বিলের এপারে আমাদের বাড়ি আর ওপারে আমার বড় দাদু, ছোট দাদুদের বাড়ি। বিলের ঠিক বুক চিরে চলে গেছে মেঠোপথ। ছোট্ট একটা কালভার্ট দু’পাশের সংযোগসেতু। এই বড় দাদু আর ছোট দাদু কিন্তু আমার দাদুর আপন ভাই নন। তাঁরা ছিলেন একে অপরের চাচাতো ভাই। এ কথাটা অবশ্য জেনেছিলাম অনেক পরে। যাক সেকথা। আগে তো টকমিষ্টি স্বাদের দারুণ টুসটুসে বরইগলোর গল্প করে নিই!
মেঠোপথ আর কালভার্ট না ডিঙিয়েও শুধুমাত্র বিল সাঁতরেই পৌঁছে যাওয়া যেতো ছোটদাদুর বাড়ির কান্টায়। আর ঠিক ওই জায়গাতেই ছিল একটা বরই গাছ। যেটা কিনা অদ্ভূত ভঙ্গিতে কিছুটা বেঁকে গিয়ে ছুঁয়ে থাকতো বিলের জল। ছুঁয়ে থাকতো না বলে বিলের জলে গাছটার কিছু অংশ ডুবে থাকতো বলাটাই বোধহয় বেশি জুতসই। তো আমরা যারা কচিকাঁচার দল, তারা এপার থেকে সাঁতরে চলে যেতাম ওপারে। গিয়েই পটাপট বরই পেড়ে প্যান্টে গুঁজে পালিয়ে আসতাম। একরকম চুরিই বলতে পারেন। তবে এ চুরিতে কোনও দোষ নেই, সেসময় আমাদের তাই মনে হতো। তারচেয়ে বরং যার কারণে এই টুসটুসে বরই আমাদেরকে বাধ্য হয়ে চুরি করতে হচ্ছে, মনে হতো, সে-ই বিরাট দোষী। হবে না? এই কচিকাঁচাদের হক ওই টুসটুসে বরইগুলো কিনা আচার বানানোর বাহানায় গাছ থেকে পেড়ে রোদে শুকোনোর পাঁয়তারা করতো সখিনা দাদী!!
বড় রূপসী সখিনা দাদীর ঠোঁটজোড়া সবসময় পানের রসে রঙিন হয়ে থাকতো। তাঁর দুধে-আলতায় গায়ের রঙের সাথে সেই পানখাওয়া লাল ঠোঁট যে কী ভালো লাগতো বলে বোঝানো যাবে না। ছোটদাদু মারা গিয়েছিলেন কতদিন আগে জানি না। দাদীকে সবসময় ধবধবে সাদা শাড়িতেই দেখেছি। কী রূপ আর কী মায়া ওই চেহারায়! কিন্তু সবসময় তো আর মায়া খেলা করতো না! বিশেষ করে ওই বরই চুরির সময়। ভুলবশত দু’চারবার ধরা পড়ে দেখেছি, কী রাগ …. কী রাগ! আমরা তো ভয়ে কেঁদেই ফেলতাম। মাফটাফ চেয়ে কোনওরকমে পালিয়ে আসতাম আর কী! কিন্তু চোর কি কখনও ধর্মের কাহিনী শোনে বলে শুনেছেন আপনারা? আমরাও শুনিনি। দু’তিন দিন ঘাপটি মেরে থেকে আবারও নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তাম বরই গাছে। কত আর রাগ দেখানো যায়, একসময় সখিনা দাদীর কড়াকড়িও শিথিলতা পেতো। কিন্তু ততদিনে বরই শেষ হবো হবো। আবার প্রতীক্ষা নতুন বছরের। এই করতে করতে একসময় বড় হয়ে গেলাম আমরা।
সত্যিই হয়তো বড় হয়ে গেলাম আমরা। কতকিছুই বদলে গেলো! আমার খেলার সাথীদের কারও কারও বিয়ে হয়ে গেলো। গ্রামে যাওয়া কমে যেতে লাগলো আমাদের। গেলেও বিলের ওপারের দাদীদের বাড়ি হয়তো যেতে পারতাম না সবসময়। কোনও সময় দেখা হতো, কিংবা হতো না। এই সময়ের ভেতরেই আমাদের রূপসী ছোটদাদী বেশ অনেকটা বুড়িয়ে গেছেন। মুখের দুধে-আলতা চামড়ায় শতেক ভাঁজ। তবু তাঁর পানখাওয়া ঠোঁটের সরল হাসিটি অক্ষত। দেখলেই জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কাঁদতেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতেন, “তুই এসেছিস, দেখ, আমাকে কেউ জানায়নি!”
