
সে প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়েই হাতটা আরও শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকলো হন হন করে। ওর আচমকা গতিতে তাল হারিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল সুরভী। জানে না কাঁদু নামের ছেলেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, তবু যেন এক আশ্চর্য নির্ভরতায় সেও শক্তহাতে ধরে আছে তার হাত।
ছেলেটি কি তাকে ওর বাড়িতে নিয়ে যাবে? কে কে আছে ওখানে? ওর বাড়ির লোকজন যদি সুরভীর পরিচয় জানতে চায়, কি বলবে কাঁদু?
এমন অজস্র প্রশ্ন মনে নিয়েই সুরভী হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে কাঁদে, কাঁদতে কাঁদতে হাঁটে।
বেশ ক’বছর আগে, আরেকটি নাম প্রায় জড়িয়েই যাচ্ছিল এই জীবনইতিহাসে। কলেজে পড়ার সময় খুব ভাব হয়েছিল মিতু নামের একটি মেয়ের সাথে। ভাবের গভীরতার কারণে মেয়েটিকে নিজের জীবনের অংশ বলে ভাবতেও শুরু করেছিল কাঁদু। টানাটানির মাঝেও শখ করে একখানা ‘শেষের কবিতা’ উপহারও দিয়েছিল মেয়েটির কোনও এক জন্মদিনে। সেই মেয়েই দুম করে একদিন জানালো, ওর বিয়ে। চেহারায় একফোঁটা বেদনার চিহ্ন না ফুটিয়েই জানিয়েছিল ওর হবু বর এই, ওর হবু বর সেই; ওর হবু বরের হেন আছে তেন আছে। মুচড়ে ওঠা বুকের ওপর নিজের একটা হাত আলতো বুলিয়ে কাঁদু জানতে চেয়েছিল,
তুমি ভালোবাসোনি আমাকে?
হা হা করে হেসে মেয়েটি বলেছিল, ধুর! আমরা তো কেবল বন্ধু! তুমি সেটাকে প্রেম ভেবে নিলে? তোমরা ছেলেরা না পারোও বটে! তাছাড়া….
তাছাড়া?
নাহ্, থাক….
বলে চলে গেছিল মেয়েটি। তাছাড়া… কাঁদু গরিব, এই তো? কাঁদুর এই নেই সেই নেই, কিন্তু কাঁদুর গায়ে লেখা আছে ও গরিব। তাছাড়া’র গায়ে না বলাটুকু ছেড়ে দিয়ে মেয়েটা দিব্যি চলে গেছিল। তবে সুরভী বোধহয় অমনটা করবে না, ওর অমনটা করার সুযোগই নেই!
মৃদু কাঁপছে কি মেয়েটা? কাঁপাটাই স্বাভাবিক, শীত তো আর কম নয়। কাঁদুর মতো তার গায়েও একটা চাদর আছে অবশ্য, তবে ওতে কি আর শীত মানে? কাঁদুরও তো মানছিল না। মাঠের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তো গায়ের চামড়া কেটে যেতে বসেছিল ঠাণ্ডায়। তারপর আচমকা খবরটা শুনে শীতের জায়গায় সুরভীর চিন্তা জেঁকে বসেছিল পুরো অস্তিত্ব জুড়ে। সে ধাক্কাটা অবশ্য সামলে নিয়েছে সে এতক্ষণে। এখন একটাই চিন্তা, বাড়ি ফেরার পর কি হবে? এই চিন্তার সাথে সাথে হুল ফোটানো বাতাস আবারও জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। বিশাল মাঠটা পেরিয়ে এসেছে ওরা বেশ কিছুক্ষণ আগেই। শহরের পথটা এখন সঙ্গী ওদের। ঘুমিয়ে পড়েছে শহরটা। ঘন কুয়াশায় সাদা চারপাশ। লাইটপোস্টের টিমটিমে আলো কুয়াশার কারণে আরও বেশি ম্রিয়মান। সেই যে হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল মেয়েটিকে, চলো, তারপর আর একটাও কথা বলেনি কাঁদু। কোনও কথা জানতেও চায়নি মেয়েটির কাছে। জানতে চাইবেই বা কী! সব অভাগাদের গল্পগুলো একইরকম।
