ও আমার বাবার সন্তান-২

পারভীন সুলতানা ২ জুলাই ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৮:৩৮অপরাহ্ন বিবিধ ২৪ মন্তব্য

আফঘানিস্তানের ঘটনায় আমরা কেউ  স্তম্ভিত, কেউবা হতাশ । কেউ বা ভাবছি , যাক ভাই আমাদের এখানে বোধকরি এমনটা হয় না ।না ,এমন ধারনা মটেও সঠিক নয় ।  হয়, আমাদের এখানেও হয় ; লজ্জা আর সামাজিক হেনস্থা , উপরন্তু ধিক্কৃত জীবনের কথা ভেবে মেয়েটি অথবা তার পরিবার সব গোপন করে যায়  ।দেশ জাতি কাল ভেদে সারা বিশ্বে এক শ্রেণীর পুরুষের কাছে মেয়েরা বা মহিলাদের আভিধানিক পরিচয় হল “মেয়ে মানুষ”।

আমি তখন বেশ ছোট , কিশোরী । বেশ স্পষ্ট মনে আছে ঘটনাটি । তৎকালীন ইত্তেফাক এবং সংবাদ নামক পত্রিকায় খবর হয়েছিল । সত্তুর উরধ দাদার পাশবিক লালসার স্বীকার হয়ে  মাত্র বার বছরের নিজ নাতনী গর্ভবতী । ঘটনাটি ঘটে ছিল নীলফামারীর এক গ্রামে। খবরে শুধু এই টুকুই ছিল। খুব সবাভাবিকভাবেই বলা যায় , এর কোন বিচারিক প্রক্রিয়া হয়নি। হলে অবশ্যই দৃষ্টান্ত হয়ে প্রচার পেত। ধারনা করা যায় , মেয়েটির অবশ্যই গর্ভপাত ঘটানো হয়েছিল আর না হলে মেয়েটি যে কোন ভাবে মরতে বাধ্য হয়েছিল।

আমি আমার চিকিৎসক জীবনের একটি সত্য ঘটনার কথা লিখছি । আমি তখন ডাক্তার হয়েছি বেশিদিন নয় । দু’তিন বছর; হাস্পাতালে চাকুরীর পর বিকালে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করি । এক মহিলা একদিন তার মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে এলেন। মেয়েটির বয়স নয়/দশ হবে। মেয়েটির যে সমস্যার কথা মহিলা আমাকে বললেন , শুনে খুউব খটকা লাগলো । কিছু প্রকাশ না করে আমি মেয়েটিকে পরিক্ষা করে দেখার জন্য নির্ধারিত রুগীর কক্ষে নিয়ে গেলাম। নার্সকে সরিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।  এর পর মেয়েটির সাথে খুব নরম ও মিষ্টি ভাষায় আলাপ করে আসল কথা বললাম । বললাম, তোমার যা হয়েছে তা তোমার হবার কথা নয়, কেননা তুমি ছোট মানুষ এবং তোমার বিয়ে হয়নি । এই রোগ তাদেরই হয় , যারা পুরুষের সাথে খারাপ কিছু করে। এমনিতেই বাচ্চাটি খুব ভিত সন্ত্রস্ত ছিল, আমার কথায় একদম ভেঙ্গে পড়ে নিদারুনভাবে কাঁদতে শুরু করলো । তখন যথাসম্ভব আদর ভালবাসা দিয়ে ওকে নিবৃত করি। মেয়েটি যা বলল, শুনে স্তম্বিত আমি । মেয়েটির  আরও দুটো ছোট ভাই আছে, ছোটটি  একদম কোলের । একান্নবর্তী পরিবারে ওরা থাকে। বাবা খুব ছোট চাকরী করে , আলাদা থাকার ক্ষমতা নেই । প্রায় প্রতিদিন সংসারে ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকে এবং প্রায় দিনই ওর মায়ের কপালে পেটপুরে ভাত জোটে না । এমতাবস্থায় ওর বাবার অবিবাহিত এক ছোট ভাই, সংসারে যার দারুন দাপট ; প্রায়ই প্রতি দুতিনদিন অন্তর ওকে বাড়ীর ছাঁদে চিলে কোঠায় নিয়ে এই পাশবিক অত্যাচার করে। প্রথম করে যখন ওর ছোট ভাইটি হবার জন্য ওর মা হাসপাতালে ভর্তি ছিল । প্রথমদিন ওর খুউব কস্ট হয়েছিল, রক্ত পড়েছিল অনেক জ্বর এসেছিল। চাচা তখন ভাতিজির যত্ন আত্তি করছে এমনভাবে ওকে নিজের ঘরে রেখেছিল । এরপর হতে নিয়মিত এই অত্যাচার চলে আসছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাবামাকে কেন বলনি, কেন চিৎকার করনি । ঊত্তর ছিল, আমাকে বলেছে তাহলে মাকে আর খেতে দেবেনা আর আমার ভাইকে ছাদ থেকে ফেলে দেবে।

জানিনা , আমার পাঠক/পাঠিকারা কি বলবেন । চাচা কি বাবার চেয়ে কম? তাহলে কি আমরা সিদ্ধান্ত নেবে বাচ্চাদের আর  চাচামামার কোলে দেয়া যাবে না।

জানি জানতে চাইবেন আমি কি করেছিলাম সেদিন । আমি ওর মাকে ডেকে তার সামনে মেয়েটিকে পরীক্ষা করি এবং সব দেখিয়ে দেই। তাকে সব বলি এবং তার স্বামীকে আমার কাছে নিয়ে আসতে বলি। মহিলা অল্পশিক্ষিত হলেও মেধাবী ছিলেন।খানিকটা  কাদলেন খুব , তারপর শান্ত হলেন। পরদিন স্বামী ও কন্যাসহ এলেন। আমি সবিস্তারে সব বুঝিয়ে বললাম। পরে জানলাম বাবা খুব কস্ট করে একটা ছোট বাসা ভাড়া করে স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন। এরপরও আমাকে বেশ কিছুদিন , মেয়েটির চিকিৎসা  করতে হয়েছিল ।

এখন কথা হল , আমি না হয় মেয়েটির শারীরিক চিকিৎসা করেছিলাম, কিন্তু ওর যে উন্নত মানসিক চিকিৎসার  দরকার সেটা কে বা কেমন করে করবে ? কি হবে এই অবোধ শিশুর ভবিষ্যৎ ।

প্রথম পর্বঃ ও আমার বাবার সন্তান –১

চলবে…………………………………………।।

৫৪৮জন ৫৪৮জন
0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