মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আকাশ। যেখানে যেখানে ফাঁকা আছে, কালো মেঘের দল দ্রুতগতিতে ছুটে এসে সেসব ফাঁকা জায়গা পূরণ করে দিতে ভীষণই তৎপর। ছোট্ট ডিঙিতে বৈঠা হাতে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে হামেদ তাকিয়েই আছে আকাশের দিকে। হঠাৎই দমকা হাওয়ার প্রবল ঘূর্ণি। রোগা শরীরে ঢিলেঢালা জামা আর পরনের লুঙ্গিখানা যেন উড়ে যাবে। টুকটুকে লাল গামছাটা ঘাড় ছেড়ে উড়াল দিয়েই দিত, যদি না হামেদ খপ করে ধরে ফেলত ওটাকে। কচুরিপানা সরে সরে যাচ্ছে বৈঠার আঘাতে আর ঘূর্ণি হাওয়ায়। বাঁশের মিহি সাঁকোটার নিচ দিয়ে পার হওয়ার সময় একটা ছোট বাঁশ খুলে পড়ায় ডিঙি হঠাৎ দুলে উঠে ঘুরতে লাগল।
হায় আল্লাহ্, কি আপদ যে আছে কপালে!
যতদূর চোখ যায় শুধু কালো আর কালো। একহাতে বৈঠাটা শক্ত করে চেপে ধরে আরেক হাত দিয়ে কপালে ছাউনি বানিয়ে হামেদ তবু বোঝার চেষ্টা করে, যে শোঁ শোঁ আওয়াজ কানে আসছে, সেটার দূরত্ব কতটুকু। ঘরে ফিরতে পারবে তো?
যদিও ঘরে কেউ নেই, তবু ঘর তো! গোলপাতার চাল দেয়া ওই ঘর, টুকরো উঠোন গোবর গুলে সকালেই লেপেছে যত্ন করে। উঠোনের বাঁ-দিকে নতুন কাগজি লেবুর গাছটায় ঝুলে আছে হাজার হাজার লেবু, কয়দিন পরেই রসে ভরে যাবে। আর যত্নে লাগানো ওই কামিনী গাছটা, ওটাও তো ফুলে ভরে গেছে। ধবধবে সাদা ফুল, দেখে চোখের শান্তি।
আর কী সুবাস!
একলা মানুষ হামেদের ওই ফিটফাট একচালা ঘর আর উঠোন দেখে পড়শীরা ঠাট্টা করে বলে,
“যে তোর বউ হবি, তার বিরাট সুভাগ্য। এমন পয়-পরিস্কার সংসারী সোয়ামি কয়জনে পায়?”
তবে বোঝে হামেদ, ওরা মজা করে। ওর মতো আলাভোলা আর মেয়েমানুষের মতো চলন-বলনের মানুষকে নিয়ে মজা করার মজাই আলাদা। এই তো সেদিন, ওর বয়সী মাজেদ, যে কিনা এক পোলার বাপ, ঘরে সুন্দরী বউ, সে মস্করা করে বলল, “খলিল চাচা তার মাইয়ার লগে তোরে বিয়া দিবার চায়, গিয়া কতা ফাইনাল করস না ক্যান?”
হামেদ অবিশ্বাস নিয়ে তবুও ভেবেছিল, খলিল চাচার মেয়ে হাসিনা ভাতারছাড়ি, তায় চরিত্রের দোষ, দিলেও দিতে পারে! যদি সত্যি হয় তো আজেই বিয়া কইরবো। ঘাড়ের গামছায় চোখ-মুখ মুছে গিয়েছিল, কিন্তু করিম চাচা বলে,
“ক্যাডা কইলো?”
আর ওই হাসিনা তেড়ে এসে এই মারে কি সেই মারে! বলে কিনা…
“মাগিমুখা ব্যাটাছাওয়াল, তার আবার শখ কত!”
হায় রে দুনিয়া, সবাই খালি বাইরেটাই দেখে, মনের ভেতরটা কেউ দেখতেই চায় না! বিয়ে বসেই দেখুক না কেউ, কেমন আদর আহ্লাদে রাখে হামেদ!
