অতনু আজ খানিকটা বিব্রত এবং অন্যমনস্ক । যে কাজেই হাত দিচ্ছে ভুল হয়ে যাচ্ছে । বুঝতে পারছে ঝড় বইছে মনের গহীনে ,ঝড়ের প্রকোপ সব এলোমেলো করে দিচ্ছে । নিজেকে সংযত করতে অনেক চেষ্টা করছে, ভেবেছে এমনটি হতে দেয়া যায় না । এমনটা হওয়া উচিত নয় ।সমাজ সংসার এমন কি নিজের বিবেক পর্যন্ত বাধা দিচ্ছে অনবরত । কিন্তু পারছে কই ? কিছুতেই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারছে না । কেন পারছে না ? কি বিচিত্র মানুষের মন জগত আর তার চরিত্র ! সারাজীবন একটি সুশৃঙ্খল নিয়মকানুনের মধ্যে চলা , একেবারেই আগপাশ আপাদমস্তক ভদ্রলোক অতনু হটাত নিয়ম ভেঙ্গে ফেলল কেন? কেন এমন হল ? অনেক আতিপাতি করেও উত্তর খুজে পায় না । তাহলে কি মনের গহীনে কোথাও একটা জায়গা ছিল নিজের মত করে ? যেখানে সংগোপনে একান্ত চাওয়া পাওয়ার একটা ইচ্ছে আত্ম গোপন করে ছিল । আজ এই মধ্য সত্তুরে অতনু দেখতে পায় সেই যুবকটিকে , যে স্বপ্ন দেখত নিজের জন্য । একটা ছোট্ট স্বপ্ন । কিন্তু না সেই স্বপ্নটা শুধু তরুণ গাছ হয়ে দাড়িয়ে ছিল, ডালপালা না মেলতেই উবে যায় । কেননা বাড়ীর বড় সন্তান, আদর্শ পিতার আদর্শ সন্তান । বাবার ইচ্ছেটা সেদিন অনেক বড় ছিল , বাবাকে সম্মান দেয়াটাই ছিল ঐ জীবনের পরম প্রাপ্তি ।
বয়সের এই প্রান্তে এসে অন্য কিছু ভাবার কথা নয় । তারপরও মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবে । কেননা মানুষের দেহটার বয়স বাড়ে, মনটার নয় । এমন একজনও মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না যে অন্তরে তরুন নয়, যদিও ক্রম বর্ধমান বয়সটাকে সবাই স্বীকার করে নেয় । শেফালী গাছ, ভালই বেড়ে উঠে, একসময় কান্ডের বেষ্টনী জড়িয়ে মোটা বাকলের আস্তর পড়ে । অথচ তার পরেও এই বাঁকলের নিচেই কিন্তু নরম কান্ডের উপস্থিতি। অতনুর শেফালী তেমনি একজন। আর অতনু শেফালীর মালী, যত্নকারি । আজ অতনুর অবস্থাও এমন, অনন্তর একটা সলিল প্রস্রবণ আর ঝির ঝির বাতাস বইছে মৃদুমন্দ ।সুঠাম কঠিন মানব অতনুকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে , অথচ আজতক অতনু কখনো দেখেনি নন্দিতাকে । খুব ইচ্ছে করে অবশ্য , কেমন দেখতে নন্দিতা ? কখনো মুখ খুলে লেখেনি নন্দিতাকে, কি বিশ্রী ভাববে এই ভেবে। হয়ত ভাববে দেখ, কি নোংরা লোক ! সাতকাল গিয়ে এক কালে গিয়ে ঠেকেছে এই লোক কি ভাবে নিজেকে । কিন্তু প্রকৃত অতনু তা নয় , নয় বলেই আজ এই অন্তঃদহ ।
