
আজ বিকেলে কাঁদু রোজকার মতই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। মা বলেছিল একটু গুড় আনিস তো ফেরার সময়, কাল পাকোন পিঠা বানাবো। বলেছিল বটে, হাতে একটা টাকাও দেয়নি। চারজন প্রাইমারীর বাচ্চাকে বাড়িতে গিয়ে পড়িয়ে যা পায়, সবটাই প্রায় দিয়ে দেয় মা’কে। নিজের বিড়ির খরচ সামলে কিছু কি থাকে পকেটে? গুড় কোত্থেকে কিনবে? বিভিন্ন জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করতেও খসে যায় বেশ কিছু টাকা। তাছাড়া আজ সুরভীর কাছে যাওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি সে। না না, গুড় কিনে নষ্ট করার মত টাকা আজ নেই ওর কাছে।
এমন অসময়ে গুড়ের কথাটা মনে হওয়ায় মনে মনে তেঁতে উঠলো সে নিজের ওপর। কী জীবন! একটু গুড় কেনার পয়সা জোটে না?
ঘড়ি নেই হাতে, থাকেও না কোনদিন। সময় দেখার জন্য আড়াই ইঞ্চির মোবাইলটাই ওর ভরসা। সেটাও চার্জশূন্য হয়ে নিভে আছে প্যান্টের পকেটে। ক’টা বাজলো কে জানে! রাত দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে না পারলে তো মা আবার সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দেবে। তখন আবার সেই কার্নিস বেয়ে ছাদে ওঠো, তারপর সন্তর্পনে মই বেয়ে উঠোনে নেমে সুড়ুৎ করে নিজের ঘরে ঢুকে যাও। এই করতে গিয়ে একবার পায়ে জোর চোট পেয়েছিল। তবুও অগত্যা!
কাঁদুদের বাড়িটা একতলা, দালান।
ছ’ খানা ঘর আর তার ওপর পোক্ত ছাদ। তবে সিঁড়ি নেই। ছাদে ওঠার দরকার পড়লে মই বেয়ে উঠতে হয়। ছাদে ওঠার খুব একটা দরকার পড়ে না অবশ্য , বাড়ির বিশাল উঠোনটার কারণে। আগে তো ধান শুকোনো, বছরে একবার কুমড়োর বড়ি দেয়া, আচার রোদে দেয়া এ কাজগুলো উঠোনেই হত। তবে এখন ধান টানের বালাই নেই। জমি থাকলে তো থাকবে ধান। সেসব কবেই উড়ে গেছে! কষ্টেসৃষ্টে আচার আর বড়ি দেয়া চলে অবশ্য। গাছের আম আছে, আর বর্ষাকালে কুমড়ো গাছের ভীষণ বাড়াবাড়িও হয়। কচিগুলো খেয়েও চুন ধরে বেশ কিছুতে। বড়ি তো দেয়াই যায়।
বেশ কয়েক কাঠা জায়গার ওপর ওই বাড়ি নাকি নির্মান করেছিলেন ওর দাদু। আশেপাশে বিস্তর ফাঁকা জায়গা আর সে ফাঁকা জায়গায় রয়েছে ছায়াদায়িনী উঁচু উঁচু বৃক্ষ। আম, কাঁঠাল, নিম, মেহগনি এসব। যে কেউ ওদের বাড়িটা দেখলে অবস্থাপন্ন লোকের বাড়ি বলে ভুল করতেই পারে। আর এজন্য দায়ী ওর দাদু। বুড়ো ছিল বটে মোটামুটি ধনি। কাঁদুর বাপ ছিল তার একমাত্র সন্তান। জমিজমা যা রেখে গেছিল, তাতে কাঁদুর বাপের ছেলেপুলেরা দিব্যি খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারতো। এই সুখেই বুড়ো নিশ্চিন্তে ওপারে চলে গেছে। কিন্তু তার ছেলে যে ঠিক সংসারী নয়, একেবারে উড়নচণ্ডী, তারপরেও বুড়ো নিশ্চিন্তে চোখ বুঁজলো কেন, সেটাই আশ্চর্যের। জীবিতকালে কিছুটা চোখেচোখে রেখেছিল, তবুও সুযোগ পেলেই ওড়ানোর তালে থাকতো। যেটুকু লেখাপড়া শিখেছিল, চাকরি একটা জোগাড় করা কোনও ব্যাপারই ছিল না। কিন্তু যার বাপের সম্পত্তির অভাব নেই, সে কেন চাকরি করবে? পরের গোলামী করা আর নিজের গলায় ছুরি চালানো একই কথা বিবেচনা করে কাঁদুর বাপ ওপথ মাড়ায়নি। টাকার দরকার হলে তো জমিই আছ, বেচে দিলেই হল! এই বেচতে বেচতেই সর্বস্বান্ত। যখন আর বেচার কিছু নেই, বাড়িটায় নজর লাগলো। কাঁদুর মা যদি বটি হাতে তেড়ে না যেত, তাহলে এতদিনে গাছতলায় দিন কাটাতে হতো। জমি নেই , বাড়িটাও বেচতে দিল না বউ, এ আঘাত সইতে পারেনি বাপটা। বুকের বাঁ দিক চেপে ধরে দড়াম করে পড়ে গেল একদিন। সেই থেকে অবশ শরীরের বাঁ দিক। এখন হাতটা সামান্য নাড়াতে পারে, কিন্তু পা একেবারে অচল।
দিন দিন অচল হয়ে যাচ্ছে বাড়িটাও। সিমেন্ট, বালি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে এখান সেখান থেকে। দেয়ালের ইট আর ছাদের মরচেপড়া রড দাঁত খিঁচিয়ে হাসে। তবু শান্তনা, মাথার ওপর ছাদটুকু আছে।
মা ওটার বলেই মন শক্ত রাখতে পেরেছে হয়তো। বড় ছেলে কাঁদু যদি একটা চাকরি পায়, আবার সুখের মুখ দেখবে, এমন আশা তার সবসময়ের। বাকি দুই ছেলে বাপের মতই উড়নচণ্ডী। কী করে বেড়ায় তারাই জানে, বাড়িতেও আসে না ঠিকমতো।
মিশকালো মাঠটা পেরিয়েই পাশাপাশি অনেকগুলো ঘর গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওরই একটাতে সুরভী থাকে। শরীরের টানে একদিন রুস্তমের সাথে গিয়েছিল কাঁদু ওখানে। গিয়েই কেমন যেন চুপসে গেছিল সে। জীবনে প্রথম তো! সুরভী নামের মেয়েটার আধখোলা বুক দেখে কেমন যেন শুকিয়ে গেছিল গলা। সেই শুকনো খরখরে গলায় বহুকষ্টে বলেছিল, একটু পানি চাই।
রুস্তম বেজায় আমোদ পেয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলেছিল, কী রে, ভয় পেয়ে গেলি? শালা.. … তুই না পুরুষ মানুষ! ভয় পেলে চলে? নে, ঝটপট কাজ সার!
