থেকেই আমি এমন । আমাকে কেউ কিছু বলে , বা গায়ে ধাক্কা দিয়ে সড়ে যেতে পারেনি । এমনও হয়েছে আমি কলার চেপে ধরেছি । হ্যা আমার বাবা আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছিলেন ।
রণবীর
এসব ব্যাপারে আমাদের অভিভাবক দের আগে সচেতন হতে হবে
পারভীন সুলতানা
খুব বেশি করে এদিকে এখন সমাজ সচেতনার দিন এসেছে ।