অনন্ত যুবক অতনু। বন্ধুবান্ধব আত্মীয় পরিজনেরা হিংসে করে ওর আঙ্গিক চেহারা দেখে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে বাইরের ঝড় বৃষ্টি তাপ বোঝা যায় না , সে জন্য বাইরে যেতে হয় , সমান তালে ঝর জলে নামতে হয় । একসময় বিদেশে চাকুরীকালে সহকর্মীরা নাম দিয়েছিল “টুথলেস বুলডগ” । উন্নত ও পশ্চিমা দেশগুলোতে চারিদিকে মহিলা সহকর্মীদের ছড়াছড়ি । অনেকেই চায় , কাজের মাঝে একটু বন্ধুত্ব হউক, একটু খুনসুটি করে সময় পার করা । বিশেষ প্রয়োজনে অতনুকে পাওয়া সম্ভব হত না । এই জন্যই ঐ সমাজের সে ছিল “টুথলেস বুলডগ”। আদর্শ আর পারিবারিক শিক্ষা ওর রুচিবোধকে নিয়ে গিয়েছিল অন্য উচ্চতায় , অতনুকে টেনে নামায় সাধ্যি কার, দাগহীন অতনু , সর্বশ্রেষ্ঠ।
অতনু আর্কিটেক্ট, সেই কবে পাশ করেছে মেধার শীর্ষে নামটি নিয়ে । দেশে মাত্র কয়েকটি বছর কাজ করা । তারপর সুযোগ পেয়েই সেই তখনকার দিনের বিলেত চলে যাওয়া । সেখানে আবার পড়াশুনা, উচ্চতর ডিগ্রী আর পেশার সুন্দর শুরুটা সেখানেই । এক ফাঁকে বিয়ে করা । বিয়ের অবসর হয়নি, নাকি এক গোপন অভিমান ! কেন যে একটু দেরি করিয়ে দিল পাগড়ী মাথায় দিতে, নিজেই বোঝে না অতনু । হয়তবা এক তীব্র অভিমান অনীহা এনে দিয়েছিল অভিমানি অতনুর মনে । কেউ কখনো জানে নি , জানতেও পারেনি অতনু কি চায়, কি চেয়েছিল ! মায়ের লক্ষ্মী ছেলে, বাবার আদর্শের ধ্বজাধারী অতনু নিজেকে উৎসর্গ করেছিল সবটুকু দিয়ে। মাঝ তিরিশে একদিনের কথায় মাকে খুশি করতেই বিয়ে করে শেফালীকে । শেফালী ফুলের মতই শিশির স্নিগ্ধ সজীবতা নিয়ে সে এল ওর জীবনে । জীবনটা যেন কানায় কানায় ভরে উঠছিল। ভালোবাসা ? ভালো কি বেসেছিল শেফালীকে ? আজ বার বার নিজেকে প্রশ্ন করে ? কি সম্পর্ক আজতক টিকে আছে ওদের মাঝে ? জানেনা অতনু, এটা ভালবাসা নাকি কাউকে আপন করে পাওয়া । আন্তরিক এক বন্ধুর মত তার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়া । শেফালী, শেফালীর মতই কোমল আর স্নিগ্ধতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল অতনুর অভমানী স্বত্বাটিকে। বুদ্ধিমতী শেফালী আচার আচরণে পুরোটা অধিকার করে নেয় অতনুর । দুটো বাচ্চা আসে ওদের সংসারে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে । মেয়েটা বিয়ে হয়ে গেছে , ওদের কাছাকাছি নিজ সংসারে বেশ আছে । ছেলেটা আমেরিকায়। পিএইচডি করছে, শুনেছে একটা সাদা চামড়ার অ্যামেরিকান মেয়ে বন্ধু আছে ওর। ছেলের মায়ের কাছে শোনা । সাধারণতঃ বাঙালী সংস্কৃতিতে মায়ের সাথে ছেলের সম্পর্কটা খুব ঘনিস্ট হয়ে থাকে । তার মানে এই না বাবার সাথে সম্পর্ক খারাপ। বরং বলা যায় , বাবা হচ্চে ছেলের জগত আর মা ঘটিতে তোলা জল ।