শোঁ শোঁ আওয়াজটা বিলের একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে। আছড়ে পড়ল কি পড়ল হামেদের ডিঙির ওপর। ঘরের চিন্তা বাদ, আগে তো জানটা বাঁচুক! ঘর উড়ে গেলে আবার বাঁধবে, কিন্তু জান উড়ে গেলে? তড়িঘড়ি বৈঠায় টান দেয় হামেদ, তবে শেষরক্ষা বোধহয় হল না! প্রায় তীরে চলে এসেছে, এমন সময় প্রবল তোড়ে এক দৈত্য যেন আছড়ে পড়ল ডিঙির ওপর। আচমকা আঘাতে ছিটকে উল্টে গেল ডিঙি।
চারপাশ যেন ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গিয়ে তলিয়ে গেল বিলের জলে।
ওলোটপালোট শিমুলতলী। ঘাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিরাটাকার শিমুল গাছটা শেকড়সহ উপড়ে পড়ে আছে। শুধু শিমুলগাছই নয়, এদিক ওদিকের নারকেল, নিম, এমনকি ভাতারছাড়ি হাসিনাসহ আরও অনেকের টিনের চাল, গোয়ালের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিখোঁজ । আর পাতার ছাউনি না-হয় ছনের চাল, কোথায় উড়ে গেছে!
কিন্তু হামেদ কোথায়? তার ডিঙিখানা? বিলের জলে তলিয়ে কি হারিয়েই গেল? কোনও চিহ্ন নেই তো! সবাই নিজেদের বাড়িঘর ভেঙে যাওয়া, উড়ে যাওয়া নিয়ে হাহাকার করছে। নিজের বউ কিংবা সোয়ামি, ছেলে কিংবা মেয়ে, মা আর বাপ ঠিক আছে কিনা তাই নিয়েই ব্যস্ত সবাই। হামেদের তো কেউ নেই, ও ডুবল না ভেসে উঠল, সে খোঁজও নেই কারও। ওর গোলপাতার ছাউনি উড়ে গিয়ে চারটে বাঁশ আর একটা চোকি দাঁড়িয়ে আছে ভিটেয়। কামিনী আর লেবু তছনছ, হাহাকার করার কেউ নেই। শুধু কেউ কেউ বলল, “দূর দূর পয্যন্ত তো কুনু চিহ্ন নাই, ঝড়ের ঝাপটায় উইড়া গ্যাছে বোধহয়! শরীলে কঙ্কাল ছাড়া তো কিছু ছিলও না, না জানি কোনখানে মইরা পইড়া আছে!”
সেই দুপুরবেলায় ঝড়ের পর একটু ফর্সা হয়ে আবার ঢেকে গেছে আকাশ। এখন বিকেল, তবে ঘোর অন্ধকার। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছে। ভেজা দুটো কাক আরও ভিজছে হামেদের উঠোনে বসে। আশেপাশের মানুষগুলোর বুক ভরা ভয়, আবার যদি ঝড় আসে! এই ভয় নিয়েই ওরা খুঁজে চলেছে নিজেদের জিনিসপত্র। একত্র করে আবারও যদি গড়ে তোলা যায়!
