
আপনারা যারা প্রায়শই এ রোডে যাতায়াত করে থাকেন তাদের ভালোভাবেই জানার কথা। ফেসবুকেও অনেকবার দেখেছি কিন্তু করোনায় যাওয়া হয়নি বলে বোধগম্য ছিলনা। রংপুর থেকে অনেকেই এসে বলেন। একঘন্টা বিশ মিনিট এর রাস্তা আড়াই ঘণ্টা লাগে যেতে। ড্রাইভার যদি টাইম মেইনটেন করতে চান তাহলে হয় বাস খালে পড়বে, নয়ত আমার মত কোমর ব্যাথা রোগী পনেরদিন ব্যাথায় উঠতে পারবেন না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তিস্তা থেকে রংপুর।
জেমসের সেই বিখ্যাত গানের লাইনের মত অবস্থা করতে করতে যাওয়া- ‘ঝাকানাকা ঝাকানাকা দেহ দোলা না‘।
তারপরও যেতে তো হবেই কি আর করা। বাসের ভেতরে হরেক রকম মানুষ। হকাররাও আছে আমড়া, পেয়ারা এসব বিক্রি করে দিব্যি বাস থেকে নেমে যাচ্ছে। করোনা ফরোনার ভয় লোকজনের কম তারাও কিনে খাচ্ছেন।
মেইল বাসে উঠেছি। দাঁড়িয়ে লোক নেবার নিয়ম নেই। তারপরও বাসের লোকজন দু- চারজন লোক উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিস্তা ব্রিজে নামিয়ে আবার তুলে নেন। বাসের হ্যান্ডেল বড্ড ছোট আর দূর্বল। তাই দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির ধাক্কা খেয়ে একদম সিটে বসা লোকের কোলে পরা ছাড়া উপায় থাকেনা। একবার একজন ঝিমুচ্ছিলেন এমন সময় বিরাট ধাক্কা। ধাক্কা সামলাতে না পেরে হ্যান্ডেল ভেঙে গেলেন লটকে। কোথায় আবার, হেলে পাশের মহিলার গালে তার ঠোঁট গেল চিপকে। অতর্কিত চুমুতে মহিলাও অপ্রস্তুত, লাগালেন কষে এক চড়।
চড় খেয়ে মানুষটির অবাক করা উত্তর-“আরে মারেন ক্যা আমার ঠ্যাকা পরছে আমার বউএর হক আর এতদামি জিনিস আপনারে ফাও দেই। মারলেন যখন ফেরত দেন!”😜😜😜
তিস্তা ব্রিজের টোল দিতে বাস থেমে গেল। কুড়িগ্রাম থেকে রংপুর ও অন্যান্য এলাকায় যেসব বাস যায় সবগুলোই চেক করা হয়। একজন পুলিশ ও একজন চেকার দিয়ে একটা একটা করে ব্যাগ খুলে দেখা হয়। কোনদিন কিছু ধরা পরতে দেখিনা। পরবেই বা ক্যামনে ব্যাগে তো আর নেয়না। তাহলে রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এগুলোতে এত নেশাজাতীয় দ্রব্য, ট্যাবলেট যায় কোনদিক দিয়ে। বিশেষ করে লালবাগ, খামার, রেলগুন্ডির এ এলাকাগুলোতে অহরহ পাওয়া যায়। কুড়িগ্রামেই যেহেতু সব বর্ডার তাহলে নিশ্চয়ই কোননা কোন ভাবে পার হয়। পার হয় আন্ডার ওয়্যার, বোরকা, ব্রা এসবের ভেতর দিয়ে। আর অন্যউপায় যাকে বলে ম্যানেজ করে। দিনে তো লোকদেখানো কাজটুকু করতেই হবে।
আমার দৃষ্টি গেল দাউদ, চুলকানি মলম বিক্রেতার দিকে। নানা রঙে ঢঙে বর্ননায় বেচারা রসিয়ে তুলল। আমি শরীরের দু এক জায়গায় চুলকানি খুঁজলাম কিনবার আশায়। খুঁজে পাওয়া গেলনা তাই কেনাও হলনা। প্রায়ই ভাবি এই ব্যবসা করে তার সংসার কেমন করে চলে। লোকজন তো তেমন কেনেও না।
আমার পাশেই দন্ডায়মান পাজামা-পান্জাবী ছোট ছোট কায়দা করে কাটা দাঁড়িতে শোভিত মানুষটি কিনে ফেললেন। এখানেও আমার ভাবনা হয়, কিছু মানুষ পোশাক ও দাঁড়িকে ব্যবহার করে ফায়দা হাসিল করার জন্য। তো এতক্ষন ভালোই ছিলাম। কারন তিনি পুরো বাসটিই ফাঁকা থাকার পরেও আমার সিটের মাথায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। এমন মানুষ পাশে দাঁড়ালে নিজেকে নিরাপদই মনে হয়। মোটা মানুষের জায়গা লাগে বেশি । ঝাকানাকা হবার সাথে সাথেই তার উরুর সাথে আমার ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা খুব বেশি। দুএকবার হলও তাই। এবার আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। না জানি ঘসাঘসিতে দাউদ/ চুলকানি আমারে ধরে। আর না জানি কোথায় কোথায় চুলকানি হয়েছে!
