
২.(দুই)
মৃদুলের বড় মামা ওয়াহিদ মোল্লা বিরাট গেঞ্জাম বাঁধিয়ে দিয়েছেন ; কিছুতেই আধুনিকতার নামে মোল্লা বাড়িতে এসব গান বাজনা চলতে দে’য়া উচিৎ হবেনা। এ সব গান বাজনা বন্ধ করতে হবে; না হলে ওনি চলে যাবেন। সবাই মিলে ওয়াহিদ মোল্লাকে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কেউই তাকে শান্ত করার জন্য এগিয়ে যেতে সাহস পাচ্ছেনা। সাহস করে ওয়াহিদ মোল্লার কাছে এগিয়ে গিয়ে মৃদুল বলে-
: মামা, আপনি একটু এদিকে আসেন। ওয়াহিদ মোল্লাকে হাতে ধরে এক রকম টেনে বড় ঘরের এনে একটা চেয়ারে বসায় মৃদুল। রাগে কেমন ফোঁস ফোঁস করতে করতে ওয়াহিদ মোল্লা বলেন-
: আধুনিকতার নামে যা তা শুরু অইছে এই বাড়িতে। আরে তোরা করিছ। এই ওয়াহিদ মোল্লা মইরা যাওয়ার পর এই সব যা করার করিছ।
কিভাবে বড় মামাকে শান্ত করা যায় তা নিয়ে যেন ভাবনায় পড়ে যায় মৃদুল। ওই দিকে ছেলে-মেয়েরা ও তাকে আলটিমেটাম দিয়েছে; গান বাজনা না হলে নিরামিস গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান তারা বয়কট করবে। এই নিয়ে কোনো আপোস হবে না।
এ বাড়ির একমাত্র বড় মেয়ের বিয়ে, তাই কুমিল্লা থেকে সাউন্ড সিষ্টেম আনা হয়েছে। এ অবস্থায় মামাকে কিভাবে ম্যানেজ করা যায় এই নিয়ে ভেবে পেরেসান হচ্ছে মৃদুল। বড় মামাকেও রাগানো যাবে না, যা করতে হয় তাকে ম্যানেজ করেই করতে হবে। অনেকটা শামুক চরিত্র বড় মামার; শামুকের উপরটা দেখতে শক্ত হলেও ভেতরটা যেমন নরম, ঠিক তেমনি। এমনই ভেবে বড় মামার অবস্থা জরিপ করে মৃদুল। মামা চেয়ারে বসে দুই হাটু খুব নাড়াচ্ছে, এতে বড় মামার সারা শরীর দুলছে। দুলছে চেয়ারটারও। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন ওয়েট ল্যুজিং মেশিনের ওপর বসে আছেন তিনি।
সারা বাড়িতে এই মুহূর্তে থম থমে অবস্থা। সব ছেলে-মেয়েরা তাকিয়ে আছে মৃদুলের দিকে। মুরব্বীকে ম্যানেজ করতে না পারলে তাদের সব আয়োজন সব আনন্দ-ফুর্তি পন্ড হয়ে যাবে। বাড়ির মহিলারা অন্য সব পুরুষকে ধমক ধামক দিয়ে চুপ করাতে পারলেও কেউই সাহস করছে না বড় মোল্লার সাথে কথা বলতে। কারণ শুধু মোল্লাবাড়িই নয় সারা গ্রামের মানুষই ওয়াহিদ মোল্লাকে যুগপৎ ভয় পায় সম্মান করে।
নাসিমার মা ফরিদাবানু একটা গ্লাসে লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে এসে হাজির হয় ওয়াহিদ মোল্লার কাছে। গ্লাসটা এগিয়ে ধরে বলেন-
ভাইজান, নেন শরবতটা একটু খান ভালা লাগব। এই আয়েশা তাড়াতাড়ি মিষ্টির প্লেট নিয়া আয় ত, তোগরে কোন সময় কইলাম ভাইজানরে চা মিষ্টি দে। কারো যদি কোনো খবর থাহে। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ফরিদা বানু।