মল্লিকা , মল্লিকা হারিয়ে গেল চিরতরে । আজতক এমনি ভেবেছিল অতনু । প্রায় সমবয়সী মল্লিকা মেডিক্যালে পড়ত । ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির সামনের রাস্তা ধরে নিত্য যাতায়াতে একে অন্যকে চিনে নিয়েছিল । আর্কিটেক্ট অতনু , মনের গহীনে এক সুপ্ত ইচ্ছে লুকিয়ে রেখেছিল যেমনটা অনেকেই করে ; কেমন হবে তার প্রিয় মানুষটি । আসা যাওয়ার পথে চোখে চোখ পড়েছিল, চিনে নিয়েছিল তাকে; এইত সেই যে আছে ঘুমিয়ে অন্তরে । তারপর বেশ কাছে চলে এসেছিল দুজন । লম্বা কালো দীর্ঘ চুলের হাল্কা পাতলা মল্লিকার চোখ মুখে এক তীব্র আকর্ষণ ছিল, যা খানিকটা মল্লিকা ফুলের তীব্র গন্ধের মতই উতল করেছিল ওকে।এত ভালো বোধকরি কাউকে বাসা যায় না। ভীষণ ভালবেসেছিল ওকে। ওর সবটা জুড়ে ছিল মল্লিকা আর মল্লিকা । আর্কিটেক্ট ফাইনাল পরিক্ষায় পাশ করে বেড়িয়ে চাকরী ধরতেই বাড়ী থেকে স্বভাবতই আবদার উঠল বিয়ের। এমনি মুহূর্তের জন্য তৈরি ছিল আগেই। আর তাই কোন এক অবসরে মাকে জানিয়েছিল নিজের পছন্দের কথা । বাবার কানে কথাটা পারতেই যা ভাবতেই পারেনি তাই হল। বিস্তারিত শুনলেন বাবা, দ্বিতীয় আর একটি কথাও না বলে শুধু বললেন, ‘আমার কোন আপত্তি নেই , তবে আমার বাসায় আর ও থাকতে পারবে না , অন্য জায়গায় চলে যেতে হব’। কেন এই নিষেধাজ্ঞা , কিসের বাঁধা কিছুই বলেন নি আর। কারো সাহসও হল না দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করে । অতনু বাবাকে ভালই চিনত , ওর ধমনীতে একই স্রোতধারা বইছে । না চাইতেও পিতা পুত্রের মানসিকতায় বিরোধ থাকলেও চারিত্রিক একাত্মতাও কম ছিল না। বুঝেছিল এভাবে নয়, পিতৃস্নেহের দুর্বলতাকেই ওর পক্ষে আনতে হবে । দেখা করে মল্লিকার সাথে । খুলে বলে আদ্যপান্ত সব, অনুরোধ করলো আপাতত বিয়ে নয় , একটু অপেক্ষা করতে। কি হয়েছিল সেদিন কে জানে, গ্রীবা উচিয়ে রাজহংসীর মত একবার তাকাল শুধু মল্লিকা । জানতে চাইলো না একবারও, অতনু কি বলতে চায়, অতনুর ইচ্ছেটা কি ? ধীর শান্ত কন্ঠে বলল , ‘এখানেই শেষ, তোমার আর আমার পথ আলাদা’। রাজহংসী ঘুরে দাঁড়াল , উল্টো পথে হেটে চলে গেল । চিরদিনের শান্ত সৌম্য অতনু স্তব্দ হয়ে গেল , রাজহংসীর চলে যাবার পথে তাকিয়ে রইল শুধু । কেউ জানে না, ঝড় বিধ্বস্ত অতনু ফিরে এল সব খুইয়ে । আর তাই বিয়ে, সংসার অনেক দিন চাপা পড়ে রইল কর্ম জীবনের আড়ালে ।
