
এই ঘটনার পর কয়েক দিন নিজেই যেন নিজের কাছে লজ্জিত হয়ে পড়েছিল কাঁদু। কেমন করে সে যেতে পারলো অমন একটা জায়গায়? রুস্তম যায় ঠিক আছে, তাই বলে তাকেও যেতে হবে? ছিঃ!
এরপর কয়েকদিন অপরাধীর মতো মুখ করে এড়িয়ে যেতে লাগলো রুস্তমকে। কিন্তু কাজ হয়নি। বন্ধু বলতে একমাত্র রুস্তমই যা পাত্তা দেয় কাঁদুকে। আর সবাই তো ভদ্রলোক হয়ে গেছে। ভালো চাকরি পেয়ে একটু উঁচুতে উঠলে দরিদ্র সহপাঠীকে এড়িয়ে যাওয়াই উচিত। ওদের হৃদ্যতা তখন চাঁছাছোলা ভদ্রলোকদের সাথে। কাঁদুর মতো ছেলের দিকে তারা শুধু করুণার চোখেই তাকাতে আরাম পায়। কাঁদুর জন্যে আছে রুস্তম। যাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেও যাবে না, দু’ঘা বসিয়ে দিলে একটু হম্বিতম্বি করেই ঠাণ্ডা। চ্যাঙড়া বড় ভালো। দোষের মধ্যে ওই একটু মেয়েমানুষের লোভ। সে তো কতজনেরই থাকে! তবে এমন মন পরিষ্কার ছেলে আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না। এই একটা কারণেই কাঁদু ওর ওপর রাগ করে থাকতে পারে না। সেবারও পারেনি। কয়েকদিন এড়িয়ে যাওয়ার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছিল দুম করে একদিন সুরভীর ঘরে হানা দিয়ে। তবে রুস্তমের অজান্তেই। তারপর গেছে সে ওখানে, বার বারই গেছে আর ধীরে ধীরে অবাকও হয়েছে। সুরভীর মতো সরল মনের একটা মেয়ে এ লাইনে কেন? শুধু যে সরল তাই-ই নয়, সমীহ আদায় করে নেয়ার মতো একধরনের সূক্ষ্ম রুচিবোধও আছে মেয়েটার মধ্যে। ভাবা যায়? এই সুরভী মেয়েটার সাথে কেন যেন নিজের মায়ের চরিত্রের মিল পায় কাঁদু। মা যেন তার শশুরের আভিজাত্যের খুঁটি ধরে আছে আজও। এত অভাব, তবু পুরোনো কেতা বজায় রাখতে চায়। চেহারা, কথাবার্তা আর আচরণে রুচির আভা ছড়ায়। এই মেয়েটিরও। হয়তো কোনও রুচিশীল, অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে ছিল, অভাবে পড়ে এপথে এসেছে। কে জানে! মনে এসেছে বটে কথাটি বার বার, কিন্তু কখনও জানতে চাওয়া হয়নি। সুরভীও বলেনি কোনওদিন।
ঘন কুয়াশা ফুঁড়ে কেউ কেউ আসছে ওদিক থেকে। বোঝা যায়, নেশাগ্রস্ত তারা। অসংলগ্ন পদক্ষেপ, মুখে খিস্তির সাথে বেরিয়ে আসছে মাতানো তাড়ির গন্ধ। সময়ের সাথে সাথে এসব সয়ে গেছে কাঁদুর। এই অন্ধকার মাঠ এখন বেশ পরিচিত ওর। ওটা পেরিয়ে যে ঘরের সারি, সেগুলো সম্পর্কে ধোঁয়াশা নেই আর, নেই ভয়ও। এই তো, আর কিছুটা পথ হাঁটলেই আঁধার ভেদ করে চোখে পড়বে ঘরগুলোর টিনের বেড়ার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে পড়া টিমটিমে আলো। ও ঢুকে পড়বে তারই একটাতে। সুরভী নামের পতিতা মেয়েটা আজ ওকে পেয়ে অন্য দিনগুলোর তুলনায়, অন্য পুরুষ তার ঘরে আসার তুলনায় একটু বেশি খুশি হবে। বোঝে কাঁদু, ধীরে ধীরে সুরভীর প্রতি যে দুর্বলতা তৈরি হয়েছে ওর, সেই একই দুর্বলতা যেন সুরভীরও। কাঁদুর চোখে কিঞ্চিৎ সমীহ দেখেছে বলেই বোধহয়! প্রতিরাতে অচেনা পুরুষের কাছে শরীর মেলে দিয়ে টাকা রোজগার করে যে মেয়ে, তাকে সমীহ দেখাবে কে? তাই তো কাঁদুর সমীহ অনুভব করে নিজের মনে একটা ছোট্ট জায়গা তৈরি করেছে সে তার জন্যে। যে কয়দিন কাঁদু আসে না, প্রতীক্ষায় থাকে সুরভী। আকারে ইঙ্গিতে সেকথা কাঁদুকে বুঝিয়েছেও সে। আর বুঝতে পেরে কাঁদুও যেন প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়েটির ওপর।
