স্মৃতি যখন ঋত্বিক ঘটকের,
ভাবতে হবে বৈকি….
—————————————–
“মেঘে ঢাকা তারা” —
প্রথম যেদিন সিনেমাটা দেখি, ঘটনার গভীরতা কিংবা সিনেমা তৈরিতে কিংবদন্তীদের সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না আমার। কারণ তখন বয়স কম, ভাবনা ও বোধের গভীরতাও স্বাভাবিকভাবেই কম। দ্বিতীয়বার যখন সিনেমাটি দেখি, একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাই। দেশভাগের সময়কার এতটা জীবন্ত চিত্রায়ণ সম্ভব! এতটা নিখুঁতভাবে চরিত্রগুলোর বেদনাকে সিনেমায় তুলে ধরা, তাদের জীবনযাপন, অতিক্ষুদ্র সুখকর অনুভূতির সূক্ষ্মতম বহিঃপ্রকাশ, কেমন করে কেউ চলচ্চিত্রে ধারণ করতে পারেন! যে পারেন, যাঁর দ্বারা এই অসাধ্য সাধন হয়, তাঁকে সেই মুহূর্তে কেন যেন অপার্থিব কেউ বলে মনে হল।
আমরা সবাই জানি, সেই অপার্থিবজন হলেন ‘ঋত্বিক ঘটক’ এবং তাঁর মতো মানুষের স্পর্শ পেয়ে বাংলা চলচ্চিত্র পেয়েছে এক অনন্য উচ্চতা। বাংলা চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে তিনি আমাদেরকে দিয়ে গেছেন অমূল্য সব সম্পদ। প্রকৃতির নিয়মে তিনি এসেছিলেন এ পৃথিবীতে, আবার প্রকৃতির নিয়মেই একসময় হারিয়ে গেছেন আমাদের মাঝ থেকে। রয়ে গেছে পৃথিবী, রয়ে গেছি আমরা, রয়ে গেছে তাঁর সৃষ্টি। যেসব জায়গায় তিনি বসবাস করেছেন, সেসব জায়গার ধুলোয় আজও মিশে আছে তাঁর অস্তিত্বের ঘ্রাণ। যতদিন পৃথিবী থাকবে রয়ে যাবে তা। মুছে ফেলার চেষ্টা করা বৃথা।
তবু কেন আমরা মুছে ফেলার চেষ্টা করছি?
আজ একটি খবরে বড় বেশি মর্মাহত হলাম। রাজশাহীর মিঞাপাড়ায় তাঁর যে বাড়িটি আছে, যেখানে একসময় কেটেছে তাঁর জীবনের অনেকটা সময়, সেই বাড়িটি ভেঙে নাকি সাইকেলের গ্যারেজ তৈরি হবে! এরশাদ সরকারের আমলে ১৯৮৯ সালে বাড়িটি হোমিওপ্যাথি কলেজকে নামমাত্র মূল্যে ইজারা দেয়া হয়েছিল৷ ইতোমধ্যেই বাড়ির কিছু অংশ ভেঙে কলেজের ভবনও নাকি নির্মান করা হয়েছে । বাকি যেটুকু আছে, সেটুকু ভেঙে গড়ে তোলা হবে সাইকেলের গ্যারেজ।
কী আশ্চর্য!
একজন কিংবদন্তি, যাঁর স্পর্শে বাংলা চলচ্চিত্র ধন্য, যিনি একসময় আমাদের এই রাজশাহী শহরে বসবাস করেছেন, পড়েছেন রাজশাহী কলেজে, আমরা আমাদের সেই গর্বের স্মৃতিটুকু মুছে ফেলতে চাইছি নির্দ্বিধায়?
আমরা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত এই বাড়ি সংরক্ষণ করার জন্য সংস্কারের পরিবর্তে একেবারে নিশ্চিহ্ন করে ফেলতে চাইছি?
এ কেমন আচরণ আমাদের?
অনেককিছুই আমরা হেলায় হারিয়েছি। যার ফলশ্রুতিতে আজ আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি অনেকখানিই কাঙাল। রাজশাহী শহরে এখন একটাও সিনেমাহল নেই। সংস্কৃতির যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আমাদের ছিল আমরা ধীরে ধীরে তা হারিয়েছি অনেকটাই। বলা যায়, প্রায় যেন নিঃস্ব হওয়ার পথে আমরা। অবশিষ্ট যেটুকু আছে, ধরে রাখার চেষ্টা না করলে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যেতে হবে আমাদের।
একসময় যে বাড়িটিতে শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের অনেকগুলো বছর কাটিয়েছেন বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ঋত্বিক ঘটক, তাঁর ভাইঝি প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীও কাটিয়েছেন তাঁর জীবনের কিছুটা সময় যে বাড়িটিতে, সে বাড়িটি ভেঙে ফেলে নিজেদেরকে আরও খানিকটা কাঙাল পরিচিত করাটা কি এতটাই জরুরি?