চটজলদিই ওয়াহিদ মোল্লা গ্লাসটা ধরেন না , কেমন একটা ভাব ধরে থাকেন। ফরিদা বানু শরবত নিয়ে ঘোমটা টেনে দাড়িয়ে রয়েছে। সে ও আড় চোখে ভাসুরের মতিগতি পরখ করে দেখছে। এই পরিবারের মধ্যে একমাত্র ফরিদা ভানু জানে কীভাবে বড় মোল্লার রাগ নামাতে হয়। ওয়াহিদ মোল্লা একেবারেই ক্ষিদা সহ্য করতে পারেন না । ক্ষিদা পেলেও কাউকে কিছু বলবেন না। কিন্তু ক্ষিদাটা একটু বেশী চড়ে গেলেই হলো যত সমস্যা। একটা হইচই না বাধিয়ে ছাড়বেন না। বাড়ির অন্য সবাই ওয়াহিদ মোল্লার এ’রোগটা ধরতে না পারলেও ফরিদা ভানু এ’বাড়িতে বউ হয়ে আসার পর থেকেই ভাসুরের এই বিষয়টা বেশ রপ্ত করেছেন। তাই অযথাই তিনি রেগে গেলে সাথে সাথেই ফরিদা ভানু একটা না একটা কিছু খাবার নিয়ে এসে হাজির হবেন। তাই ওয়াহেদ মোল্লার কাছেও ফরিদা ভানুর সাত খুন মাফ। ফরিদা ভানু যা বলবে তা-ই বিনা প্রতিবাদে মেনে নেন বড় মোল্লা।
এরই মধ্যে আয়েশা ও এক প্লেট বড় বড় মিষ্টি এনে রাখে বড় মোল্লার সামনে। মিষ্টি দেখেই কেমন চকচক করে ওঠে ওয়াহিদ মোল্লার চোখ। মৃদুল বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখছে ব্যাপারটা। সে স্মিত হেসে তাকায় মামীর দিকে। ফরিদা ভানু চোখের ইশারায় হাসতে বারণ করে মৃদুলকে। মামীর ইশারায় সে হাসিটা নিয়ন্ত্রণ করে। ফরিদা ভানু বলে-
: নেন ভাইজান! শরবত আর মিষ্টিগুলা খান। শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে ধরে কৈফিয়তের ভঙ্গিতে ফরিদা ভানু আবার বলে-
: ঝামেলায় ঝামেলায় সময় মত আপনের চা নাস্তা দিতে দেরি হইয়া গেল। আপনে মনে কষ্ট নিয়েন না ভাইজান। সব কাজ ত আমার একলাই দেখন লাগে। কথা কেড়ে নেন ওয়াহিদ মোল্লা-
বাড়িতে এত মানুষ গিজগিজ করছে, সব কাজ তোমার একলা দেখতে হইব ক্যান? আর সবাই কী গায়ে হাওয়া লাগাইয়া ঘুরতাছে নাকি! সবাইরে ডাইকা কাজে লাগাও। ভাসুরের কথা শুনে ম্লান মুখে ফরিদা ভানু বলে-
: না ভাইজান থাক। ওরা সবাই আনন্দ করছে,আনন্দ করুক। সব সময় ত এমন আনন্দ করার সুযোগ পায়না। আজ না হয় একটু বেশী আনন্দই করুক। নেন ভাইজান নেন । আপনে শরবত আর মিষ্টি খাইয়া একটু রেষ্ট লন, না হয় একটু ঘুইরা আসেন। আমরা এই দিক দিয়া নাসিমার গায়ে হলুদের কাজটা সাইরা লই। ওয়াহিদ মোল্লা সরবতের গ্লাসটা হাতে নিতে নিতে বলেন-
: আসলে তুমি হইলা গিয়া এই বাড়িতে সব নষ্টের মূল। ভাসুরের কথার পিঠেই হাসতে হাসতে ফরিদা ভানু বলে-
: আমি আবার কি করলাম ভাইজান!
