
মুসলিমদের রোজার স্মৃতি গুলোর মধ্যে কিছুটা মিল আছে। এসব মিল এর মধ্যে আমার রোজার একটি স্মৃতি আলাদা ভাবেই মনে পড়ে।
ক্লাস থ্রি তে যখন পড়ি তখন একা একা বাসার বাইরে যাবার অনুমতি পেয়ে যাই। অনুমতি পেলেও খুব দূরে যেতাম না ছেলে ধরার ভয়ে। ছেলে ধরার ভয় আম্মাই মনের মধ্যে দিয়ে দিয়েছিলেন। বাসার কাছাকাছি থানার মাঠ, মহকুমা প্রশাসন ( বর্তমানে জেলা প্রশাসন) অফিসের কাছে বিশাল বড় দীঘির পাড়, বেশী দূরের মধ্যে যেতাম লিচু বাগান ( বর্তমান কালেক্টরেট স্কুলের পিছনে), সুগন্ধা নদীর পাড়।
ঐ বয়সে পাড়ার আমার বয়সি বন্ধুরা ছিল সব হিন্দু৷ আমার সম বয়সি কোনো মুসলমান বন্ধু ছিল না। দুলাল, নারায়ন, শ্যাম এই তিনজনই আমার প্রানের দোস্ত। রমজানের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি এদেরকে নিয়েই।
তখন ইফতারির সময় হলে সাইরেন বাজতো না কোনো মসজিদে। সাইরেন ছিলোই না কোথাও। কাছের কোনো মসজিদে মাইক না থাকায় মাগরেব এর আজানের ধ্বনিও কানে আসত না৷ রোজাদাররা তাহলে কিভাবে ইফতারির সময় বুঝতেন? ঠিক ইফতারির সময় বিকট এক শব্দে বোমা ফাটানো হতো। এই শব্দ শুনেই রোজাদাররা ইফতারি করতেন।
কোথায় এবং কিভাবে এই বোমা ফাটানো হয় তা দেখার আগ্রহ হলো খুব৷ দুলালকে বলায় ও সব খবর নিয়ে আসলো। স্থান বারোচলার পশ্চিম পাশের ছোট একটি মাঠ। একদিন আম্মাকে বলে চার বন্ধু গেলাম বোমা ফাটানোর নির্দিষ্ট স্থানে। আরো অনেক মানুষ দেখতে এসেছে। খোলা মাঠটির ঠিক মাঝে উচু লম্বা একজন স্বাস্থবান মানুষ দাড়িয়ে আছেন। এমন সুঠাম দেহের মানুষ আমি এখন পর্যন্ত আর দেখিনি। চুল লম্বা, বাবরি চুল বলতাম তখন। তার পায়ের কাছে কিছুটা উচু করা, ওখানেই বোমা রাখা পাশের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনেছি। চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে, উনি বোমাটা ফাটাবেন কি ভাবে? ওনার ক্ষতি হবেনা? কিছুক্ষন পরপর উনি হাত ঘড়ি দেখছেন।
অবেশেষে উনি মাঠের চতুর্দিকে দাড়ানো মানুষদের দিকে তাকিয়ে দুহাত উঠিয়ে হাত নাড়ালেন। বুঝলাম সময় অতি নিকটে। জামার সাইড পকেট হাতরে দিয়াশলাই বের করে বোমের ওখানে আগুন দিয়েই দৌড়ে মাঠের একপাশে চলে এলেন। বোমের ওখানে তারাবাতির মত আগুনের ফুলকি। হঠাৎ দ্রুম শব্দে বোম ফাটলো। মাঠের মধ্যে ধোয়া আর আবর্জনা অনেক উচু পর্যন্ত উঠে গিয়েছে। গায়ে এসেও কিছু ধুলো পরলো। শব্দের প্রচন্ডতায় এত ভয় পেয়ে গিয়েছি যে,ওরে মা গো বলে দৌড়। মনে হচ্ছে কানের পর্দা ফেটে গিয়েছে। দৌড়ের ঠেলায় কোথায় দুলাল আর কোথায় নারু, শ্যাম? বাঁচতে হবে আমাকে, জান নিয়ে পালাতে হবে, সেভাবেই দৌড়াচ্ছি বাসার দিকে। স্যান্ডেল পা থেকে খুলে গেছে কখন জানিনা। দুই মিনিটের মধ্যে বাসায় এসে ইফতারির টেবিলে। হাফাচ্ছি তখন, প্রচুর পানি খেয়েও তৃষ্ণা যায় না।