বিকল্প পথ নিশ্চয়ই খোলা আছে।
দেখার চোখ উন্মুক্ত হোক, ভাবার মন অবমুক্ত হোক আমাদের। প্রত্যাশা এটুকুই।
২৩টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
ধন্যবাদ আপু। আমার কথাগুলোই আপনি লিখেছেন। আমরা গুনের কদর করি না বলেই আজ আমরা মানবিকতা, সামাজিকতা, ন্যায় অন্যায়ের বিচার করতে ভুলে গেছি।
রেহানা বীথি
খবরটা জেনে মনটা খুব খারাপ হয়েছে আপু।
ভালো থাকবেন সবসময়।
সুপায়ন বড়ুয়া
দেখার চোখ উন্মুক্ত হোক, ভাবার মন অবমুক্ত হোক আমাদের। প্রত্যাশা এটুকুই।
আপনার প্রত্যাশা পুর্ণ হোক
শুভ কামনা
রেহানা বীথি
প্রত্যাশা ছড়িয়ে যাক সবার মাঝে।
ভালো থাকবেন দাদা।
মোঃ মজিবর রহমান
কিছুই বলার নাই, আমি শুধু এইটুকুই বলছি, আমরা শুধু নাই নাই করেই যাচ্ছি, আমাদের মাঝে থেকে মানবতা, সহানুভুতিশীল ইচ্ছাটুকু নস্ট হয়ে বেমানুষ হয়ে যাচ্ছি। আর সাহিত্য সংস্ক্রিতি তে এলার্জি ধর্মীয় ভুতিতে আসক্তি।
মাঝে কিছু আছে দুইপাশে থেকে কাটে।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
শুভকামনা।
ছাইরাছ হেলাল
অনেকেই এ বিষয় প্রতিবাদী হয়েছেন যৌক্তিক কারণে।
দেখা যাক এটি শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয় কী না!
আপনাকে ধন্যবাদ এদিকটি তুলে ধরার জন্য।
রেহানা বীথি
প্রতিবাদ সার্থকতা পাক।
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
সাদিয়া শারমীন
আপনার লেখাটি তথ্য সমৃদ্ধ।অনেক কিছু জানলাম। এটাই আজ জানলাম যে ঋত্বিক ঘটক রাজশাহীর বাসিন্দা ছিলেন এবং রাজশাহী কলেজে পড়তেন।ধন্যবাদ আপনাকে।
রেহানা বীথি
ভালোবাসা জানবেন।
ইসিয়াক
মনের কথাই বলেছেন আপু ।
শেষ রক্ষা কি হবে?
শুভকামনা রইলো ।
রেহানা বীথি
শেষরক্ষার প্রতীক্ষাতেই আছি।
ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
এ বিষয়টি ব্লগে সবার কাছে তুলে ধরার জন্যে ধন্যবাদ আপু। এমন স্মৃতি অবশ্যই সংরক্ষণ করা উচিত।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন ভাই।
নিতাই বাবু
দেখা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে রাজশাহীর অনেক জ্ঞানীগুণীজন-সহ আরও অনেক সাধারণ জনগণও প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। তারপরও দেখা যাক, কী হয়!
রেহানা বীথি
রক্ষা হোক ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি।
ভালো থাকবেন দাদা।
সুরাইয়া পারভীন
দেখার চোখ উন্মুক্ত হোক, ভাবার মন অবমুক্ত হোক আমাদের। প্রত্যাশা এটুকুই।
প্রত্যাশা প্রাপ্তিতে পরিণত হোক। ধ্বংস নয় সংরক্ষিত হোক ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি।
রেহানা বীথি
অনেক ভালোবাসা।
ভালো থাকবেন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
তথ্যবহুল লেখা।
ধন্যবাদ দিদি।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
ফয়জুল মহী
অপূর্ব শব্দ সৃষ্টি, পাঠে মুগ্ধ।
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ
জিসান শা ইকরাম
আমরা হলাম সেরা অকৃতজ্ঞ জাতি,
নিজেদের সেরা মানুষদেরও আমরা স্বার্থের কারনে উপেক্ষা করি।
বাড়িটি আর রক্ষা পাবে কিনা জানিনা।