চারদিকে রঙবেরঙের ফুল আর কাগজের সমারোহ।আবালবৃদ্ধবনিতার চোখেমুখে আনন্দের বান।এমনই রঙিন সময়ে ক্রমশ শব্দের প্রখরতা বাড়িয়ে স্টেশনে এসে থামলো সকলের কাঙ্খিত সেই আন্তনগর ট্রেন “মিতালী এক্সপ্রেস”।এই স্টেশনে নতুন এই ট্রেনটির আজই প্রথম উদ্বোধন।প্লাটফর্মে থামতেই মুহুর্মুহু উচ্ছ্বাস জনতার।চারদিকে হাসির ঝিলিক।শুধু হাসি নেই সন্ন্যাসের মুখে।এমন আনন্দের মুহূর্তেও যেন তার চোখেমুখে যন্ত্রণার ছাপ,চাপা কান্নার বিষণ্নতা।ভিজে যাওয়া চোখের জলে চিকচিক করছে স্বজন হারানো বেদনার প্রতিচ্ছবি।সে জানে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই একবুক যন্ত্রণা দান করে চলে যাবে অনাবিল আনন্দ বয়ে নিয়ে আসা ট্রেনটিও;চলে যাবে ঠিক মালোতীর মত।
মালোতীর চলে যাবার দৃশ্যটি আজ আবার বুকের ভেতর প্রচণ্ড একটি ঝড় তুলছে,চোখে নিয়ে আসছে অশ্রুর বান।মালোতীর অসহায় মুখমণ্ডলটি বারবার ভেসে উঠছে সন্যাসের মানসপটে।
অমাবশ্যা আসতে তখনো কদিন বাকী।কিন্তু কেন যেন মনে হচ্ছে চারদিকে ঘুঁটঘুঁটে অন্ধকার।ক্ষয়ে যাওয়া পৃথিবীতে আলোর বড্ড অভাব,দূরে দণ্ডায়মান ক্ষয়িষ্ণু ল্যাম্পপোষ্টেটার মত।যেটুকু আলো আছে তাও মেনে নিতে চায় না ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অর্বাচীন মানুষেরা।এমন অন্ধকার রাতেও চায়ের চুলো জ্বালিয়ে শেষ ট্রেনটার জন্য অপেক্ষায় আছে সন্ন্যাস।ট্রেনটা এলে দু’ দশ টাকা বিক্রি হলে সেটাই বা কম কিসে।
হুইসেল বেজেছে বেশ কিছুক্ষণ।কিন্তু ট্রেনটি আসছেনা কেন!এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়।এটা ওটা ভাবতে ভাবতে কেটলীটা সরিয়ে চুলোর আগুনটা একটু নাড়াচাড়া দিল সন্ন্যাস।দূরে ঘেউঘেউ শব্দ।কয়েকটা কুকুর লেজ নাড়াতে নাড়াতে হেঁটে গেল পরিত্যক্ত গোডাউনটার দিকে।সন্ন্যাসের মনটা কেমন যেন খচ করে উঠলো।বছর তিনেক আগে এমনই এক রাতে পরিত্যক্ত ঐ গোডাউনটাতেই লাশ পড়েছিল অতি আদরের ছোটবোন মল্লিকার।ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিল কতগুলো নরপশুর নৃশংসতার ছবি।কিছু ভয়, কিছু সংশয়,কিছু ক্ষোভ,কিছু অভিমান নিয়ে সামনে পা বাড়ায় সন্ন্যাস।
ট্রেনটির ইঞ্জিন হঠাৎ বিকল হয়ে যাওয়ায় স্টেশন অবধি পৌঁছতে পারেনি।অন্য ইঞ্জিন আসতে হয়তো সকাল হয়ে যাবে।অন্ধকার রাত।ক্ষুধার যন্ত্রণা আর চোর-ডাকাতের ভয়ে আর সবার মত মালোতীও নেমে পড়ে ট্রেন থেকে।হাঁটতে থাকে স্টেশনের দিকে।বেশী দূর নয়।আরেকটু হাঁটলেই স্টেশন।পুরণো বটগাছটা পেরোতেই সামনে এসে দাঁড়ায় তিনটে জানোয়ার।জাতে মানুষ,স্বভাবে কুকুর।একটা অমানুষ হাত চেপে ধরে মালোতীর।মালোতী চিৎকার করার চেষ্টা করতেই ওর মুখ চেপে ধরে অন্যজন।মালোতীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পরিত্যক্ত গোডাউনটার দিকে।