
আধুনিক বাংলাগানের ইতিহাসে পঞ্চগীতি কবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন। তিনি সঙ্গীত জগতের একজন দিকপাল।
দূর থেকে যখন, ” মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুঃখিনী মা যে তোদের, তার বেশি আর সাধ্য নাই।” এই গানটি যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে হৃদয়ে দোলা জাগিয়ে চোখের জল হয়ে চিকচিক করে; তখন বুঝে যাই, সেই শিল্পীই হচ্ছেন রজনীকান্ত সেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর এই মাসে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।
তিনি ১৮৮৫ সালের ২৬ জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গুরুচ প্রসাদ সেন। তিনি সেকালের সঙ্গীতজ্ঞ গুণী ব্যক্তিত্ব এবং বরিশালের নামকরা সাবজজ ছিলেন। মায়ের নাম ছিলো, মোহিন দেবি। তিনি বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন। ছোটবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। আবার অসম্ভব মেধাবীও ছিলেন।
রজনীকান্ত কুচবিহার জেলার জেনকিন্স স্কুল থেকে ১৮৮৩ সালে এন্ট্রান্স, ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ, এ; ১৮৮৯ সালে কোলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ, এবং ১৮৯৭ সালে বি, এল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে রাজশাহী কোর্টে ওকালতি শুরু করেন।
তাঁর গানচর্চা শুরু হয় পিতার কাছ থেকে, এবং ১৫ বছর বয়সে ” কালী সঙ্গীত “রচনা করে কবিত্ব শক্তির পরিচয় দেন। তাঁর কবিতা ও গানের বিষয়বস্তু প্রধানত: ভক্তি ও দেশপ্রেম। তাঁর ভক্তি সঙ্গীতগুলো ” কান্ত পদাবলী ” নামে পরিচিত। তাঁর প্রথম কাব্য ” গীতিবাণী” প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। তাঁর কল্যাণী (১৯০৫), অভয়া ( ১৯১০), অমৃতনীতি কবিতা (১৯১০), আনন্দময়ী ১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), শেষদান (১৯১৬), সালে প্রকাশিত হয়।
রাজশাহীতে থাকাকালীন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও “ভারতবর্ষ” পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা হয়।
রজনীকান্ত সেন স্বদেশী গান, ভক্তিমূলক গান, ও হাসির গান লিখেছেন অসংখ্য। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রার্থনামূলক একটি বিখ্যাত গান হলো :
তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো
মলিনমন মুছায়ে
তব, পূর্ণ কিরণ দিয়ে যাক
মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”
তাঁর হাসির গানগুলিও চমৎকার ও অসাধারণ। যেমন :
” বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা চাইলা দিছি পায়
তোমার লগে কেমনে পারচম, হৈয়া উঠিছে দায়
আরসি দিচি, কাহই দিচি
গাও মাজনের ছাপান দিচি
আর কি দ্যাওন যায়? ”
আর ছোটবেলার সেই কবিতা! আমার তো মনে হয় সকলের মনে আছে।
” বাবুই পাখিরে ডাকিয়া বলিছে চড়াই
কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।”
অথবা,
“নদী কভু নাহি করে নিজ জল পান
তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল। ”
আবার স্বদেশী গান যেমন :
” নমো নমো জননী বঙ্গ
উত্তর ঐ অভ্রভেদী
অতুল বিপুল গিরি অরণ্য