বাড়ি পৌঁছানোর পরের অবস্থা চিন্তা করে মনে মনে অনেকটাই গুটিয়ে থাকা কাঁদু কেন যেন এক অজানা আনন্দও অনুভব করছে। সেই আনন্দমাখা মুখ তুলে বার বার সে সুরভিকে দেখছে। মেয়েটা চাদরে এমনভাবে মাথা-মুখ ঢেকে আছে যে প্রায় কিছুই দেখা যায় না। যেটুকু উন্মুক্ত, এই কুয়াশাময় রাতের ক্ষীণ আলোয় তাও অস্পষ্ট। তবুও কাঁদু দেখছে, বার বারই দেখছে। একটা মেয়ে, যার সাথে শারিরীক সম্পর্কই হয়েছে শুধু, ভরসা করে কাঁদুর একটি হাত ধরে আছে শক্ত করে! একেবারে অজানার উদ্দেশ্যেই বলা যায়, তবু তো ভরসা করতে পেরেছে! ওকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে কি জবাব দেবে, সে চিন্তা ছাপিয়ে এই আনন্দটাই যে মনে দোলা দিচ্ছে বেশি করে। বার বার ভুলে যেতে মন চাইছে, অভাবের সংসার, যে ক’জন আছে বাড়িতে তাদেরই আহার জোটে না, এই নতুন মুখে কি তুলে দেবে? আর বাড়ির লোকজন এমন এক অনাহুতকে মেনে নেবেই বা কেন?
পাড়ার মোড়ের দোকানপাট ঘুমিয়ে পড়েছে। বন্ধ চায়ের স্টলের সামনে মাটির চুলোর পাশে শুয়ে আছে তিনটে কুকুর। রোজই থাকে। তবে সংখ্যা অনির্দিষ্ট। গরমের সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকলেও এই শীতে গরম চুলোর পাশে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই শুয়ে থাকে ওরা। চায়ের দোকানদার নাসিরের দোকানটাই যেন নাসিরের বাড়ি। রাতে বেচাবিক্রি শেষে চুলো নিভিয়ে ঝাঁপ ফেলে ঘুমিয়ে পড়ে দোকানেই। সুরভিকে সাথে নিয়ে স্টলের সামনে আসতেই আপাদমস্তক চাদরে মোড়ানো নাসির যেন কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে জানতে চাইলো …
কে?
আমি কাঁদু, বলেই দ্রুত পা চালানোর চেষ্টা করলো কাঁদু। সুরভীকে নিয়ে কোনও প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াই উত্তম। এতরাতে সঙ্গে মেয়েমানুষ, তাও আবার কাঁদুর সঙ্গে, শুধু বাড়ির লোক কেন, পাড়া পড়শী কেউই কি সহজভাবে নেবে? পড়িমরি করে ছুটলো কাঁদু। কিন্তু নাসির যেন কি বলছিল! ওর বাড়ির কথা কি যেন কানে এলো! যাকগে, বাড়ি পৌঁছালেই তো জানা যাবে সব! আর এই হাড়হিম করা শীতে দোকানের ঝাঁপ ফেলে না ঘুমিয়ে নাসিরের জেগে থাকার দরকারটাই বা কী? তাও আজই, যে রাতে কিনা সুরভী আছে কাঁদুর সাথে! যত্তসব!!
দূর থেকে বাড়ির বারান্দার আলোটা আবছা দেখা যাচ্ছে। একে কুয়াশা, তারওপর বাড়ির সামনে রয়েছে একটা ঝাঁকড়া আমগাছ। আলোটা বড় বেশি ক্ষীণ, বড় বেশি রহস্যময়। সেই রহস্যময় আলোয় দূর থেকে অস্পষ্ট দেখতে পাওয়া নিজেদের বাড়ির সামনেটা কেমন যেন অন্যরকম মনে হচ্ছে কাঁদুর। নিজেদের সেই পুরোনো একতলা দালানটিই তো, কিন্তু অন্যরকম লাগছে কেন? নতুন কিছু কি ঘটেছে বাড়িটির সাথে? হাঃ হাঃ… কি আর ঘটবে? সেই রঙচটা বটের চারা গজানো পুরোনো বাড়ি, পুরোনো আমগাছ, বহুদিন ধরে ঝুলে থাকা ফিউজ না কাটা বাল্ব। কী আর নতুন থাকবে!