হটাৎ একটা আলো এসে পড়ে ওদের ওপর।টর্চ হাতে ট্রেনটার দিকে এগচ্ছিল সন্ন্যাস।এই দৃশ্য দেখেই চিৎকার করে এগিয়ে যায় মালোতীর দিকে।চিৎকারে লোকজন ছুটে আসে।মালোতী বেঁচে যায় এক চরম কলংকিত অধ্যায় থেকে।দুর্বৃত্তরা পালিয়ে গেলেও সন্ন্যাসকে হত্যার হুমকি দিয়ে যায়।এলাকার প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের বখে যাওয়া ছেলেগুলো হুমকি দিয়ে গেলেও অগত্যা পরবর্তী ইঞ্জিন না আসা পর্যন্ত সন্ন্যাসের চা দোকানকেই মনে করা হল নিরাপদ আশ্রয়।
অন্ধকারে কুপীর আলোয়ও বোঝা যাচ্ছে অসম্ভব সুন্দরী তরুনী মালোতী।শহরের শিক্ষিত প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে হলেও আজ তার চোখেমুখে রাজ্যের অসহায়ত্ব।জীবনের এই স্টেশনে আজকের নায়কের নাম সন্ন্যাস,এক চা দোকানদার।সামান্য আগের অপরিচিত কোন এক সন্ন্যাস হয়ে ওঠে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আপনজন।জীবনটা এমনই।জীবনের এই কথোপকথনেই রাত কেটে ভোর আসে।চলে আসে আরেকটা ইঞ্জিন।মন না চাইলেও ট্রেনে উঠতে হয় মালোতীকে।পড়ে থাকা অচল ট্রেনটিকে হুইসেল বাজিয়ে স্টেশন ছেড়ে দ্রুত টেনে নিয়ে যায় অন্য শহরের দিকে।ট্রেনের সাথে সাথে এগিয়ে চলে চোখের জল,মালোতী নামের অবশ লাশ।আর ল্যাম্পপোষ্টের মত স্টেশনে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে এক বটবৃক্ষ,এক অচেনা সন্ন্যাস।
৩৫টি মন্তব্য
এস.জেড বাবু
আজকালকার সন্ন্যাস হলে টর্চের বদলে হাতে মোবাইল থাকতো, কি জানি হয়তো দুরে দাড়িয়ে নিরবে ভিডিও ধারণ করতো।
চমৎকার লিখেছেন ভাই।
হালিম নজরুল
হুম ভাই।নিজেদেরকে বদলানোর জন্য লিখি।দেখা যাক কি হয়।সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
সুরাইয়া পারভিন
সবাই যে নৃশংস জানোয়ার তাও না
সন্ন্যাসের এ
দু’এক জন আছে বলেই পথিবী এখনো সুন্দর।
জীবনের প্রতিটি ইস্টিশনে এমনি কিছু ঘটনা না চাইলে ও ছেড়ে যেতে হয়।
চমৎকার লিখেছেন ভাইয়া
হালিম নজরুল
কষ্ট করে পড়ে মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ আপু।অনুপ্রাণিত হলাম।
জিসান শা ইকরাম
কে কখন কার জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে বলা কঠিন।
মালতীর কাছে সন্যাস তেমনই একজন ছিলো।
জীবনের কিছু সত্যি উপলব্দি এসেছে গল্পে,
ধন্যবাদ আপনাকে এত ভালো একটি গল্প এখানে দিয়েছেন বলে।
নিয়মিত লেখুন এখানে, অন্য দু-একজনের লেখায় আপনার মন্তব্য পেলে লেখকরা উৎসাহ পেতো অনেক।
শুভ কামনা শ্রদ্ধেয় ভাই।
হালিম নজরুল
সময় খুব বেশী পারমিট করে না।তবুও চেষ্টা করি অন্যদের লেখা পড়বার্।ধন্যবাদ ভাই।
ইঞ্জা
