ছোটবেলায় খুব ছবি আঁকতাম। পেন্সিল দিয়ে যা ইচ্ছে তা-ই এঁকে এঁকে ভরে ফেলতাম খাতার পাতা। অর্থহীন সেসব ছবি। তারমধ্যে কোনোটা হয়তো সামান্য অর্থ প্রকাশ করে ফেলতো আমার অজান্তেই। খুশি হতেন আব্বা-আম্মা। তাঁরা এতোটাই খুশি হতেন যে, বাড়িতে আসা অতিথিদের সামনে গর্বভরে মেলে ধরতেন আমার অজান্তে অর্থ পাওয়া ছবিগুলোর পাতা। অতিথিরা স্নেহপরবশ হয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন, বাহ্, চমৎকার আঁকার হাত তো! এত ছোট মেয়ে অথচ কী সুন্দর করে ছবিতে তুলে ধরেছে বিষয়টিকে! বড় হলে নিশ্চয়ই জীবনে অনেককিছু করবে!
আনন্দে চোখ ভিজে যেত আমার। বুক ভরে যেত বিশ্বাসে, সত্যিই আমি অনেককিছু করতে পারবো একদিন!
সময় গড়ায়। সেই খাতার পাতা ছবিতে ভরে ফেলা আমি দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠি। আমি গান শুনি, গানে মজে যাই। ছবির খাতাটা শূন্য পড়ে থাকে। ক্যাসেট প্লেয়ারে নানান শিল্পীর গান শুনে শুনে গাইতে থাকি। কেউ কেউ বলে, বেশ ভালো গাও তো, গান শেখো? না, গান শিখিনি। শেখার চেষ্টাও করিনি তেমন। তবে আমি গান অন্তঃপ্রাণ হয়ে যাই। সেটা প্রায় নেশার মতো। নেশাটা ঠিক কতদিন ছিল মনে নেই, তবে ধীরে ধীরে একসময় তা জায়গা বদল করে নেয়। আকৃষ্ট হয়ে পড়ি বই পড়ার প্রতি।
স্কুলে বন্ধুদের কাছ থেকে নিয়ে তো বটেই, কিনেও পড়েছি প্রচুর বই। প্রকাশ্যে কিংবা পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে বই পড়ার এই নেশাটা বয়েও বেড়িয়েছি দীর্ঘদিন। ছাত্রজীবন শেষের আগেই শুরু হয় সংসারজীবন। না চাইতেও জড়িয়ে পড়ি সংসারের নানা জটিলতায়। জড়াতেই হয়! অন্তত আমাদের সমাজে মেয়েদের না জড়িয়ে কোনও উপায়ও থাকে না। একসময় লেখাপড়া শেষ হয়, সন্তানের মা হই, কর্মজীবনে প্রবেশ করি। সিদ্ধান্ত নিই, সরকারি চাকরির চেষ্টা না করে মিয়া-বিবি একসাথে প্র্যাকটিস করবো। কারণ, চাকরি করলে বিভিন্ন জায়গায় ছুটে বেড়াতে হবে আর নিজ জেলায় কোনদিনই পোস্টিং হবে না। মিয়ার যেহেতু নিজ জেলা ছেড়ে নড়ার উপায় নেই, অতএব আমিও নড়বো না। থেকে গেলাম, চেষ্টা করলাম সংসার সাজাতে। এই সাজাতে গিয়ে এতটাই বিভোর হয়ে যাই যে, বই পড়ার নেশাটা আমার কেটে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। না কেটে উপায় কী! সেই ভোর থেকে শুরু হয় জীবন থামে মধ্যরাতে। ছোট ছোট দুই মেয়ে, তাদের স্কুল, লেখাপড়া, অসুখ হলে নির্ঘুম রাত, নিজের কর্মক্ষেত্র। জীবন থেকে বিশ্রাম জিনিসটাই যেখানে হারিয়ে গেছে, সেখানে বই পড়ার কথা তো চিন্তাতেই আনা যায় না!