শেফালী হল অতনুর জীবনের কেন্দবিন্দু । তাকে ঘিরে সংসার, বাচ্চা দুটো । দায়দায়িত্ব এমনকি নিজেকেও সমর্পণ করেছে তার হাতে । আর সেই সংসার এখন ডালপালা মেলে মহীরুহ, নাতি নাতনিরা তার প্রতিনিধি । ভালই ছিল এই সেদিন পর্যন্ত ।কিন্তু গত কয়েক বছরে নিজেকে গুটাতে গুটাতে শামুকে ভরে ফেলেছে কখন জানতেই পারেনি । এক সময় ফিরে দেখেছে বন্ধু পরিবেস্টিত মানুষটি কখন যেন খাঁচায় পোষা ময়না হয়ে গেছে । খাচায় বন্ধী থাকতে থাকতে এক সময়ের বনের ছাড়া পাখি যেমন উড়বার সাহস হারিয়ে ফেলে, পোষা হয়ে যায় । তখন খাচা খুলে দিলেও আর উড়ে যায় না ; অতনুও কি তাই হয়ে যায় নি । নিরাপদ নিশ্চিত সুখি জীবনে গুটি সুটি করে পড়ে আছে অনেক দিন । এমনি হয় বুঝি, নিশ্চিত জীবন নিয়মিত অভ্যাসে মিশে যায় গায়ের লোমের মত। নাহ অতনুর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ হয়ত করা যায় কিন্তু মেনে নেয়া যায় না । কারন ও আসলেই নির্বিরোধী শান্ত ভাল মানুষ একজন।
অতনুর বাইরের অবকাঠামোয় বয়সটা বোঝা যায় না ঠিকই কিন্তু কাগজে কলমে জ্বল জ্বল করে জন্মদিনের তারিখ আর তাই এখন আর নিয়মবাধা চাকরী করা চলে না । কিন্তু কাজ পাগল মানুষটি বসে থাকে কি করে ? কাজ খুজে নেয় নিজের মত করে। বছর খানেক হল একটি অনলাইন পত্রিকার পারমিশন বের করে নিয়েছে । প্রতিমাসে একটা করে সংখ্যা , মানে মাসিক পত্রিকা বের করে। দেশ থেকে অনেক দূরে এই কানাডা নামক বিশাল দেশটির মন্টিল নামে একটি রাজ্যে ওর বসবাস । পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে যেখানেই বাঙ্গালিরা আছে, একে অপরকে বেশ চিনে জানে এবং নিজেদের একটা সমাজ গড়ে তোলে। বিভিন্ন উপলক্ষ্যে ছোটখাট থেকে শুরু করে মেলা বা উৎসব করে মাঝে মধ্যে। এদের মধ্যে অতনু অত্যান্ত শ্রদ্ধাভাজন একজন । কাজেই ওর পত্রিকাটি নিজেদের ছাড়িয়ে, পুরো কানাডায় ছড়িয়ে পরেছে । অতনু তার সমস্ত জানাশুনা বন্ধুবান্ধবদের এর মধ্য জড়িয়ে নিয়েছে । বেশ সুন্দর এই পত্রিকাটি , এক দেশ থেকে পাড়ি দিচ্ছে আরেক দেশে। বুদ্ধিমান অতনু জানে আধুনিক পৃথিবীর জনপ্রিয় জানালা হচ্ছে ফেসবুক। সেখানে নিজের একটা একাউন্ট খুলেছে, যোগাযোগের মাধ্যমটাকে আকাশে ছড়িয়ে দিতে ।যদিও জানে এর ভালমন্দ অনেক কিছুই আছে , আর তাই বন্ধু বাছতে খুবই সচেতন অতনু । লোকে বলে ফেসবুক ছেলেমিপনা, তারুণ্যের ছেলেভুলানো খেলনা, কেউবা বলে নোংরামি করার মাধ্যম । কোনটাই অস্বীকার করে না অতনু , বিজ্ঞানের সব অবদানেরই ভাল খারাপ দুই আছে, যে যেভাবে ব্যাবহার করে। আপনি ভালত জগত ভাল।