একদিন খবর পেলাম, রূপসী ছোট দাদী নেই, চলে গেছেন না ফেরার দেশে। ছুটে গেলাম। নিথর তাঁর দেহ, অসম্ভব ফর্সা মুখে ঠোঁটজোড়া যেন টুকটুকে তখনও। আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে মনে বললাম, দেখো দাদী, আমি এসেছি, তোমার বরই গাছটা যে অরক্ষিত এখন! সবই অরক্ষিত এখন। দাদীর বাড়ি, নানীর বাড়ি। কোথাও কেউ নেই।
পেরিয়ে গেছে আরও কিছু বছর। এখন বিলছোঁয়া বরই গাছটি নেই। একেকটা বাড়িতে হয়েছে একাধিক ভাগ, হয়েছে নতুন নতুন ঘর, এসেছে নতুন নতুন মুখ। তাদের কাছে আমি অতটা চেনা নই। আমাকে দেখলে তারা খুশি হয়, বসতে বলে, চা-নাস্তা দেয়। তেমন করে জড়িয়ে ধরে না কেউ! তাদের এ প্রশ্ন সে প্রশ্নের উত্তর দিই আর দেখি। চারিদিক দু’চোখ ভরে দেখি। দেখতে দেখতে ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। আমি উঠে পড়ি। আমি ফেরার পথ ধরি। ফেরার পথ ধরে আবারও ফিরে তাকাই। মায়ার টানে।
২৮টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি
হুম সবিই মায়ার টান। এই টানটা বোধয় আপনাদের আমাদের বয়সী মানুষদের মাঝেই কেবল বিদ্যমান। বড়ই পেপে পেয়ারা ইত্যাদি চুরির ঘটনাগুলো মনে হয় আমাদের অনেকের জীবনে মধুর স্মৃতি যা ভুলা যায়…যা এ কালে দেখাও যায় না। সেকালে আমরা আধা শহুরেরা বড়ই গাছে ঝাকা দিয়ে বড়ই পেরে খেতাম আর এখন তা অনেকটা(গ্রাম ছাড়া) স্বপ্ন। সেকালের মানুষরা এখনো যদি কেহ বেচে থাকেন মেহমান দেখলে বেশ আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন।কী খাওয়াবে কী করবেন ব্যাতি ব্যাস্ততায় থাকেন যা এ কালে আধুনিকতার নামে যান্ত্রীকতায় এসব পাওয়াই স্বপ্ন।
চমৎকার স্মৃতি চারণ। বেচে থাকুক ভাল থাকুক সকল মুরুব্বিরা।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
সময়-স্রোত বয়ে নিয়ে যায় দূর থেকে বহুদূরে,
ফেলে যাওয়া স্মৃতি শুধুই ডাকে, পিছু ডাকে।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
সত্যিই সবি মায়ার টান।
আজ তা শুধু স্মৃতি।
চমৎকার লেখনী দিদি।
ভালো লাগলো।
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ ভাই।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
মায়ার চাদরে আমরা সবাই আচ্ছাদিত।এ ব্ন্ধন কভূ না যায় ছেঁড়া
রেহানা বীথি
একদম।
ভালো থাকবেন।
নুর হোসেন
এই শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়?