: তোমার কারণেই এই বাড়িতে আমারে অনেক কিছুই মাইন্যা নিতে হয়।
ভাসুরের কথায় ফরিদা ভানু চাপা হাসি হাসে। হাসতে হাসতে মৃদুলের দিকে চোখ মেরে আবার বলে-
: ভাইজান আমারও কিন্তু এইসব গান বাজনা হৈ হুল্লোর ভালা লাগে না। পোলা মাইয়ারা মিইল্যাই গান বাজনার আয়জনটা করছে। আমি হেগরে বার বার বারণ করছি। বলছি তোমরা এই সব বাদ দেও। বড় ভাইজান কিছুতেই গান বাজনার আয়োজন মাইন্যা নিব না। তারপরও তারা আমার কোনো কথা মানে নাই।
মৃদুল মন্ত্রমুগ্ধের মতো মামীর নির্জলা মিথ্যা ভাষণটি শুনে নিশ্চল হয়ে যায় যেন। সে মামীর দিকে হ্যা করে চেয়ে থাকে। তার এ অবস্থা দেখে ভাসুরের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে মৃদুলকে আবার চোখ মারে। মৃদুল স্বাভাবিক হয়। এতক্ষণ ওয়াহিদ মোল্লা মাটির দিকে তাকিয়ে ফরিদা ভানুর কথা শুনে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ হলে মাথা তুলে ওয়াহিদ মোল্লা বলেন-
: তা হইলে এই কামটা করার সাহস করলো কে। নিশ্চয় এই মৃদুল শয়তানটা।
মামার অভিযোগ শুনে অনেকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে মৃদুল বলে-
: মামা, আমি তো আসলামই কাল। আমি এ সবে থাকবো কি করে।
: শয়তানদের কিছু করতে হলে স্ব শরীরে উপস্থিত হইতে লাগে না। ইশারা মে সব কাফি অইয়া যায় ফরিদা ভানুকে সাক্ষী মেনে মৃদুল বলে-
: শুনেন মামী। মামার কথা শুনেন। আমি আসলে এ সবের কিছুই জানিনা মামা। আমাকে খালী খালী দোষছেন।
মৃদুলকে আর কিছু বলতে না দিয়ে ফরিদা ভানু তার মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে খুবই বিনয়ের সুরে বলে-
: ভাইজান, পোলা মাইয়ারা যখন এই আকামটা কইরাই ফালাইছে এই বারের জন্য ওগরে মাফ কইরা দেন।
ওয়াহিদ মোল্লা ছোট ভাইয়ের বউয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। ভাসুরের হাসি দেখে ফরিদা ভানু বুঝতে পারে যে তার মতের বরফ গলেছে। তাই সে আবার অনুমতি চাওয়ার ঢংয়ে বলে-
: ভাইজান পোলা মাইয়ারা কী এখন গায়ে হলুদ করব ?
: কও। শুরু করতে কও।
মৃদুল মামীকে চোখের ইশারায় সাউন্ড সিষ্টেম চালাবে কিনা জানতে চায়। ফরিদা ভানু একটু গলা ঝেরে কেশে বলে-
: ভাইজান। পোল-মাইয়ারা একটু সাউন্ড সিষ্টেমটা ছাড়ুক। আপনে যদি অনুমতি দেন।
: যা খুশি তাই কর । এইডা তোমাগ ব্যাপার।
এই ধরনের আড়ে কথা বলাই যে ওয়াহিদ মোল্লার মৌন সম্মতির লক্ষন তা বুঝে নিয়েই ফরিদা ভানু মৃদুলকে বলে-
: যাও মৃদুল। অনুষ্ঠান শুরু কর গিয়া। তবে একটা কথা আবারও বইলা দিলাম বেশী জোরে মিউজিক ছাইর না। হেইলে এই বাড়ির বদনাম হইব।
: জ্বী মামী, কোনো সমস্যা হবে না। আমি আছি না। বড় মামা আমি গেলাম।
: যাও যাও, শয়তানের হাড্ডি, তুমিই সব নষ্টের গোড়া।
: আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ মামা। মাথা চুলকাকে চুলকাতে উচ্ছ্বসিত হাসিতে মৃদুল একরকম দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মৃদুলকে কাছে পেয়েই উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েরা তাকে ঘিরে ধরে। পিউ উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করে-
: কী খবর মৃদুল ভাই, খবর কী ভাল?
: হে। ভাল। তোমরা শুরু কর। শর্ত একটা বেশী হৈচৈ করা যাবেনা। কোনো কিছুর সীমাই যেন লংঘন না হয়। বুঝেছ তো সবাই। একযোগে সবাই বলে ওঠে- বুঝেছি মৃদুল ভাইয়া বুঝেছি। এর মধ্যে আবার কয়েকজন শ্লোগান তোলে-মৃদুল ভাইয়া, মৃদুল ভাইয়া-জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।
: শ্লোগান শুনে মৃদুল বারণ করে- আরে আরে আমাকে জিন্দাবাদ দিতে হবে না ; জিন্দাবাদ তো পাবেন মেঝ মামী। ওনিই তো বড় মামাকে ম্যানেজ করেছেন। আমি তো ছিলাম স্বাক্ষী গোপাল। এখন তোমরা শুরু করতে পার তবে আমি যেনো কোনো বাড়াবাড়ি না দেখি, ওকে।
সবাই এক সংগে বলে ওঠে-ওও-ওও-কেকেকে ভাইয়া। চলবের…
১৯টি মন্তব্য
মোহাম্মদ দিদার
শয়তানদের কিছু করতে হলে স্ব শরীরে উপস্থিত হইতে লাগে না। ইশারা মে সব কাফি অইয়া যায়।
বেশ সত্য সঠিক বাণী।
অবশেষে রাজি হলো মামা!!!