কোথাও দু’জন, কোথাও চার-পাঁচজন, কোথাও দশজনের জটলা ভেদ করে হঠাৎই হামেদ হাজির। একা নয়, পরনে ভিজে লেপ্টে থাকা কলাপাতা রঙ শাড়ি পরা এক মেয়েমানুষ৷ যার গায়ের চামড়া এতটাই ফর্সা যেন ওই অন্ধকার বিকেল আলো হয়ে গেল। চুলগুলো কোমর, নিতম্ব ছাড়িয়ে একেবারে হাঁটুর কাছাকাছি এসে সাপের ফনার মতো দুলছে। হামেদ কোনওদিকে না তাকিয়ে মেয়েমানুষটাকে নিয়ে সোজা ভিটেতে। ওখানে যে চাল টাল কিচ্ছু নেই, চারটে বাঁশ-ই কেবল দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে না কোনও বিলাপ না মনখারাপ।
চারটে বাঁশের একটার সঙ্গে কবে থেকে যেন বড় পলিথিন বাঁধা ছিল, সেটা খুলে নিয়ে, এদিক ওদিক থেকে আর দুই একটা বাঁশ টাঁশ জোগাড় করে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলল ঝটপট।
উপস্থিত জনতা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে হতবাক হয়ে। তারা কেউ-ই বোধহয় এতটা অবাক জীবনে হয়নি।
চারমাস আগের ঝড়ের কথাটা হয়তো ভুলেই যেতো শিমুলতলীর লোকজন, কিন্তু হামেদ আর হামেদের সাথে আসা ওই রূপের ডালি মেয়েমানুষটাই ভুলতে দেয়নি। ওদের পলিথিনের ছাউনিতে কেমন করে যেন রূপোলী টিন উঠেছে। ঘরের বেড়া আর মাথার ওপরের চাল সূর্যের তীব্রতায় যেমন ঝলসে যায়, তেমন সূর্য ডুবলে শীতলও হয় তাড়াতাড়ি। রাতের আকাশ জ্যোৎস্না ঢেলে দেয় ছোট্ট জানালায়। ওই জ্যোৎস্নায় ওরা খেলাধূলা করে। বড় মধুর সে খেলা। বিলের অদূরের ওই শিমুলতলীর কেউ কেউ, কখনও কখনও জেগে ওঠে গভীর রাতে। জেগে শুনতে পায় হাসি আর আনন্দ আছড়ে পড়ার শব্দ। মাঝে মাঝে বাতাসে ভাসে সুরেলা কণ্ঠের সুমধুর গান। এমন গান কি ওরা শুনেছিল কোনও কালে? না তো!
হামেদের ঘরে কে ওই রূপসী নারী?
যার আগমনে বদলে গেল হামেদের জীবন, যার ছোঁয়ায় প্রাণ পেল লিকলিকে হামেদের দেহের কঙ্কাল?
তছনছ লেবু আর কামিনী নতুন ফলে ফুলে সেজে ওঠে এত সহজে, সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। অথচ দেখো, কেমন হেসে খেলে নতুন নতুন উপকরণে, রঙে আর রূপে ভরিয়ে তুলেছে ওরা ওদের ভিটেটা!
যারাই রাতের গভীরতায় জেগে ওঠে, জেগে উঠে অবলোকনে বা অনুভবে বুঝতে চেষ্টা করে আর কেমন এক অজানা আশঙ্কায় শিহরিত হয়। হামেদের সাথে আসা ওই রূপসী নারী,
কে সে? সে কী অশরীরী কেউ?
২৩টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
শেষ হয়েও হলোনা শেষ-এটাই মনে হয় ছোট গল্পের মুল বিষয়। চমৎকার শব্দের ব্যাবহার।উপস্থাপনাটা এতোটাই প্রান্তবন্ত ছিলো যে মনে হচ্ছিল ঘটনাগুলো ঘটছে আমারি সামনে।মেয়েটির পরিচয় পেলে জানাইয়েন আপু।
রেহানা বীথি
ও মেয়ের পরিচয় না-হয় গোপন-ই থাক মমি ভাই। সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন সবসময়।
মনির হোসেন মমি
আচ্ছা,তবে আরো এমন সব গল্প পড়তে চাই। শুভ কামনা রইল আপু।
ফয়জুল মহী
অসাধারণ প্রকাশ , সুন্দর হয়েছে লেখাটি
ভালো লাগলো I
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন সবসময়।
আরজু মুক্তা
ঐ হাসিনাই নাকি? যে ফিরিয়ে দিয়ে নতুন করে আবার রাঙিয়ে দিতে এসেছে।
গল্পের শেষটা চমৎকার। মনে থাকবে অনেকদিন।
শুভকামনা
রেহানা বীথি
মনে থাকবে জেনে খুশি হলাম আপু।
ভালো থাকবেন সবসময়। শুভকামনা রইল।
সুপায়ন বড়ুয়া
“যারাই রাতের গভীরতায় জেগে ওঠে, জেগে উঠে অবলোকনে বা অনুভবে বুঝতে চেষ্টা করে আর কেমন এক অজানা আশঙ্কায় শিহরিত হয়। হামেদের সাথে আসা ওই রূপসী নারী,
কে সে? সে কী অশরীরী কেউ?”
