
এই থমকে যাওয়া সময়ে সব ভাবনা এলোমেলো উড়ছে যেন। একসময় মনে হতো, যদি একটানা দশদিন ছুটি পাওয়া যেত, মনের পেখম মেলে দিতাম। মেয়েদের বহুদিনের শখ, সবাই কত বেড়াতে যায় সাগরে নয় পাহাড়ে, আমরা কোথাও যাই না। ওদের সে শখ পূরণ করে দেবো। এখন ছুটি। দীর্ঘ দীর্ঘ ছুটি। কিন্তু এ ছুটি গৃহবাসী ছুটি। অনিশ্চিত এ দীর্ঘ ছুটিতে প্রাণ নেই কোনও, আছে মনের ঝিমোনো ভাব। ক্ষণে ক্ষণে বুকের ভেতর ডুমডুম করে উঠছে, ছুটি কবে শেষ হবে, আর ছুটির শেষ অব্দি দেখার জন্য বেঁচে থাকবো তো?
হিসেবের বাইরে চলে গেছে তারিখ, বার। সেদিন শুক্রবার ভেবে ভেবে চলছি সকাল থেকে, দুপুর সাড়ে বারোটা পেরিয়ে গেল জুম্মার আযান হয় না, কারণ কী? জানলাম শুক্র নয়, বুধবার সেদিন। কী অবস্থা!
এই অবস্থাতেই বন্দি জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্যে, বিশেষ করে কন্যাদের ভালোলাগার কথা মাথায় রেখেই পহেলা বৈশাখ পালন করে ফেললাম। অনেকদিন পর যেন প্রাণ এসেছিল আমার ভাঙাচোরা বাড়িটিতে।
প্রতিবছর পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এপ্রিলের শুরু থেকেই ব্যস্ততার সীমা থাকে না। কন্যারা যেহেতু গান করে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করার জন্য চলে প্রতিদিন রিহার্সাল। আমাদের স্থানীয় উকিল বারেও বেশ ঘটা করে পালন করা হয় নববর্ষ। সেটা নিয়ে ব্যস্ত থাকি আমিও। শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গান করার পরে আমাদের বারেও কন্যাদের গান পরিবেশন শেষে কিছুক্ষণের জন্য দুপুরে বাড়ি ফিরে আসি। বিকেলে আবার মেয়েদেরকে নিয়ে ছুটতে হয় মেলায়। ওখানে গান এবং ঘোরাঘুরি শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। ভোর থেকে শুরু করে সারাদিনের এই আনুষ্ঠানিকতায় একেবারে কাহিল অবস্থা সবারই। প্রতিবারই মেয়েরা বলে, বৈশাখের অনুষ্ঠানে আর গান করবো না কোনদিন। কিন্তু আবার যখন উঁকি দেয় পহেলা বৈশাখ, ওদের উৎসাহের ঘাটতি থাকে না কোনও।
এবার এই গৃহবাসী ছুটিতে মনে পড়ছে সেই ব্যস্ততার দিনগুলো। এমন ছুটি তো আমরা চাইনি! ব্যস্ততাহীন নিরুত্তাপ ছুটি কেন তবে ভোগ করতে হচ্ছে আমাদের? তবে কি আমরা বড় বেশি অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলাম, এ ছুটি তারই ফল?
গাছে গাছে ছোট ছোট আম। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে তারা, একসময় পাকবে। আমগুলো পাকার জন্য যেটুকু সময় প্রয়োজন, সে সময়ের আগে তাদের পাকার কথা নয়। তারপরেও দেখা যাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই ঝাঁকা ভর্তি পাকা আম বাজারে। কিন্তু কেমন করে?
আমাদের অসহিষ্ণুতা কেমিক্যাল প্রয়োগে তাদেরকে পাকতে বাধ্য করে আগেই। আমরা যারা ক্রেতা, তারা আনন্দিত হই পছন্দের ফলটি পেকে গেছে দেখে। কিনেও ফেলি চড়া দামে। যখন পাকার কথা তার আগেই আমগুলো পেকে গেল কিভাবে, এ প্রশ্ন একবারও ভাবিত করে না আমাদেরকে। টাকা আছে, কিনবো না কেন? কিন্তু যদি না কিনি, বর্জন করি ওই কেমিক্যাল দেয়া আম সম্মিলিতভাবে, তাহলে বিক্রেতা নিরুৎসাহিত হতে বাধ্য। তবুও চলে বেচাবিক্রি। ক’টা দিন সবুর করে গাছপাকা আম খাওয়ার মতো ধৈর্য আমাদের নেই। এতটাই অসহিষ্ণু আমরা।
এই অসহিষ্ণুতার তাণ্ডব চলছিল পুরো বিশ্বজুড়ে। চারিদিকে ভয়াবহ অস্থিরতা। যেন অপ্রকৃতিস্থ হয়ে উঠেছে গোটা মানবজাতি। আর সেই ভয়াবহ অস্থিরতাই বোধকরি আমাদেরকে টেনে এনেছে আজকের এই ভয়াবহতম বিপর্জয়ের মুখে। এখন আমাদের পালাবার কোনও পথ নেই। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পিঠ ঠেকে যাওয়া ওই দেয়াল ভেদ করার শক্তি অসহিষ্ণুতার কবলে বন্দি। এই অপ্রকৃতিস্থ মানবজাতির জন্য এ এক চরম শিক্ষা। যদি বেঁচে থাকে কেউ, শিক্ষাটা হয়তো কাজে লাগাবে আগামীদিনে। প্রয়োজন ছিল এ শিক্ষার। পৃথিবীটা বড় বেশি জর্জরিত হয়ে গেছিল যে!