মাহবুবুল আলম
মোহাম্মদ দিদার!
ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা আপনাকে!
মোঃ মজিবর রহমান
হ! শয়তান দেখাই যাইনা। দূর থেকেই ফিইকা মাইরা কাম সাইরা ফেলে। হাসা কইসেন। ভাল লাগল। আবার আসিব ফিরে আগামির পর্বে।
মাহবুবুল আলম
মোঃ মজিবর রহমান!
শুভেচ্ছা জানবেন। ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ!
মোঃ মজিবর রহমান
আপনার প্রতি রইল ভালবাসা ভাইয়া।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এই পর্বটা ভালো লাগছে
মাহবুবুল আলম
সুপর্ণা ফাল্গুনী!
ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম। ভাল থাকবেন।
কামাল উদ্দিন
কিছু লোক আছে, এমন গোড়ামী করে থাকে। সবাইকে ম্যানেজ করা সহজ না।
মাহবুবুল আলম
কামাল উদ্দিন!
অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা!!
নিতাই বাবু
মানুষ যখন কোনও শয়তানি কর্ম করে, তখনকার জন্য সে শয়তান হয়ে যায়। মৃদুলও মনে হয় শয়তানির ছলে ক্ষনিকের জন্য শয়তানের বেশ ধরেছিল। ভালো লাগার এক গল্প পড়লাম।
শুভকামনা থাকলো।
মাহবুবুল আলম
নিতাই বাবু!
দাদা উপন্যাসের গল্পটি ভাল লেগেছে জেনে খুশি হলাম। ভাল থাকবেন। নিরন্তর শুভেচ্ছা!
প্রদীপ চক্রবর্তী
ভালো লেখনী দাদা।
আপনমনে চলুক উপন্যাস।
আগের পর্ব পড়া হয়নি।
অবসরে পড়ে নিব।
নুর হোসেন
ডেভিল খুব একটা ভয় পাইনা,
প্রতিটি মানুষের মাঝে লুকায়িত কয়েকটা হিংস্র মুর্খ ডেভিল।
প্রয়োজন, পরিচ্ছন্ন চিন্তা ভাবনা তাহলেই ডেভিল সরানো সম্ভব।
চমৎকার লিখেছেন, নিয়মিত লিখুন আপনি সম্ভাবনাময় লেখক।
শুভ কামনা রইলো।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ!
সাবিনা ইয়াসমিন
প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন দুর্বলতা থাকে। মামার দুর্বলতা জানা হলো। আর পরিবারের মানুষদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার ফলাফলটাও মেঝ মামির দ্বারা ভালো করে উপস্থাপন করলেন।
উপন্যাসের পরবর্তি পর্বের অপেক্ষায় রইলাম,
শুভ কামনা প্রফেসর সাহেব 🌹🌹
মাহবুবুল আলম
সাবিনা ইয়াসমিন!
প্রিয়জন ও সুধি! এটি আমাদের গ্রামীন জীবনের একটি সাদামাটা গল্প।
আজ তৃতীয় পর্ব দিলাম। আশা করি ভাল লাগকে।
এস.জেড বাবু
পুরো গল্পে গ্রামীন পটভূমি ধরে রেখে সাবলিল ভাবে আয়োজনের বর্ণনা সাধারণ কাজ নয়।
অনেক ভাল লেগেছে এই পর্ব।
বন্যা লিপি
গ্রামীন পটভূমির বিয়ে নিয়ে খুব সুন্দর সাবলীল গল্প পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো।
আগামী পর্বের অপেক্ষায়।
মনির হোসেন মমি
বিয়ে বাড়ীর ঝামেলা।আসলে আজকালকার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান বেশ বিরক্তিকর বিশেষ করে ঐ বিকট শব্দে গান বাজনা। আধুনিকতার যাতায় গায়ে হলুদের সেই মা চাচিদের গানের ঐতিহ্য এখন আর নেই। খুব ভাল লাগছে চলুক।