দক্ষিণে সুবিশাল জলধি
চুম্মে চরণতল নিরবধি
মধ্যে পূত জান্হবীজন
ধৌত শ্যাম ক্ষেত্র সঙ্ঘ।”
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁর ” মায়ের দেয়া মোটা কাপড় ” গানটির মাধ্যমে বোঝা যায়, তিনি কতোটা উদ্দীপিত হয়েছিলেন।
তাঁর রচিত প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক গানের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর গান বাংলা মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদানে সমৃদ্ধ। কীর্তন, বাউল, রামপ্রসাদী, পাঁচমিশালি ইত্যাদি গানের সুর ও ভাবের প্রভাব তাঁর গানে লক্ষণীয়। সঙ্গীতের বিবিধ কারুকাজ তাঁর গানে না থাকলেও ; গানের সহজ সরল ভাবপূর্ণ কথার সঙ্গে নাড়িরটান যুক্ত এবং সুরের আবেদন শ্রোতাকে সহজেই আকর্ষণ করে। তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০ টি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্যসূচীতে ” কান্তগীত ” অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও তাঁর গান বিশেষভাবে পরিচিত ও জনপ্রিয়।
সংগীতপ্রাণ রজনীকান্ত যখন গৌরবের শিখরে, তখন তাঁর শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি ক্যান্সার। রোগ শয্যায় থেকেও তিনি বহু গীতি কবিতা লিখেছেন। প্রায় দুই বছর কঠিন রোগ ভোগের পর ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ” গানের রাজা ” রজনীকান্ত সেন মারা যান।
বাংলা গীতি কাব্যের প্রবাদ প্রতীম প্রখ্যাত পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন বাঙ্গালি সংগীত সাধনার এক মাইল ফলক। তাঁকে জানাই হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
তথ্যসুত্র : কবি আসাদ চৌধুরী রচিত জীবনীগ্রন্থ ” রজনীকান্ত সেন”।
৪৫টি মন্তব্য
আলমগীর সরকার লিটন
পঞ্চকবির প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই মুক্ত আপু
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই
হালিম নজরুল
রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে খুব কমই জানতাম। আপনার কল্যাণে জানলাম। ধন্যবাদ।
রোকসানা খন্দকার রুকু
জানতাম না ।
” বাবুই পাখিরে ডাকিয়া বলিছে চড়াই
কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।”***
আমার ভীষন পছন্দের কবিতা।।।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ আপু।
ভালো থাকবেন সবসময়
আরজু মুক্তা
লেখাটা সার্থক হলো।
শুভকামনা
রোকসানা খন্দকার রুকু
ধন্যবাদ আপুনি। ভালো থাকবেন।
ইঞ্জা
রজনীকান্ত সম্পর্কে এই প্রথম শুনলাম আপু, আজ যা আপনার লেখার মাধ্যমে জানলাম, এমন গুণী মানুষ সম্পর্কে জানতে পেরে সত্যি খুব ভালো লাগছে।
ধন্যবাদ অশেষ আপু।
আরজু মুক্তা
লেখাটা সার্থক হলো।
ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
অবশ্যই স্বার্থক লেখা আপনার।
শুভকামনা রইলো আপু।
আরজু মুক্তা
আমও কৃতজ্ঞ
আরজু মুক্তা
আমি
খাদিজাতুল কুবরা
তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো গানটি অনেক শুনেছি কিন্তু এ গানটি যে রজনীকান্ত সেন লিখেছেন জানতাম না।
অনেক কিছু জানা হলো গুণী মানুষটি সম্পর্কে।
অনেক শুভকামনা রইলো আপু।
আরজু মুক্তা
কতো অজানা আমাদের!