অ্যামেরিকা প্রবাসী এক বন্ধুর ওয়ালে হটাত একটা কবিতায় চোখ পড়ল অতনুর। আহামরি কোন লেখা নয় , কিন্তু একটা আলাদা আবেদন রয়েছে যেন। ভাষা আর ছন্দে কবিতার আমেজ, বিষয়বস্তু মন ছুয়ে যায় । ভালই লেগেছিল লেখাটা । পর পর বেশ কটি লেখা চোখে পড়ল অতনুর ।একজন মহিলার লেখা ,বড্ড দরদ দিয়ে লেখা , মনের গহীনে ভীষণ লুকিয়ে থাকা এক কস্ট যেন হীরক দ্যুতি ছড়ায় । মনে হল বেশ রুচিবান হবেন লেখিকা ।কিছুটা ভালোলাগা থেকে কৌতূহল হল মন,এক অবসরে প্রোফাইলটা দেখতে গিয়ে মহিলার ছবিতে আটকে গেল চোখ । মায়াভরা দুচোখ যেন জলে ভরা। কি যেন না বলা কস্ট জমে আছে সেখানে। পেশায় চিকিৎসক , আপাততঃ একটি বেসরকারি হাসপাতালে কর্মরত । বয়স লেখা নেই কিন্তু ছবি দেখে মনে হয় মধ্য পঞ্চাশ থেকে মধ্য ষাটের যে কোন ঘরে । ভাবল একটা অনুরোধ পাঠালে কেমন । সাড়া পেল, অনতি অবসরে ফেসবুক বন্ধু হল ওরা দুজন, নন্দিতা হক আর অতনু আহাদ । চলতি সংখ্যায় একটা লেখা দিতে ইচ্ছে হল খুব , কিন্তু নন্দিতা হকের সম্মতি ছাড়া দেয়া সম্ভব নয় তাই ইনবক্সে মেসেজ পাঠাল , ‘আপনার একটা লেখা ছাপাতে চাই এবারের সংখ্যায় ? উত্তর এল ‘কেন নয়’। ছোট্ট একটা উত্তর অথচ চমকে উঠল অতনু । কি অসম্ভব দৃঢ়তায় নির্ভরতায় বন্ধুত্বের স্বাক্ষর দিল নন্দিতা । অতনু কখন যে ঝুকে পড়ল নন্দিতার লেখা আর প্রতিদিনের স্ট্যাটাসে । নন্দিতা রাজনীতি নিয়ে লেখে, লেখে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, লেখে সহিংসতা এবং অন্যায়ের বিরিদ্ধে । এক সময় মনে হল, প্রকাশনার সাথে ওকে একটু জড়ালে কেমন হয় । প্রস্তাব দিল, পত্রিকাটি অন লাইনে যাবার আগে যদি একবার দেখে দেনত’ খুব ভাল হয় । সানন্দে মেনে নিল নন্দিতা, সুদুর বাংলাদেশে থেকেও কানাডা প্রবাসী অতনুর পাশে এসে দাঁড়াল । এটা সেটায় ভালমন্দ মত বিনিময়ের ফাঁকে উঠে এল নন্দিতার জীবনের করুন ইতিহাস। খুব ভালো লাগতে শুরু করলো, একটা সময় এমন হল প্রতিদিন কথা বলার ইচ্ছেটা তাড়া দিত । টিন এজ বা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের মত আকর্ষণ অনুভব করতে লাগলো অতনু । নন্দিতার সাথে কথা না বললেই নয় , প্রতিদিন কথা বলা চাই । অথচ শিক্ষিত মার্জিত পুরুষ , সভ্যতার আবরণে আপাদমস্তক মোড়া। ইচ্ছের প্রাণ ভোমরা বাক্সবন্ধি , অতল সমুদ্রে ডুবে আছে । কি করে মুখ খোলে , না তা সম্ভব ?