২৯টি মন্তব্য
তৌহিদ
চরম এক অস্থির সময় পার হচ্ছে। সসস্ত সিস্টেম ব্রেক হয়ে জীবন যেন থমকে পড়েছে। স্বাভাবিকতা হাড়িয়েছে সবকিছুই। সামনে যে আরো কি হবে ভাবতেই অস্থিরতা পেয়ে বসে আমার।
ভালো থাকবেন আপু।
রেহানা বীথি
ভয় তো সেটাই ভাই, ঠিক কতটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে চলেছি আমরা, হয়তো তা কল্পনাও করতে পারছি না।
ভালো থাকুন সবাইকে নিয়ে।
ছাইরাছ হেলাল
স্মৃতিচারণ ও দিনপঞ্জির মত করে সুন্দর লেখাটি পড়লাম। আসলে কোথায় যেন তাল কেটে গেছে।
সব কিছুই বেসুরো লাগে,
আসলে শিক্ষা আমরা নেই না, নেইনি যেমন আগেও, প্রকৃতি নানা বিপর্যয় দিয়ে আমাদের কিছু একটা শেখাতে চায়
কিন্তু আমরা তো পণ করে আছি, কিছুই দেখব না শিখব না।
ভাল থেকে আমাদের জন্য নিয়মিত লিখবেন। আমাদের জন্য।
নিরাপদে থাকুন সবাইকে নিয়ে। মা-দের নিয়ে-ও।
রেহানা বীথি
দোয়া করবেন ভাইয়া।
সবাইকে নিয়ে ভালো থাকুন আপনিও।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সবাই আমরা অস্থিরতার , প্রতিযোগিতার চরম শিখরে পৌঁছে গিয়েছিলাম , তাই বিধাতা আর প্রকৃতি ও দম বন্ধ অবস্থায় আর পারছিলো না রাশ টানতে । এবার করোনা দিয়ে সেই রাশ টানলো। ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
রেহানা বীথি
আপনিও ভালো থাকুন আপু।
শুভকামনা নিরন্তর।
সুপায়ন বড়ুয়া
যাক বাবা জানা হলো আপুর ব্যস্ততা মেয়েদের নিয়ে
নববর্ষ জুড়ে। এবার সবাই মিস করেছি ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি স্মৃতিচারন করে ফেইস বুক জুড়ে
আশায় থাকি আসুক আবার সুদিন ফিরে।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
সুদিনের অপেক্ষায় আমরা সবাই।
ভালো থাকবেন দাদা।
শুভকামনা রইল।
ফয়জুল মহী
মনোমুগ্ধকর লিখনশৈলি ।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন সবসময়।
মাহবুবুল আলম
একান্ত অনুভূতিতে গৃহবন্দী সকল মানুষের অব্যক্ত কথাই যেন ফুটে ওঠেছে।
ভাল থাকবেনসবসম।
রেহানা বীথি
আপনিও ভালো থাকুন ভাইয়া।
শুভকামনা নিরন্তর।
কামাল উদ্দিন
এখন বার তারিখ সময়ে কার কি আসে যায়? থমকে যাওয়া সময় থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও অনিশ্চিৎ ভবিষ্যত যাত্রার কথা ভাবলে মনটা আৎকে উঠে।
রেহানা বীথি
সেটাই ভাই।
আল্লাহ্ সহায় হোন।
ভালো থাকবেন, শুভকামনা রইল।
কামাল উদ্দিন
আপনিও ভালো থাকুন আপু, সব সময়।
সুরাইয়া পারভীন
এতো কিছুর পরেও যে শিক্ষা হবে আমাদের তা বলাই বাহুল্য। এই মরছি মরবো সময়েও সবাই কেনো নিজেদের স্বরূপ উন্মোচন করছেন। কেউ বস্তা বস্তা খাবার কিনে রেখে অন্যের খাদ্য সংকট করছে। কেউ অসহায়দের জন্য বরাদ্দ চাল চুরি করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে নির্বোধ বাঙালি জাতি আমরা। আমাদের বোধদয় কখনোই হবে না।
বৈশাখ উদযাপন ঘটা করে কখনো করিনি। তাই না নিয়ে আমার কোনো প্ল্যান পরিকল্পনাও ছিলো না কখনো। এখনো নেই। তবে গৃহবন্দী হয়ে থাকতে পারছি না। দম বন্ধ হয়ে আসছে।
রেহানা বীথি
এই পরিস্থিতিতেও যারা ত্রাণসামগ্রী চুরি করে, তাদের হুঁশ কোনকালেই হবে না আপু।
ভালো থাকুন সবাইকে নিয়ে।
শুভকামনা রইল।
নীরা সাদীয়া
সত্যি এ গৃহবন্দী জীবন যেন অচল, স্থবির। কখন যে ফুরাবে কে জানে। বছরের শুরু থেকে শাড়ি রেডি ছিলো, তা আর পরা হলো না! এ কেমন বৈশাখ?