আমার লেখাটা সার্থক হলো।
শুভকামনা
সুপায়ন বড়ুয়া
বাংলা গীতি কাব্যের প্রবাদ প্রতীম প্রখ্যাত পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন বাঙ্গালি সংগীত সাধনার এক মাইল ফলক। তাঁকে জানাই হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা।
সাথে আপনাকেও জানাই ধন্যবাদ সুন্দর ভাবে কবিকে
উপস্থাপন করার জন্য।
শুভ কামনা।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ দাদা।
আপনারা পড়লেই লেখা সার্থক।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারলাম। এজন্য ধন্যবাদ আপনার প্রাপ্য। এদের সৃষ্টি গুলো এভাবেই আমরা সংরক্ষণ করতে পারি আমাদের লেখার মাধ্যমে, অন্যকে জানানোর মাধ্যমে। ভালো থাকবেন শুভ কামনা রইলো
আরজু মুক্তা
সুন্দর মন্তব্য করেছেন। ধন্যবাদ দিদি
শামীম চৌধুরী
তথ্য সমৃদ্ধ লেখায় পঞ্চ কবি রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে অনেক কিছু জানালেন আপু।
কবির প্রতি রইলো শ্রদ্ধা।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ ভাই। আপনারা উৎসাহ দিলে লেখায় প্রাণ চাঞ্চল্য ফেরে
সাদিয়া শারমীন
“বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই কুঁড়ে ঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই”-এই কবিতা দিয়েই রজনীকান্ত সেনকে চিনেছি। পরবর্তীতে তার গান শুনেছি ।আরো কবিতা পড়েছি। কিন্তু ছোটবেলায় শেখা সেই কবিতা আজও মনে আছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এত সুন্দর তথ্যসমৃদ্ধ একটা লেখা আমাদের উপহার দিয়েছেন।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।
শুভকামনা সবসময়
মোঃ মজিবর রহমান
তাঁর প্রতি রইল স্যালুট।
তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো
মলিনমন মুছায়ে
তব, পূর্ণ কিরণ দিয়ে যাক
মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।” কি মন ছুয়া কথ।
আরজু মুক্তা
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
শুভকামনা জানবেন
তৌহিদ
রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানলাম। শ্রদ্ধা জানাই এই সঙ্গীতজ্ঞ ব্যক্তিকে।
চমৎকার এমন লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
লেখাটা সার্থক হলো।
আপনাকেও ধন্যবাদ
রেজওয়ানা কবির
আমিও রজনীকান্ত সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানলাম। ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আপি, আপনার জন্য শুভকামনা।
বন্যা লিপি
তথ্যসমৃদ্ধ পোষ্ট। পঞ্চকবি সম্পর্কে বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দেবার জন্য ধন্যবাদ। পর্যায়ক্রমিক বাকিদের নিয়ে লিখবেন আশা করি।
আরজু মুক্তা
ধন্যবাদ। নিশ্চয়, চেষ্টা করবো।
মনির হোসেন মমি
রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে তেমন জানা ছিলো না।ধন্যবাদ বিস্তারিত জানানোর জন্য। আপনার পোষ্ট পড়ে বুঝতে পারলাম তিনি যে ধরণের লেখা লিখতেন তা অনেকটাই আধ্যাত্বীক টাইপের যেখানে অনেক সাধনা ধ্যানের প্রয়োজন পড়ে।
বিনম্ভ্র শ্রদ্ধা।
আরজু মুক্তা
জি ভাই, আধ্যাত্মিক। ঈশ্বর আর মানবতার প্রতিফলন ছিলো।
ধন্যবাদ আপনাকে
সুরাইয়া পারভীন
তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো
মলিনমন মুছায়ে
তব, পূর্ণ কিরণ দিয়ে যাক
মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।
এটা রজনীকান্তের লেখা আজই জানলাম।
কৃতজ্ঞতা অশেষ আপু
এতো সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্টের জন্য
আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
আরজু মুক্তা
আপনাকেও ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন
রেহানা বীথি
অনেক সুন্দর একটি পোস্ট। রজনীকান্ত সেন সম্পর্কে অনেক তথ্য তুলে ধরে সবাইকে উপকৃত করলেন। গভীর শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি।
আরজু মুক্তা
বিনম্র শ্রদ্ধা কবির প্রতি।
ভালো থাকবেন, আপি।
শুভকামনা
ছাইরাছ হেলাল
কম বেশী তার গান-কবিতা শুনেছি কিন্তু অন্যগুলো তা ই জানলাম।
এ জন্য আপনি ধন্যবাদ অবশ্যই পাবেন।
আরজু মুক্তা
কখন ধন্যবাদ পাবো? এখনি দিন।
আপনার জন্য শুভকামনা।
ছাইরাছ হেলাল
অণুগল্প লাগবে আগে।
আরজু মুক্তা
পাবনায় সিট পাওয়া যাবে?
ছাইরাছ হেলাল
নাহ্, সেখানে কাউকে পাঠাতে চাই না।
ছাইরাছ হেলাল
এবারে তথ্য সূত্র দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আরজু মুক্তা
আপনাকেও।
অনুগল্প রেডি।
উর্বশী
অনেক কিছু জানা হলো। ভাল লেগেছে। দারুন তথ্যবহুল পোস্ট।
আরজু মুক্তা
আপনার জন্য শুভকামনা