কিন্তু না, নতুন কিছু আছে বোধহয়! দূরত্ব কমে গেছে এখন, এখন স্পষ্ট খানিকটা, কে যেন…….. কারা যেন বসে আছে বাড়ির সামনে! এই গভীর রাতে কেন বসে আছে তারা? চুপচাপ, গম্ভীর? ওদের বুঝি শীত করে না? নিজের বিছানার লেপের ওম ছেড়ে কাঁদুদের বাড়ির সামনে বসে আছে কেন তারা?
ধীরে ধীরে পথ শেষ হয়। সদর দরজার সামনে পৌঁছে যায় কাঁদু সুরভীর হাত ধরে। কে যেন বলে ওঠে……. ভেতরে যাও, তোমার আব্বা মারা গেছে।
কত লোক….. কত নারী পুরুষ! মিহিসুরে কোরআন পাঠ। কাঁদছে না কেউ। শীর্ণ স্বামীর মৃতদেহের পাশে পাথর হয়ে বসে আছে মা। বোনদুটো তার পাশেই। কোথা থেকে যেন ভাইগুলোও চলে এসেছে!
কাঁদু যে এসেছে, মা কি দেখেনি? সুরভীকেও কি কেউ খেয়াল করেনি? নিজের দুর্ভাগ্য আর এই পরিস্থিতির কারণে হকচকিয়ে যাওয়া সুরভীকে তো একটু জায়গা দেয়া দরকার, দেয়া দরকার একটু গরম কাপড়, কিছুটা নিশ্চিন্তি। দীর্ঘ সময় মেয়েটি ভগ্নদশার মধ্যে রয়েছে। হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেল কাঁদু ওকে। ছোট বোনকে একটা কাপড়ের কথা বলতে হবে। একটু কি পানি খাবে মেয়েটি? বোনকে বলা দরকার।
ডাকতে হয়নি, অচেনা মেয়েটির প্রতি কৌতূহলেই বোধহয় এগিয়ে এসেছে বোন। তার হাতে একটি খাম, একটি অফিসিয়াল খাম, আব্দুল কাদের ওরফে কাঁদুর নামে রেজিস্ট্রি করা।
৩০টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
যাক শেষটাতে ভালো খারাপ দুটোই পাওয়া গেল। পিতৃহারা হলো আবার বৌ চাকরি দুটোই পেল। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটি গল্প উপহার দেবার জন্য। শুভ সকাল
রেহানা বীথি
অনেক ভালোবাসা আপু। ভালো থাকুন, শুভকামনা নিরন্তর।
ছাইরাছ হেলাল
যাক, দুঃখ দুঃখ করে শেষটায় শেষ করেননি,
তবে গল্প গল্পেই থেকে যায়।
এবারে কী হবে আগাম বলে দিন।
রেহানা বীথি
‘আগামী সবসময় আলোকিত’ এ ভাবনাটা হৃদয়ে লালন করি সবসময়। গল্পটা এখানেই শেষ ভাইয়া। পাঠক নি
নিজের মতো করে সাজিয়ে নেবেন কাঁদু-সুরভীর আগামী।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন সবসময়।
সুপায়ন বড়ুয়া
যাক বৌটার একটা ব্যাবস্থা হল
যদিও বাপ হারালো।
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর একটি গল্প উপহার দেবার জন্য। শুভ নব বর্ষ।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
ভালো থাকবেন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বাহ্!