পুরো মাঠ জুড়ে যে আঁধার, তা চলতে চলতে চোখে সয়ে যায়। যেদিন জ্যোৎস্না থাকে, মাঠটাকে মনে হয় যেন দুধের নদী। ছোট এ শহরের বুকটাকে দু’ভাগ করে চলে গেছে যে পিচঢালা পথ, ওপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নেমে যেতে হবে ঠিক বাঁ হাতের ঢালু বেয়ে। আর নামলেই বিশাল মাঠ, মাঠ পেরোলেই সুরভীদের গায়ে গা লাগানো ঘরগুলো। তবে এই শীতের রাতে মাঠ পেরোনো মুখের কথা নয়। কনকনে হাওয়া যেন ছুরি চালাচ্ছে গায়ের চামড়ায়। পায়ে একজোড়া পাতলা চটি, গায়ে নেই সোয়েটার… খদ্দরের চাদরে আর কতটুকু শীত আটকায়! চারিদিক থেকে দুর্দান্ত বেগে ছুটে আসা শীতল হাওয়ারা ফুঁড়ে দিচ্ছে কাঁদুর দৈন্য লোমকূপ। চাদরটা আরও খানিকটা জড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে শুনতে পেলো…
চলবে……
২২টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আপনি খুব সুন্দর করে সাজিয়ে লিখতে পারেন, পড়ে মুগ্ধ হই। ভালো থাকুন মিষ্টি আপু। শুভ কামনা রইলো
রেহানা বীথি
খুব খুশি হলাম জেনে। ভালো থাকুন আপনিও আপু।
ছাইরাছ হেলাল
লেখায় একটি ভিন্ন দিক সুন্দর করে তুলে ধরেছেন, তেমনি কাঁদুকেও। মাকে তুলে এনে অন্য মাত্রা যুক্ত করেছেন।
চলুক,
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। ভালো থাকবেন সবসময়।
সুপায়ন বড়ুয়া
বুঝি গো রাত পোহাল
সে যে অনন্য রচনা শৈলী
ভাল লাগে তাই এই করোনাকালে
শুভ কামনা আপু।
রেহানা বীথি
আপনার জন্যেও শুভকামনা দাদা।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সুরাইয়া পারভীন
এমন মেয়েকে কেউ সমীহ করে না
আবার নিজের মায়ের সাথে সাদৃশ্য খুঁজে পায় সৌরভীর
একটা পরিণতির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাবে ওরা?
বরাবরের মতই দারুণ।
পরের পর্বের অপেক্ষা
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ। দেখা যাক কি হয়! ভালো থাকবেন সবসময়।
ফয়জুল মহী
অনন্যসাধারণ লেখা। শুভেচ্ছা । দোয়া করবেন।
রেহানা বীথি
দোয়া করবেন সবার জন্য।
ভালো থাকুন সবসময়।
নীরা সাদীয়া
লেখার হাত দারুন, তা আগেও বলেছি। যত পড়ি, তত অবাক হই। কী করে পারেন? যেন মনে হয় চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছি।
রেহানা বীথি
খুব খুশি হলাম। অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকুন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বেশ ভালো লেখনী দিদি
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
কামাল উদ্দিন
কাদু ও তাহলে শেষ পর্যন্ত ওখানেই ঠিকানা করে নিল। এমন এক পর্যায়ে গল্পটা থামালেন আপু, পরবর্ত পর্বের অপেক্ষায় থাকতেই হবে।
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন সবসময় ভাই।
সাথে থাকুন।
কামাল উদ্দিন
সাথেই আছি আপু, এগিয়ে যান।
তৌহিদ
আসলে কাঁদু সবসময় অবহেলার শিকার হয়েছে বলেই এমন আবেগ কাজ করছে তার মনে। সরল সোজা মানুষ মনে হচ্ছে তাকে।
রেহানা বীথি
পড়েছেন দেখে খুশি হলাম ভাই।
ভালো থাকবেন সবসময়।
ইঞ্জা
বেশ গুঁছালো লেখা, পড়তে বেশ ভালো লাগলো আপু, আগের পর্ব পড়া হয়নি, যায় পড়ে আসি।
রেহানা বীথি
খুশি হলাম ভাইয়া।
ভালো থাকবেন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
শ্রদ্ধা সন্মান সবাই চায়, অবহেলা আর স্বার্থপরতার আধিক্য যেখানে সেখানে সন্মান পেলে তাকে বুকের গহীনে নেবেই।
ধারাবাহিক গল্পের পর্ব খুবই ভালো লাগছে।
পরের পর্ব এখনই পড়বো।
শুভ কামনা।