সত্যিই তো আপু আমার ও জানতে ইচ্ছে করে
কে সে রূপসী নারী নাকি অশরীরী।
ভাল লাগলো আপু। শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
সে তো এক রহস্য দাদা। রহস্য ভেদ করার ইচ্ছে তো আমাদের সবার। ভালো থাকবেন দাদা।
শুভকামনা রইল।
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার একটা গল্প পড়লাম বীথি আপু
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপু খুব সুন্দর হয়েছে গল্পটি। আসলে কার কিসে অপছন্দ, ভালো লাগা কেউ জানে না । হামেদের সাথেও এমনটা হলো, সে তার মতো সংসার সাজিয়ে নিলো কিন্তু কারো তা পছন্দ হলোনা। শেষপর্যন্ত অন্যভাবে সুখী হলো হামেদ। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা অবিরাম
রেহানা বীথি
অনেক অনেক ভালোবাসা আপু।
ভালো থাকবেন সবসময়।
শুভকামনা রইল।
নাজমুল হুদা
ছোটগল্পের সবগুলো উপাদান যেন এই গল্পটির মাঝে উপস্থিত। সব চেয়ে বড় ইঙ্গিত ভাগ্যকে মানতে হবে।
আজ যে অবহেলিত কাল সে অবহেলিত নাও থাকতে পারে। আর বিশ্লেষণ করলে যদি বলি শারীরিক আকারে একটু অন্যরকম হামেদরা সমাজে আজো বৈষম্যের শিকার। হাসিনা চরিত্রেও একটা সমাজের চিরাচরিত ধারণা আটকে আছে।
আর যেই অচেনা মেয়েটি ঝড়ের পর হামেদ বাড়িতে উঠে এসেছে সে যেন সেই রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবির নায়িকার মতো।
গল্পটি অসাধারণ লেগেছে।
রেহানা বীথি
অনেক খুশি হলাম ভাই।
ভালো থাকবেন সবসময়।
শুভকামনা নিরন্তর।
ছাইরাছ হেলাল
গল্পের শেষ-চমকটি অনবদ্য।
বুঝতেই পারিনি এমন মুন্সিয়ানা নিয়ে শেষ করবেন।
রেহানা বীথি
খুব খুশি হলাম ভাইয়া।
ভালো থাকুন সবসময়।
শুভকামনা রইল।
রোকসানা খন্দকার রুকু
বলবেন না যখন তাই জানতে চাইবনা কে সেই অশরীরি। মাগো মা ভুত নাতো। হলে হোক। সুখের ঢলাঢলিতে ছোট্ট জীবন কাটলেই হল।
জীবন যতই কঠিন হোক, অবজ্ঞার হোক তাকে সুন্দর করে নেবার দায়িত্ব নিজের।
দারুন চমক দিয়ে শেষ হল। শুভ কামনা আপুনি।
রেহানা বীথি
ভূত হলেও হতে পারে আপু। 😃
অনেক অনেক ভালোবাসা।
ভালো থাকবেন সবসময়।
তৌহিদ
অনেকদিন পরে আপনার লেখা অনবদ্য একটি গল্প পড়লাম আপু। বড্ড রহস্যময় অনেক কিছুই আমাদের চারপাশে ঘটে। এটি তেমনি একটি ঘটনা।
আপনার লেখার মুন্সিয়ানার তারিফ না করে পারছিনা কিন্তু। শুভকামনা সবসময়।
রেহানা বীথি
অনেক খুশি হলাম ভাই। ভালো থাকবেন সবসময়। শুভকামনা নিরন্তর।
উর্বশী
পড়তে পড়তে বেশ ভালই লাগলো।আমার তো এরকম রহস্য ময়ী লেখা তো মজার ব্যাপারে পরিণত হয়। আমাদের যাপিত জীবনের আশে পাশে ঘটে যাওয়ার কাহিনীচিত্র তো হর- হামেশা ফুটে ওঠে। তবুও যার যার অবস্থানে পরিপাটি ভাবে জীবন কাটাতে চেষ্টা করে। নৌকাডুবি সিনেমার শেষ দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো গল্পের শেষের দিকে। চমৎকার ভাবে শেষ করেছেন।আরও এমন লেখা চাই বিউটিফুল আপু। অনেক ভালোবাসা রইলো।
রেহানা বীথি
ভালোবাসা জানবেন আপু।
শুভকামনা নিরন্তর।