রেহানা বীথি
একেবারেই একলা এক বৈশাখ।
কী যে এলোমেলো লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না।
ভালো থাকুন সবাইকে নিয়ে।
শুভকামনা সবসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
ঠিক যেনো আমার মনের অব্যক্ত কথাগুলোই আপনার পোস্টে গোছানো ভাবে পড়লাম। এই জন্যে অবশ্যই অনেক গুলো ধন্যবাদ। সব সময়ের চির কাঙ্ক্ষিত ছুটির দিন গুলো এমন হয়ে আসবে তা কল্পনার বাইরে ছিলো। আগে অপেক্ষায় থাকতাম একটু বড় ধরনের ছুটির জন্যে। মেয়েদের নিয়ে প্লান করতাম, কোথায় যাবো, কি কি করে ছুটির দিনগুলো স্মরণীয় করে রাখবো এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই ছুটি এসে যেতো। তাদের আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হতো পরবর্তী আরেক ছুটির অপেক্ষা দেখে। কিন্তু এখন ছুটিটা যেন বোঝায় পরিনত হয়েছে। যে মেয়েটা প্রায়ই স্কুলে না যাওয়ার জন্যে একেকটা বাহানা খুঁজতো, সেই এখন প্রতিরাতে ঘুমানোর আগে জিজ্ঞেস করে, আম্মু কাল কি আমার স্কুল খুলবে, আমরা কবে স্কুলে যাবো? উত্তর দিতে পারিনা। বর্তমান পরিস্থিতি আর আগামীদিনের অজানা অবস্থার কথা ভেবে ভেবে স্বাভাবিক সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
রেহানা বীথি
বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকালেই মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিক চঞ্চলতা নেই, লেখাপড়াতেও মন বসাতে পারছে না ওরা। একসময় মোবাইল, কম্পিউটার সারাদিনে একবারও নিতে পারেনি দেখে মন খারাপ করতো, আর এখন বিরক্ত ওগুলোর ওপরেও।
আমাদের আগামী এমন অনিশ্চয়তায় ভরে উঠবে, ভাবনাতেই ছিল না কারও।
ভালো থাকুন সবাইকে নিয়ে।
সবাই নিরাপদে থাকুন।
শুভকামনা রইল।
সঞ্জয় মালাকার
চরম এক অস্থির সময় পার হচ্ছে।
সত্যি এ গৃহবন্দী জীবন যেন অচল,
ভালো থাকবেন দিদি শুভ কামনা ।
রেহানা বীথি
আপনিও ভালো থাকবেন দাদা।
শুভকামনা রইল।
নিতাই বাবু
অনেকদিন ব্লগে প্রবেশ না করে আপনাদের অনেক মূল্যাবান লেখা পোস্ট মিস করেছি, দিদি। ইদানীং আমি অধমও দিনে-রাতে বেশ কয়েক ঘণ্টা করে ছুটি পেয়ে থাকি। তবে আমার কর্মজীবনের অফিসটা কিন্তু বন্ধ নেই! মানে আমার অফিস অর্ধবেলা খোলা থাকে। তাই একটু সময় পাচ্ছি। তো এই লম্বা সময়টা আজ দুইদিন ধরে কেমন যেন অস্থির অস্থির মনে হচ্ছে। আমি শত ঝামেলার মাঝেও বাসায় বসে থাকতে পারি না। তাই এই লকডাউনের আলামতের মধ্যেও রাতবিরেতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। কিছু সময় বাইরের বাতাস দেহে ঢুকিয়ে নিয়ে আবার বাসায় এসে চুপচাপ বসে থাকি।
সত্যি দিদি, আমরা এখন এক কঠিন সময় পার করছি। এই সময়ে আবার অনেককিছুই শিখে নিচ্ছি। যা জীবনের অবশিষ্ট সময় পর্যন্ত কাজে লাগবে।
লেখা কিন্তু অসাধারণ হয়েছে, দিদি। প্রার্থনা করি এই সময়ে সপরিবারে ভালো থাকার।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
পরম করুণাময় সহায় হোন সবার।
ভালো থাকুন দাদা সবাইকে নিয়ে।
হালিম নজরুল
এখান থেকে শেখার আছে অনেককিছুই। ধন্যবাদ।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
শুভকামনা রইল।
জিসান শা ইকরাম
সব কিছুকে পাল্টে দিয়েছে এই করোনা।
যা কিছুই করি বা ভাবি, করোনা চিন্তায় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে থমকে যাচ্ছে সব।
একান্ত অনুভুতি ভালো লেগেছে।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন ভাইয়া সবসময়। শুভকামনা রইল।