একটু একটু করে মেয়েরা আমার বড় হতে থাকলো। আমারও একটু একটু করে জুটতে লাগলো অবসর। মনে একটু যেন খোলা হাওয়া লাগতে শুরু করলো। এমন সময়ে আমার এক বন্ধুর কথায় মর্মাহত হলাম ভীষণ। বন্ধুটি বললো,
“তুই কী রে? তোর একমাত্র বড় বোন ডাক্তার, আবার বিসিএস ক্যাডারও, তুই কিনা তারই বোন হয়ে সরকারি চাকরির না করে এখানে পড়ে আছিস?”
আমি সরকারি চাকরি করছি না সে কারণে নয়, মর্মাহত হয়েছিলাম বন্ধুটির বলার ভঙ্গিতে। তার খোঁচাটা উপলব্ধি করে অবাকও হয়েছিলাম ভীষণ। সে নিজে বিসিএস পাশ করলেও তার ভাই-বোনেরা কিন্তু কেউ-ই তা করেনি! সেকথা কি সে ভুলে গেছে? যাইহোক, এসব প্রত্যেকের আলাদা আলাদা উপলব্ধির বিষয়। যে যেমন ভেবে সুখ পায়, সে তা পাক না! আমি তো বাবা দিব্যি সুখে আছি!
দেখেছেন, কথা কোনদিক থেকে কোনদিকে চলে গেল! বলছিলাম টুকরো টুকরো অবসর জোটার কথা, সেই অবসরে কী কী করে ফেললাম সেসব না বলে কীসব আবোল তাবোল!
অবসরে আবার বইয়ের ঝাঁপিতে উঁকিঝুঁকি দিতে দিতে পেয়ে গেলাম মুখবই। কত কথা বলে মানুষ এই মুখবইতে! কত গল্প-কবিতা, দিনযাপনের খুঁটিনাটি, কত আনন্দ-বেদনা! পড়ি আর টুক টুক করে মন্তব্য দিয়ে যাই। এই মন্তব্য দেখেই শ্রদ্ধেয় পার্থ সেন মহাশয় বন্ধু-অনুরোধ পাঠান এবং তাঁর গ্রুপ ‘শনিবারের আসর’ -এ আমাকে একরকম জোর করেই যুক্ত করেন। কী ভালো একটা গ্রুপ! সবাই কত সুন্দর সুন্দর লেখা লিখেন ওখানে! আমি শুধু পড়ি আর অবাক হই। মনে ভরসা নিয়ে একদিন একটা লেখা আমিও দিলাম। খুবই আবোলতাবোল একটা লেখা। তাতেও গ্রুপের সবার এত ভালোবাসা পেলাম যে বলার না! সাহস বেড়ে গেল নিমেষেই। একে একে অনেক লেখা লিখে ফেললাম ওখানে। নিজের প্রতি অনাস্থাটা ধীরে ধীরে রূপ নিল আস্থায়। পাঁচটি বছর অতিক্রম করার আগেই টুকটাক লেখা পত্রিকায় বেরোতে শুরু করল। ভালোবাসা পেলাম অনেকের। নিজের প্রতি আস্থা আরও একটু বাড়লো।
আজ মনে হয়, শুধু পড়া নয়, লেখালেখিটাও আমার বর্তমান নেশা। যে নেশায় মিশে আছে অনেকখানি ভালোলাগা। জীবনে সাফল্যের মানেটা সবার জন্য এক নাই বা হল! হেরে না গিয়ে আত্মসম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারা যায় যে কোনও অবস্থান থেকেই। হাত বাড়িয়ে ছোঁওয়াও যায় ভালোবাসার নীল আকাশ।
২৪টি মন্তব্য
রেহানা বীথি
লেখাটার পাশে অমন কমলা রঙের লম্বা দাগ চলে এলো কেন? কী যে করি!