ষাট ছুঁই ছুঁই নন্দিতা এখন জীবনের জোয়াল টেনে বেড়াচ্ছে । সেই কবে জীবনের শুরুতেই, নন্দিতার ভালোবাসার স্বামীটি অজানায় পাড়ি দেন দুটো নাবালক মেয়ে রেখে বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়, সেই থেকে বিধবা নন্দিতা। আজ মেয়েরা পড়াশুনা করে যে যার কর্মক্ষেত্রে , নিজ সংসারে । হ্যা দুজনেই নিজ পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করেছে । বড়টি অস্ট্রেলিয়ায় আছে স্বামী সংসার সন্তান আর পেশা নিয়ে, ছোটটি বাংলাদেশে লেখাপড়া শেষ করে কেবল বিয়ে করে অ্যামেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। কাজেই একেবারে হাতপা ঝাড়া নন্দি্তা এক মুক্ত বিহঙ্গ ।শুধুমাত্র অসুস্থ বৃদ্ধ মা, নন্দিতার একমাত্র দায় এই সংসারে।
অতনু ধরা পরে যায় । ধরা পরে নন্দিতার কাছে , কে জানে নন্দিতার মনে কি ছিল । ওরা যখন এক সময় বন্ধু হয়ে খুব সাবলীল , অথচ ভদ্রতার সীমানা মেনে চলে সযতনে । ভয় পাছে দুজনের কে কখন কি মনে করে ! মুখচোরা অতনু পিছিয়ে থাকে, নন্দিতা এগিয়ে যায় সামনে বলে, এই নাকি সাহস, এত লজ্জা নিয়ে বেচে আছ কি করে ? কিন্তু তবুও নিজেকে প্রকাশ করেনা নন্দিতা । এ যে শুধুই বন্ধুকে ঠাট্টা করা ।
খুব ছোট্ট একটা প্রশ্ন । বাধভাঙ্গা জোয়ারে সর্বনাশা প্লাবন বয়ে যায় যেন। অতনু কাপতে থাকে, ভালো লাগার আবেশে চোখ বুঝে ফেলে , অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে ‘আমি তোমাকে খুউব ভালোবাসি নন্দিতা’।
২৮টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
শরীরের বয়সই বাড়ে মানুষের, আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু আমাদের বাঙ্গালী মন-মানসিকতায় খুব কমই মানে। আর ভালোবাসা শুকিয়ে যায়, কিন্তু আবেগের জলে আবার বেঁচে ওঠে।
ভালো লাগা রেখে গেলাম।
পারভীন সুলতানা
জাত দিয়ে কি আর ভালোবাসাকে শ্রেণীভুক্ত করা যায় ! তেমনি যায় না বয়স দিয়েও । তা ছাড়া নিজেকে দিয়েই বুঝি মনে মনে সবাই রঙিন আমরা । অনেক অনেক ধন্যবাদ।
অনিকেত নন্দিনী
বিশ্বাস করি সবারই মনের গহীনে তরুণ একটা সত্তা লুকিয়ে থাকে। সময়ে অসময়ে সেই সত্তাটা উঁকি দিয়ে যায়। বাঙালি স্বভাবজাত কারণে অন্যের তারুণ্যসুলভ মানসিকতা মেনে নিতে চায়না, নিজের তারুণ্য হারাতে চায়না।
অতনুর মতো মুখচোরা আছে অনেকই। সর্বস্ব উজাড় করে প্রেমে পড়ে অথচ তা মুখে স্বীকার করতেই যতো দ্বিধা। পারিপার্শ্বিকতার কারণে মুখে আগল দিয়ে রাখে।
ভালো লাগা জানিয়ে যাচ্ছি আপু।
পারভীন সুলতানা
একদম থিক বলেছেন। সমাজ আর সংসার এক শক্র শিকল সেখানে, সত্য প্রকাশে বিশাল বাধা । পাশে থাকবেন, আশা রইল।
শুন্য শুন্যালয়
লেখাটা খুব স্পর্শ করলো। মনের ভেতর কোথাও একটা জায়গা থাকে নিজের জন্য, যেটা সংসার দায়দায়িত্বের ভিড়ে হারিয়ে ফেলি আমরা। নিঃসঙ্গ হয়ে যখন সবকিছু আড়াকে চলে যায় তখন নিজেকে খুঁজে দেখার একটু সময় হয় সবার। কেউ বলে কেউ বলেনা। আমি শুধু একটা কথাই মানি, একটাই জীবন আমাদের, একটাই।