আমি পালিয়ে গ্রামে যেতে চাই!
রেহানা বীথি
শুভকামনা রইল।
নুর হোসেন
ধন্যবাদ, ভাল থাকুন!
সুপায়ন বড়ুয়া
স্মৃতিচারণ শুধু কষ্টই দেয় না
আনন্দ ও দেয় !
লাগল ভাল চালিয়ে যান !
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ
সুরাইয়া পারভিন
মিষ্টি মধুর স্মৃতি রোমন্থন। মায়া ভালোবাসা গুলো এমনি। এরকম কতো শতো বরই পিয়ারা চুরি করেছি। নিজের বড় আব্বার গাছের পিয়ারা চুরি করে খাওয়ার গল্প শুনেছেন কেউ? চোখের সামনে টসটসে পিয়ারা ঝুলে থাকে কিন্তু গাছের পাতা পর্যন্ত ছোঁয়া বারণ। কি আর করার নিরুপায় হয়ে চুরি করে খেতে হতো
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
দারুণ স্মৃতিচারণামমূলক লেখার জন্য প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই আপু। সময়ের আবর্তে এরকমই হয়। ছোটরা বড় হয়, ছোটগাছগুলি বিশাল বটবৃক্ষে পরিনত হয়। সম্পর্কগুলি ফিকে হয়ে আসে। পুরোনো সেই আবেগ আর কাজ করেনা সবার মধ্যে। তবে অনেকদিন পরে যখন যাই সেসব জায়গায় হাতে গোনা দু’একজন জিজ্ঞেস করে- এই তুই অমুকের ছেলে না?
আমি বলি হুম। ব্যাস এতটুকুই। খটকা লাগে তবে মেনে নেই এটা ভেবে- এই হয়তো স্বাভাবিক।
আসলেই কি তাই?
শুভকামনা জানবেন আপু।
রেহানা বীথি
শুভকামনা আপনার জন্যেও ভাই।
জিসান শা ইকরাম
বরই চুরির বর্ননার মাঝে যেন বালিকাদের দেখতে পেলাম।
একদিন কোনো কিছুই আর থাকেনা আগের মত,
স্মৃতির ঝাপি খুলে বসে থাকি
ফিরে ফিরে তাকাই মায়ার টানে
আবার ফিরে ফিরেই আসি।
ভালো লেগেছু খুব
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
সঞ্জয় মালাকার
চমৎকার লেখা, পড়ে ভালো লাগলো খুব।
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ দাদা।
কামাল উদ্দিন
………..এ যেন আমার নানা বাড়ির গল্প। নানা নানীর বিশাল বড় ঘরটা আজ অনেক ছোট মনে হয়। পাশের নতুন ঘরগুলোই যেন অনেক বড়। সেই শত প্রকারের ফুল আর ফলের গাছগুলো আজ আর নাই। এসব দেখলে ভাবলে মনটা যেন হাহাকার করে উঠে। চমৎকার লিখেছেন আপু, মনটাকে নষ্ট্যালজিক করে তুললো।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ ।
ভালো থাকবেন।
কামাল উদ্দিন
আপনিও ভালো থাকুন, সব সময়।
এস.জেড বাবু
বসতে বলে, চা নাস্তা দেয়-
তবুও সেই ছোটবেলার চুরি করে ধরা খাওয়ার মতো মন ভরে না।
////তবু তাঁর পানখাওয়া ঠোঁটের সরল হাসিটি অক্ষত।
চমৎকার অনুভুতি-
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
শফিক নহোর
অনেক স্মৃতি মনে পড়ে গেল । বেশ ভাল লাগলো হে প্রিয় । ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লেখা উপহার দেওয়ার জন্য ।
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন সবসময়।