আব্বাকে আম্মা আগেই বলে রেখেছিলেন কোথায় গিয়েছি, তাই ধমক আর খেতে হয়নি। কান ঠিক হতে লেগেছিল দুই তিনদিন।
এই বোম ফাটানো মানুষটিকে ৭১ এ পাকসেনারা ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বোমা বানানোর ট্রেনিং দিতেন এই সন্দেহে। এখনো তার কথা মনে হয় মাঝে মাঝে।
১৩টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
শেষেরটা কষ্টের, ব্যথার। ঈশ্বর তাকে স্বর্গবাসী করুন। আপনার রোজা রাখার কথা জানতে চাই। পানি কতবার খেতেন, খাবার কতবার খেয়েছেন ইত্যাদি অবশ্যই জানাবেন। ভালো থাকুন দাদা ভাই। আপনার জন্য শুভকামনা ও শুভেচ্ছা রইলো
আরজু মুক্তা
দুঃখজনক।
তবে বোমা ফাটা হতো। এই প্রথম শুনলাম
শিরিন হক
এক অন্যরকম গল্প এক নতুন তবে ইতিহাস বিজড়িত।
চমৎকার
মাছুম হাবিবী
ছোটবেলার রমজানের স্মৃতিগুলো শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া। অনেক অজানা একটি গল্প জানলাম, বেশ মজার এবং সুন্দর একটি গল্প। সত্যি ছোটবেলার গল্পগুলো ঠিক বইয়ের সাজানো গল্পের মত।
শামীম চৌধুরী
জিসান ভাই, আপনার লেখা পড়ছিলাম আর ছোটবেলায় রমজানের স্মতিগুলি চোখে ঝলঝল করে ভেসে উঠছিলো। বিশেষ করে শীতের দিনে রমজানের স্মৃতিগুলি। বেশ মজাদার গল্পটি। সবার জীবন হোক স্মৃতিচারনে মধুময়।
ফয়জুল মহী
লেখা পড়ে ভালো লেগেছে। মন পুলকিত হল।
ছাইরাছ হেলাল
এই স্মৃতিগুলোই একমাত্র সত্য সম্বল এই ক্ষয়িষ্ণু জীবনে।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সবকিছু ভুলে যাও যায় কিন্তু স্মৃতি কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।
শেষের দিকে একটু কষ্ট লাগলো।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।
শুভকামনা দাদা।
হালিম নজরুল
“আব্বাকে আম্মা আগেই বলে রেখেছিলেন কোথায় গিয়েছি, তাই ধমক আর খেতে হয়নি। কান ঠিক হতে লেগেছিল দুই তিনদিন”
——চমৎকার বোমা অভিজ্ঞতা
সুপায়ন বড়ুয়া
ছেলেবেলার স্মৃতিকথা গুলো আসলে মজার।
কিছু স্মৃতি দাগ কেটে যায়।
পাকসেনাদের হাতে ঠিকই পোঁছে গেছে এই
পরোপকারী লোকটির কথা।
ভাল থাকবেন। শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
এমন অভিনব কায়দার কথা শুনিনি ভাইয়া আগে। ‘ওরে মাগো’ বলে দৌড়ের দৃশ্যটা কল্পনা করে ভীষণ মজা লাগছে। তবে বোমা ফাটানো লোকটির শেষ পরিণতি জেনে ভীষণ মর্মাহত হলাম।
ইঞ্জা
এ দেখি খাজা বাবার দরবারে তোপ দাগার মতো অবস্থা, আপনার দৌড় চিন্তা করে হাসছিলাম কিন্তু বোমা ফাটানো মানুষটার করুন ঘটনাটি শুনে মনটা আমার শূন্য হয়ে গেলো ভাইজান।
তৌহিদ
বোমা ফাটানোর গল্প জেনে ভালো লাগলো ভাই। ভাগ্যিস আমরা সেসব পাইনি। সাইরেনই পেয়েছি। উপকারী মানুষটিকে পাক সেনারা হত্যা করেছে জেনে খুব দুঃখ পেলাম মনে।
ভালো থাকুন সবসময়।