অনেক ভালো লেগেছে গল্পটা আপু।
পারভীন সুলতানা
অভিভুত আমি । আমার এই সামান্য চেষ্টা , আপনার কাছে এত আদরণীয় দেখে । চেষ্টা করি মানবিক অনুভুতি নিয়ে লিখতে , বাকিটা আপনাদের প্রেরণা ।
রিমি রুম্মান
সুন্দর একটা লেখা পড়লাম। শুভকামনা জানবেন।
পারভীন সুলতানা
অনেক ধন্যবাদ ।
প্রজন্ম ৭১
খুবই ভাল লেগেছে আপনার গল্প।
পারভীন সুলতানা
অনেক অনেক ভাল লাগলো ।
ছাইরাছ হেলাল
বেশ সুন্দর গুছিয়ে সাবলীল ভাবেই লিখছেন।
বয়স ও ভালোবাসা একান্তই দুজন দুজনার।
পারভীন সুলতানা
তবুও তা অসমাপ্ত থেকে যায় ……………অনুভুতিতেই তারুন্য ফিরে পায়। ধন্যবাদ।
ব্লগার সজীব
ভাল লেখেন আপনি।
পারভীন সুলতানা
পাশে থাকবেন। নিরন্তর চেষ্টা করছি ।
লীলাবতী
‘ বয়সের এই প্রান্তে এসে অন্য কিছু ভাবার কথা নয় । তারপরও মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবে । কেননা মানুষের দেহটার বয়স বাড়ে, মনটার নয় । এমন একজনও মানুষ খুজে পাওয়া যাবে না যে অন্তরে তরুন নয়, যদিও ক্রম বর্ধমান বয়সটাকে সবাই স্বীকার করে নেয় ।’
সঠিক বলেছেন আপু।আপনি অত্যন্ত গুছিয়ে লিখতে পারেন।গল্পে ভাল লাগা জানালাম।
পারভীন সুলতানা
আপনার ভাল লাগায় আমি আনন্দিত।
সীমান্ত উন্মাদ
সাবলিল ভাষায় লিখা গল্পে অনেক অনেক ভালোলাগা।
পারভীন সুলতানা
ধন্যবাদ।
আদিব আদ্নান
যারা বলতে পারে না তাদের কী হবে?? বলতে পারিনি যে।
পারভীন সুলতানা
বলতে পারলেই বা কি ! এই সমাজ সংসারে এমন ভালোবাসার কি পরিচয় দেবেন ? তার থেকে বলতে পারেন নি এমন্টাই ভাল, না হয় রইল সমুদ্রের অতলে বাক্সবন্ধী হয়ে।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
অস্বাভাবিক ভালোলাগা ছুঁয়ে গেলো মনজুড়ে।
ঠিক, বয়স বাড়ে মানুষের শরীরে, মন সবসময়ই তারুন্যে ভরপুর।
আপু, আপনার কবিতার ভক্ত ছিলাম, কিন্তু গল্পটি পড়ে আরো ভালোলাগায় মন ভরে উঠলো।
পারভীন সুলতানা
তুমি আসলে আমিময় হয়ে উঠেছ, তুমি আমার একনিষ্ঠ পাঠক , নমস্য তুমি ।
স্বপ্ন
কত ভালোবাসা এমনি করে অস্ফুট থেকে যায়! গল্প ভালো লেগেছে আপু।
পারভীন সুলতানা
ভয় থাকে সবটা জুড়ে ………………সব কি আর বলতে পেরেছি , না পারা যায় ?
জিসান শা ইকরাম
ভালোবাসা একটি আলাদা আবেগ,একে মেরে ফেলা যায় না।
যাপিত জীবনেও পুরান ভালোবাসা এসে উঁকি দেয়।
ভালো লেগেছে আপনার এখানে দেয়া প্রথম গল্প।
লিখুন আরো।
পারভীন সুলতানা
সীমিত ক্ষমতায় চেষ্টা করে যাচ্ছি । দোয়া করবেন এবং পাশে থাকবেন । আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি ।
মেহেরী তাজ
আপু দুইটা লেখা পড়ে আমার মনে হচ্ছে আপনি বেশি ভালো লেখেন।
গল্প,কবিতা দুটো তেই যে আপনার অগাধ দখল।
লেখা চালিয়ে যান আপু। আমরা সাথেই আছি।
পারভীন সুলতানা
কি বলবো , ভাষা খুজে পাচ্ছি না । অভিভুত আমি ।