শেষের শেষাংশ খুবি ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
সাধুবাদ দিদি।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সুরাইয়া পারভীন
কাঁদুর কী চাকরি হয়েছিল।
সৌরভী কী ওর জন্য লাকী
এ যেনো শেষ হয়েও শেষ হলো না।
তবে কাঁদু সৌরভীর আশ্রয় হয়েছে এটা কিন্তু দারুণ
সব মিলিয়ে দারুণ লিখেছেন
নববর্ষের অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ আপু।
আপনাকেও নববর্ষের অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
ভালো থাকুন সবসময়।
নাজমুল হুদা
ভালো লাগছে অনেক। কাঁদুর বাবা মারা গেছে, মেয়েটা জায়গা পেলো সবমিলিয়ে পরিবেশ বর্ণনা চমৎকার। কুকুরগুলো শুয়ে আছে। অন্ধকারে চায়ের দোকানে নাসির। মিহিসুরে কোরআন পাঠ।
গল্পের পরিবেশ বর্ণনাতে আমি ভাবতে পাচ্ছিলাম যে কেউ মারা গেছে। ভাবনা পরে মিলে গেছে্ মারা গেলও কাঁদুর বাবা।
রেহানা বীথি
ভালোলাগায় খুশি হলাম ভাই।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সুরাইয়া নার্গিস
শেষ পর্বটা সত্যি অনেক ভালো লেগেছে।
শুভ কামনা রইল আপু।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ আপু।
ভালো থাকবেন সবসময়।
শুভকামনা নিরন্তর।
ফয়জুল মহী
পরিপাটি লেখা । । ভালোবাসা ও শুভ কামনা আপনার জন্য।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
শুভকামনা রইল।
সঞ্জয় মালাকার
সৌরভী কী ওর জন্য লাকী
এ যেনো শেষ হয়েও শেষ হলো না।
তবে কাঁদু সৌরভীর আশ্রয় হয়েছে এটা কিন্তু দারুণ
সব মিলিয়ে শেষ পর্বে অসাধারণ লেগেছে,
শুভ কামনা না দিদি।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ দাদা।
শুভকামনা, ভালো থাকুন সবসময়।
কামাল উদ্দিন
কাঁদুর দুঃখ গাথা শুনলাম। সুখের দিন গুলো মনে হয় অন্য গল্পর জন্য রেখে দিয়েছেন। অনেক অনেক ভালোলাগা জানিয়ে গেলাম আপু।
রেহানা বীথি
সুখের আগমন ধ্বনি গল্পের শেষে। জীবন কোনও এক সময় সুখের মুখ দেখেই, এ বিশ্বাস যেন না হারাই আমরা।
ভালো থাকুন ভাই, শুভকামনা অশেষ।
কামাল উদ্দিন
আপনার জন্যও শুভ কামনা সব সময় আপু।
নীরা সাদীয়া
খামে করে কি দুঃখ ফুরোবার চিঠি এলো নাকি? চাকরীর চিঠি হয়ত। বেশ লাগলো গল্পটি। সত্যি, আঁধার যত ঘনিয়ে আসে, প্রভাত তত কাছে আসে।
রেহানা বীথি
দুঃখ কখনও ফুরোয় না। সুখ-দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। চাকরি, দুঃখজয়ের স্বপ্ন, দুঃখকে পাশে রেখেই সুখের খোঁজ পাওয়া…. সব ওই একটি খামেই বন্দি।
গল্প ভালোলাগায় খুশি ভীষণ।
ভালো থাকুন সবসময়, শুভ হোক সব।
হালিম নজরুল
কাঁদুর বাবা মারা গেলেও মেয়েটির আশ্রয় হওয়ায় শান্তি পেলাম।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
খুব সুন্দর একটি গল্প শেষ করলেন আপু।
বাবার মৃত্যুর সময়ে নিয়ে এলো হবু স্ত্রীকে, যদিও এটি কাঁদু জানতো না।
নির্ভরতা একটি বিশাল ব্যাপার, এটি কিভাবে যেন হয়ে যায়।
আপনি গল্প অনেক ভালো লেখেন।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভালো থাকবেন সবসময়।
ইঞ্জা
খুব উচ্চ মানের লেখা দিলেন আপু, শেষাংশ চমৎকার হয়েছে।
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা আপু।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন সবসময়।
ইঞ্জা
শুভকামনা প্রিয় আপু।