মনির হোসেন মমি
হা হা হা
রেহানা বীথি
লম্বা দাগ গায়েব করার জন্য ধন্যবাদ মমি ভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
একান্ত অনুভূতিতে যা বললেন তা যেন প্রতিটি মেয়ের কথা। এতো সুন্দর করে কিভাবে লেখেন? অবাক হয়ে যাই। ধন্যবাদ আপু। ভালো থাকবেন। শুভ সকাল
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন আপনিও আপু।
শুভকামনা রইল। শুভ সকাল।
আলমগীর সরকার লিটন
চমৎকার লেখেছেন বীথি আপু
অনেক শুভেচ্ছা রইল———
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী
সুকোমল ভাবনার অনন্য লেখা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
মনির হোসেন মমি
ওরে বাপ্রে এতো এতো বাক! চিত্রশিল্পী,কণ্ঠশিল্পী,লয়ার,সব শেষে লেখক-সব অভিজ্ঞতাতো দেখছি আপুর ঝুড়িতেই।সাবলিল ভাষায় একান্ত অনুভুতি খুব ভাল লাগল।আপনার সাফল্য কামনায় শুভ কামনা রইল।
রেহানা বীথি
আগেরগুলো সব ভুয়া ভাই। শুরুতেই শেষ।😃
নেহাৎ পেটের দায় আছে, নইলে ওকালতিটাও টিকতো কিনা সন্দেহ।
যাইহোক, ভালো থাকবেন সবসময়।
ছাইরাছ হেলাল
হুট করে সব্যসাচী বললে বেশি-ই বলা হবে, সেদিকে গেলাম না।
তবে এখানে কী করে আমরা লেখা পড়ার সুযোগ পেলাম, তা কিন্তু বলেন নি।
আপনি নিজ আনন্দে লিখে আমাদের তা পড়তে দিচ্ছেন, সেটিও অনেক পাওয়া একটি।
রোজ লিখুন এবার থেকে। আনন্দের উচ্ছাসে।
রেহানা বীথি
এখানে যুক্ত হওয়ার বৃত্তান্ত আগেই কোনও এক লেখায় উল্লেখ করেছিলাম ভাইয়া, তাই আর লিখিনি। সোনেলা আমার ভালোবাসার উঠোন। সবার আন্তরিকতায় মুগ্ধ আমি। হাবিজাবি যা-ই লিখি, এখানেই দিই। আপনারাও ভালোবেসে পড়েন।
ভালো থাকুন ভাইয়া।
ইঞ্জা
সুন্দর অনুভাবী অনুভূতি পড়ে খুব ভালো লাগলো আপু, সময়ে সময়ে মানুষ ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিজ আঙ্গিনায়, এরপরেও এগুতে হয় নিজের মনের খোরাক যোগাতে।
ধন্যবাদ আপু সুন্দর লেখাটির জন্য।
রেহানা বীথি
ভাইয়া, ভালো থাকবেন সবসময়।
দোয়া করবেন আমার জন্য।
ইঞ্জা
সবসময় দোয়া আপু।
সুপায়ন বড়ুয়া
অনেক গুনে গুনবতি
আপু আমার কোমল মতি
চালিয়ে যান উকালতি।
নামটা আপুর রেহানা বিথী।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
কী সুন্দর করে বললেন দাদা।
ভালো থাকুন সবসময়।
সাবিনা ইয়াসমিন
সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় শখ / নেশা। নিত্ত-নতুন নেশা, ভালো লাগায় আমরা মিশে যেতে থাকি প্রতিক্ষণে। তবুও কি জানি একটা রয়ে যায়, স্মৃতির পাতা খুলে আমরা পুরোনো নেশাতেও মগ্ন হই কিছু সময়।
আপনার ভাবনা/ কর্মের বহিঃপ্রকাশ পড়ে ভালো লাগলো আপু।
শুভ কামনা 🌹🌹
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন আপু।
জিসান শা ইকরাম
আমাদের সমাজে নারীরা শখ পুরন করার তেমন সময় পায়না। আমরা সংসারটা তাদেরকে দিয়ে নিশ্চিন্ত হই। যেন এটিই তাদের একমাত্র কাজ।
শখ পাল্টে যায় সময়ের সাথে সাথে।
আপনি সংসার সামলাচ্ছেন, ওকালতি করছেন আবার লিখছেনও। লেখা লেখির সাথে যুক্ত রয়েছেন বলেই আমরা আপনাকে পেয়েছি সোনেলার উঠোনে।
একান্ত অনুভুতি চমৎকার হয়েছে,
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সঞ্জয় মালাকার
সুন্দর অনুভাবী অনুভূতি পড়ে খুব ভালো লাগলো দিদি,
শুভ কামনা🌹🌹
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন দাদা।