বহুত চিন্তিত হয়ে, আমি অতি বিনয়ের সাথে তাকে অন্যসিটে হেলান দিতে বললাম। তিনি আমায় যা শোনালেন তাহা অতি সত্য বাণী- “মহিলা মানুষ বাইরে পুরুষের ভীড়ে বের হলে এমন হবে। এভাবে যেতে না পারলে যেন বাড়িতে বসে থাকি, বের না হই। আর আমার পাশের সিটেই তো একজন পুরুষ”। বলাবাহুল্য, এই পুরুষটি একবারও আমার গায়ে এসে পরেনি। পরে জেনেছি সে মেডিকেল স্টুডেন্ট।
এবার ভাড়া দেবার পালা। ত্রিশ টাকার জায়গায় তিনি বিশটাকা দিচ্ছেন। কন্ট্রাক্টর কিছুতেই নিবেনা। লেগে গেল মহা তর্ক। মারামারী হবে তবু তিনি টাকা দেবেন না। এদিকের বাসের এটা চিরাচরিত ঘটনা যা সবসময়ই উপভোগ্য। পান, চা, বিড়ির টাকা হবে কিন্তু ভাড়ার টাকা কম পড়বেই। শেষে ড্রাইভার বললেন, টাকা না দিলে তারে নামিয়ে দিতে। বেশ অর্ধেক খানি পথ আসা হয়েই গেছে। দশটাকার জন্য সেটা গচ্ছা দিয়েই হেলপার, কন্ট্রাক্টর মিলে তাকে প্রায় পাঁজা কোলা করে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। কৌতুহলী সবার সাথে আমিও তাকিয়ে। নেমে যাবার কালে করুন চোখে বেচারা আমার দিকে তাকালো একবার, দুবার, তিনবার। আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। যতই হোক নারী মন তো। পুরুষরা যতই আমাদের সম্মান না করুক। আমরা তারপরও তাদের শ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়ে রাখি। মানুষকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখেছি।
ফাইনাল চাহনী একেবারে জানালা বরাবর। যার অর্থ অক্ষয় কুমারের সেই গানের মত-
“জোর কা ঝাটকা হায় জোরও ছে লাগা
ভাড়া( সাদী) বানগেয়ী উমার কয়েদ কি সাজা”
শেষবার হাসি পেল। আহারে! বেচারা দশটাকা না দিয়ে বিরাট ভুলের অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। আরও কিছুক্ষণ সিটে হেলান দিয়ে আমার গায়ে গা লাগিয়ে যেতে পারত। আজ যা হবার হয়েছে এ ভুল আর জীবনেও তার হবেনা!
আপনাদের দাওয়াত তো দিতেই হবে। তাই আগেভাগেই জানিয়ে রাখলাম রাস্তাঘাটের অবস্থা। আসতে যদি চান দাওয়াতে অবশ্যই বেল্ট কিনে নিতে ভুলবেন না। সবাই ভাল থাকুন। সবাইকে শুভরাত্রি।🌹🌹🌹
২২টি মন্তব্য
জিসান শা ইকরাম
রাস্তার যে অবস্থার বর্ননা দিলেন, তাতে তো যেতে আর সাহস হবে না। আমার প্রচন্ড ব্যাক পেইন।
এই রাস্তায় গেলে শুয়ে থাকতে হবে কয়েকদিন।
বিভিন্ন হকাররা বাসে বিভিন্ন জিনিষপত্র বিক্রয় করে, আপনার মত আমিও ভাবি – বেচা বিক্রি তো তেমন হয়না, এদিয়ে তাদের সংসার কিভাবে চলে?