আবারও শুকনো গলায় বলেছিল কাঁদু, নাহ্, বাড়ি চল!
সে রাতে বাড়ি চলেই গেছিল কাঁদু। রুস্তমও, ফেরার পথে পুরোটা সময় গজরগজর করতে করতে…. শালা, মেনি বেড়াল! তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। না জোটাতে পারবি চাকরি, না পাবি মেয়েমানুষ। বিয়েও করতে পারবি না তুই সারাজীবন, দেখে নিস। ধুর, খামোখা তোর জন্য নিজের সময়টা নষ্ট করলাম! যা শালা বাড়ি যা, বাড়ি গিয়ে মায়ের আঁচলের তলায় ঘুমিয়ে থাক!
চলবে—–
২৩টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
কঠিন বাস্তবতা দেখাচ্ছেন আপু । ভালো লাগলো। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন শুভকামনা রইলো
রেহানা বীথি
আপনিও ভালো থাকবেন আপু। সুস্থতা কামনা করি সবসময়।
সুরাইয়া পারভীন
এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করলাম এই পর্বও
দারুণ লিখেছেন আপু। পরের পর্বের অপেক্ষায় শুভকামনা রইলো
ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন সবসময়
রেহানা বীথি
আপনিও ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন সবসময়।
সুপায়ন বড়ুয়া
বেকার জীবনের করুন কাহিনী
ভালই তুলে আনলেন।
শুভ কামনা আপু। ভাল থাকবেন।
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ দাদা।
ভালো থাকুন সবসময়।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বেকার জীবনে করুণ কাহিনী দেখিয়ে দেয় বাস্তবতা।
ধারাবাহিক বর্ণনা বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়…..
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ভালো থাকবেন সবসময়।
তৌহিদ
কাঁদু কি সুরভীর প্রেমে পড়েছিলো নাকি? আহা বেচারা!! পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম আপু। ভালো লাগছে পড়তে।
রেহানা বীথি
পড়তে ভালো লাগছে জেনে ভালো লাগলো ভাই। ভালো থাকবেন সবসময়।
ফয়জুল মহী
এই জীবন । পড়ার জন্য আগ্রহপূর্ণ হচ্ছি ।
রেহানা বীথি
জেনে ভালো লাগলো। ভালো থাকবেন সবসময়।
মিজভী বাপ্পা
খুব ভালো হয়েছে। ধন্যবাদ এমন একটি লেখনি উপহার দেয়ার জন্য 🙂
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
নীরা সাদীয়া
আপনি বেশ ভালো লিখেন। অসাধারণ দক্ষতা মিশিয়ে কাঁদুর বর্ণনা দিয়েছেন। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
রেহানা বীথি
খুশি হলাম।
ভালো থাকুন সবসময়।
ছাইরাছ হেলাল
গ্রামের যে চিত্রটি এঁকেছেন তা হুবহু ঠিক আছে।
কাঁদুর জন্য অপেক্ষা করি।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভালো থাকবেন।
হালিম নজরুল
কাঁদুদের বাড়ির বর্ণনা দেখেই বুঝেছি আপনার গল্পটা চমৎকার হবে।
রেহানা বীথি
সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
উড়নচণ্ডী ছেলেরা আয়ের সবচেয়ে ভালো উৎস ভাবে বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তি,
দলিলে সই করলেই টাকা, কেন কষ্ট করবে সে?
বাড়িটার সুন্দর একটি বর্ননায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম,
কাঁদু দেখি কোনো কাজেরই না।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম,
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
খুশি হলাম ভাইয়া।
ভালো থাকবেন সবসময়।
কামাল উদ্দিন
পরের গোলামী করা আর নিজের গলায় ছুরি চালানো একই কথা বিবেচনা করে কাঁদুর বাপ……জটিল ভাবনা।