শহীদ মিনার শব্দটি পড়লেই কি আপনার চোখে ভেসে উঠছে মাথা উঁচু করে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্তম্ভ, যেখানে খালিপায়ে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হচ্ছে? কিংবা যেখানে দেশের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা হচ্ছে অথবা দেশবরেণ্য কোন বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে? যদি না হয় তাহলে বলব আপনি বাঙ্গালী হিসেবে এখনো শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভীর্যতা ও ভাবাবেগ মনে ধারণ করতে শেখেননি। বাংলা ভাষার রক্তিম ইতিহাস সম্পর্কে আপনার নুন্যতম ধারণাও নেই এবং একজন বাঙালি হিসেবে আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত।

আজ ফেসবুকে একটি ভিডিও হঠাৎই চোখে পড়লো আমার। প্যান্ট গেঞ্জি পরিহিতা কয়েকজন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামনে নাচছে। কিছুক্ষণ দেখার পর নিজেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। পোশাক কোন বিষয় নয়, এটা যার যার ব্যক্তিগত অভিরুচি তবে ভাষার শালীনতাবোধ আমার কাছে অনেক বড় একটি বিষয় বৈকি। ইংরেজি গান বাজবে শহীদ মিনারে এটা ভেবেই আশ্চর্য হলাম আমি। আরো আশ্চর্য হলাম সেই গানের সাথে সাথে যাকে আমরা ডিজে ড্যান্স নামের চিনছি ইদানীংকালে সেটা হচ্ছে। মন থেকে এ বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই প্রতিবাদস্বরুপ দু’কলম লিখতে বসলাম আজ পাঠকদের সামনে।

এই ভিডিওটি দেখে একজন বাঙ্গালী হিসেবে আমি নিজেই অনেক লজ্জিত হচ্ছি। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ডিজে ডিজে নিত্য চিন্তা করতে পারেন? যে শহীদ মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ভাষা শহীদদের রক্তে রঞ্জিত স্মৃতিমাখা বেদনার সব দুঃখময় স্মৃতি নিয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল আমাদের বাংলা ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের সেই আত্মদান। দেশমাতৃকার সেইসব শহীদ বীর সন্তান যারা দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাংলা আমাদের মাতৃভাষা হবেই হবে। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ নাম না জানা কতজন শহীদ হয়েছিলেন এই ভাষাকে মাতৃভাষা স্বীকৃতিদানের আন্দোলনে। তাদের আমরা এভাবে স্মরণ করছি? কি লজ্জা!

গতকাল একটি সংগঠন নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে শহীদ মিনারে ডিজে নৃত্য করেছে। ইংরেজি গানের তালে তালে নৃত্য করে এ কেমন প্রতিবাদ আন্দোলন? আমি যদি ধরেও নিই সারাদিন আন্দোলন সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং করে ক্লান্ত হয়ে শেষ বেলায় নিজেদের ক্লান্তি কাটাতেই তারা এমনটা করেছে তবুও কিন্তু সেটা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এর জন্য পূর্বপ্রস্তুতি দরকার হয়। তাহলে এই অনুষ্ঠানের আয়োজনদের কি ন্যূনতম বোধবুদ্ধি জ্ঞান ছিলনা যে শহীদ মিনারে এমন গান করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

শহীদ মিনারে বাংলা গান হতে পারে তাও শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভীর্য তা বজায় রেখে তা করতে হবে। যে বাংলাদেশে শহীদ মিনারে কোন সভা-সমাবেশ করার জন্য অনুমতি নিতে যে কতজনের কাছে চিঠি চালাচালি করতে হয়, সেখানে শহীদ মিনার ইংরেজি গান বাজিয়ে অনুষ্ঠান করার অনুমতি কে বা কারা দিয়েছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। এই দেশের ভাষার জন্য যারা আন্দোলন করেছেন; বাংলাদেশের মানুষ যাতে বাংলায় কথা বলতে পারেন তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে শহীদ হয়েছেন, তাদের স্মৃতিচারণায় নির্মিত এই শহীদ মিনারে এমন ডিজে নৃত্য! এমন বাংলা সংস্কৃতিই কি আমরা চেয়েছিলাম?

নিজের দেশের সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে বিশ্ব সাহিত্য এবং সভ্যতাকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করতে হয়। তবে এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে সেই বিদেশী সংস্কৃতি আমাদের দেশের সংস্কৃতি সাথে সাংঘর্ষিক কিনা? যদি হয় তবে তা অবশ্য বর্জনীয়। ডিজে নৃত্যের সাথে লম্ফঝম্প করে কি করে নারী অধিকার ধর্ষণের প্রতিবাদ করা হয় বা করা যায় তা আমার বোধগম্য নয়। তারা এই কর্মটি কোন কোন ফাঁকা জায়গায় করতে পারতো। টিএসসি, শাহবাগ কিংবা রবীন্দ্র সরোবরে করতে পারতো, তা না করে করেছেন শহীদ মিনারে। আশ্চর্য তাদের মানসিকতা!

আমার ধারণা এরা তারাই যারা ১৬ই ডিসেম্বর, ২৬শে মার্চ এর পার্থক্য বোঝে না। কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি,১৬ই ডিসেম্বর কিংবা ২৬শে মার্চ আসলে এরাই শাড়ি পড়ে বাঙালি সাজে। মাথায় বাহারি ফুলের মালার সাজ দিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে যায় কিন্তু শহীদ মিনারের ইতিহাস বুঝতে চায় না জানতেও চায় না। বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে একটি গোষ্ঠী সবসময় তৎপর। যারা কিনা এদেশের স্বাধীনতা স্বারভৌমত্বকে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না মন থেকে। অত্যন্ত সুকৌশলে সেই গোষ্ঠী নিজেদের অপকর্মগুলি এভাবেই চরিতার্থ করছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে শহীদ মিনারের মত একটি প্ল্যাটফরম ব্যবহার করতে হলে এর মূল চেতনাকে সম্মান করতে হবে। শহীদ মিনারকে অবজ্ঞা করে কখনওই কোন প্রতিবাদ হতে পারেনা। শহীদ মিনারে সমাবেশ প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ হতে পারে, তবে তাতে বাঙালি মূলভাবের প্রতি সম্মান থাকতে হবে।

শহীদ মিনারে নারী ও শিশু ধর্ষণের প্রতিবাদে আয়োজিত এমন ইংরেজি ডিজে নৃত্যে; আধুনিকতার ছোঁয়ায় যাকে ইংরেজিতে ফ্লাশমব বলা হয়, এমন একটি কর্মে আমাদের বাংলা ভাষা এবং ভাষা শহীদদের কি আরেকবার অপমান করা হলো না? ফেসবুকে মাসুম নামের একজন “ধর্ষণের প্রতিবাদে করা একটি ধর্ষণ” শিরোনামে এই ভিডিওটি শেয়ার করেছেন। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে, সোচ্চার হতে হবে। তবে প্রতিবাদ করার এমন ঘৃণিত একটি কর্মে বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি, ভাষাশহীদ এবং শহীদ মিনারের ভাবগাম্ভীর্যতাকেই যেন ধর্ষণ করা হলো – ঠিক এই মুহুর্তে এই একটি লাইনটিই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বারবার।

ভিডিও দেখুন  

 

১৬১৩জন ১০১৮জন
0 Shares

৩৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