কিছু বাসযাত্রী এমন থাকে। এরা মনে হয় বাসে ওঠে মহিলাদের টাচ করার জন্যই।
এমন অন্যায় করেছে বলেই তাকে মাঝপথে নেমে শাস্তি পেতে হয়েছে।
ভালো লেগেছে আপনার উপস্থপনা।
শুভ কামনা।
রোকসানা খন্দকার রুকু
হুম সাজা একদম ঠিকঠাক। মজা পেয়েছি আমিও। প্রথম মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা ভাইয়া।
ভালো থাকবেন। শুভ কামনা রইলো।🌹🌹
ফয়জুল মহী
লেখাটি ভালো লাগলো।
রোকসানা খন্দকার রুকু
মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ।
শুভ কামনা রইলো।
শুভ সকাল।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এরা এতোটা অসভ্য হয় কি বলবো ? একেতো মেয়েঘেঁষা তার উপর ভাড়া নিয়ে ছ্যাচরামি দুটোই আমার কাছে ভীষণ অস্বস্তিকর। অনেকের তো বললেও লজ্জা হয়না। এরা মেয়েদের গা ঘেঁষে দাঁড়াবেই, সুপার গ্লুর মতন লেগে থাকে। আপনাকে রম্য লেখক হিসেবে এ্যাওয়ার্ড দেয়া উচিত। আপনার জন্য এক কুয়া হাসির শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। শুভ সকাল
রোকসানা খন্দকার রুকু
এককুয়া হাসির শুভেচ্ছাই তো এওয়ার্ড দিদিভাই। সত্যিই ভীষন অস্বস্তিকর অবস্থা । শুভ কামনা রইলো। শুভ সকাল।😍😍😍
আলমগীর সরকার লিটন
খুব জমার লেখেছেন কবি আপু
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ ভাইয়া॥
শুভ কামনা রইলো। ভালো থাকবেন।
ছাইরাছ হেলাল
ভ্রমণ কাহিনীতে নুতন কেউ সযুক্ত হলে ভালই হয়।
শীতের প্রকোপে রোগ-বালাইয়ের বিস্তারে সাবধানতা খুব ই দরকার, বিশেষ করে বাসে বসে!!
রোকসানা খন্দকার রুকু
লোকাল বাসে মেয়েদের হেনস্তা আর মাদক নিয়ে লিখেছি ভাইয়া।
শুভ কামনা রইলো।🌹🌹
আরজু মুক্তা
একটা সেফটিপিন নিয়ে উঠতে হবে।
হাঁটু ভাঁজ করে বসতে বসতে পা আর সোজা হয় না। এই পয়েন্ট ধরে আর একরা রম্য লিখেন।
শুভকামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
একটাতে কাজ হবেনা। কয়েকটা নিয়ে উঠতে হবে।
ধন্যবাদ ও ভালোবাসা রইল।😍😍
খাদিজাতুল কুবরা
সুপর্ণাদির সাথে আমি ও একমত আপনাকে রম্য লেখায় এওয়ার্ড দেওয়া উচিৎ। ভীষণ সুন্দর লিখেছেন।
হাসতে হাসতে পেট ব্যাথা।
তবে বিষয়বস্তু চরম বাস্তবতা।
ভালো থাকুন। আর সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ে ধন্য হবো আমরা৷
রোকসানা খন্দকার রুকু
রম্য স্টাইলে লিখি আপনি বুঝতে পারেন এটা ভালো লাগে।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ও ভালোবাসা রইল😍😍
তৌহিদ
লালমনিরহাট এবং কুড়িগ্রাম যতবারই গিয়েছি এসব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। একেবারে বাস্তব! রম্য লেখায় সত্যতাকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আপনাকে পুরস্কৃত করা উচিত আসলেই।
শুভকামনা সবসময়।
রোকসানা খন্দকার রুকু
ও হ্যাঁ ভাইয়ার তো অভিঅভিজ্ঞতা থাকার কথা।
রম্য হল জীবন বাঁচাতে। মাইনসের পয়সা খাই চোখ খালি ভয়ে পিটপিট করে। কে কখন খপাত করে ধরে। লিখতে হলে চাকরী ছেড়ে কোমর বাঁধতে পারলে ভালো হতো।
ল টা কমপ্লিট হোক দেখি কি করা যায়।
সুন্দর মন্তব্যে শুভ কামনা ভাই।😍😍
তৌহিদ
শুভকামনা সবসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
দারুণ একটা সাব্জেক্ট নিয়ে রম্য দিয়েছেন। এই লেখায় অল্পস্বল্প কমেন্ট করে মন ভরবে না, একটা আস্ত পোস্ট লেখা লাগবে। ওয়েট, সাথে থাকুন 🙂
রোকসানা খন্দকার রুকু
আল্লায় জানে এ যে কোন “ওয়েট” বুঝতাছি না। শীত কিন্তু বেশিক্ষণ রাখিয়েন না।😍😍
শুভ সকাল।
রেজওয়ানা কবির
হায়রে অতর্কিত চুমু তাও আবার খুব দামী,কেমনে সম্ভব?হাসতে হাসতে পেটে খিল, আর বাকি অভিজ্ঞতাগুলো আমারও।এত বাস্তব অভিজ্ঞতা অনেক সুন্দরভাবে তুলে ধর যা সত্যি অনেক আনন্দ দেয়। ভালো থেক। শুভকামনা ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
এমন অভিজ্ঞতা সবার আছে এটা ঠিকই বলেছ।
শুভ কামনা রইলো আপুনি।😍😍😍
দালান জাহান
কিছু অমানুষ থাকে সবসময়। এদের হাত কেটে দিতে হয়। খুব সুন্দর লিখেছেন
।