মালতীর নায়ক হয়ে দেখা দিলো সন্যাস, যার ছায়ার তলে আশ্রয় পেয়েছিলো সে, তার চলে যাওয়া এখনো ভাবায় সন্যাসকে, প্রভাবশালীরাই মানুষকে ছিন্নভিন্ন করে খায়, খেতে না পারলে হুমকি দেয়, এরপরেও সন্যাসরা অবিচল থাকে।
অসাধারণ লিখলেন ভাই।
হালিম নজরুল
একবুক ভালবাসা রইল ভাই।
গালিবা ইয়াসমিন
কি বলবো বুঝতে পারছি না কিন্তু ভালো লাগলো
হালিম নজরুল
ভাল লাগলেই কেবল সার্থক আমার লেখা।ধন্যবাদ আপু।
মোঃ মজিবর রহমান
হ্যা অতীত খুব স্বরনীয়।
তাই মালতির চলে যাওয়া আজ হৃদয়ে ডেকে যাই। সে আর ফিরবে কি জানিনা।
ভাল লাগ্ল।
হালিম নজরুল
প্রেরণা দেবার জন্য ধন্যবাদ ভাই।
রেহানা বীথি
আমি প্রথম পড়লাম আপনার লেখা। চমৎকৃত হলাম। গল্পের গাঁথুনি অপূর্ব। একটি ছোট্ট কথা, প্রতিটি বাক্যের শেষে দাঁড়ি দেয়ার পর একটু স্পেস দিলে লেখার লাইনগুলো স্পষ্ট হয় আরও। আর মালতী- মালোতী।
ভালো থাকবেন।
হালিম নজরুল
কৃতজ্ঞতা রইল।আজ জানলাম আরেকজন পাঠক বাড়লো।
মালোতীর ব্যপারে আপনার পরামর্শ বুঝতে পারিনি আপা।
রেহানা বীথি
মালতী বানানটা এভাবেই জেনেছি আমি। ল-এ ও- কার না দিলেই বোধহয় বেশি ভালো হয়। সেটাই বলেছি ভাই। লেখাটা খুব ভালো লেগেছে, তাই এটুকু বললাম।
আরজু মুক্তা
গল্পটা ভালো লাগলো।
হালিম নজরুল
পড়ার জন্য ধন্যবাদ আপু।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
অচেনা সন্ন্যাসেরা কোনো কোনো সময় অসহায় মালোতীদের ইজ্জতের অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়।
আর ক্ষমতাসীনদের চেলা চামুন্ডুরা মালোতীদের একা পেয়ে মর্দামি ফলাতে যায়।
গল্প খুব ভালো হয়েছে। নিয়মিত লিখুন। শুভ কামনা।
শামীম চৌধুরী
এত এত ভালো লাগলো যে শেষের দিকে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারন গল্পটা শেষ হলো বলে।
হালিম নজরুল
আপনার ভাল লেগেছে জেনে প্রেরণা বাড়লো।ধন্যবাদ ভাই।
শিরিন হক
গল্পো লিখতে সবাই পারেনা আপনি দাড়ুন মুনশিয়ানা দেখালেন। শুভকামনা
হালিম নজরুল
আপনার প্রেরণা ভাবিষ্যতে আরও ভাল লিখবার শক্তি যোগাবে।ধন্যবাদ আপু।
শাহরিন
এই সন্যাসকে দরকার প্রতিটি মহল্লায়, শহরে দেশে।
হালিম নজরুল
প্রতিটি পাড়া মহল্লা গ্রাম গঞ্জ শহর বন্দর দেশে বিদেশে সমাজ সভ্যতায় এমন সন্ন্যাসদের সৃষ্টি হোক,সেটিই প্রত্যাশা
মনির হোসেন মমি
চমৎকার ফিনিশিং চিত্রায়ণ…আর ল্যাম্পপোষ্টের মত স্টেশনে অনড় দাঁড়িয়ে থাকে এক বটবৃক্ষ,এক অচেনা সন্ন্যাস।
জীবন হয়তো এমনি হঠাৎ কিছু ঘটে যা কল্পনাতীত। খুব ভাল লাগল।
হালিম নজরুল
আপনাদের ভাল লাগলেই কেবল সার্থক আমার লেখা।ধন্যবাদ ভাই।
তৌহিদ
গল্পটি যেন শেষ হয়েও হলোনা। আক্ষেপময় অনুভূতিরা বয়ে চলেছে আপন গতিতে। জীবনের প্লাটফরমে কতজন আসে যায় তার সবাই কি মনে জায়গা করে নিতে পারে? তবু কেউ কেউ রয়ে যায় স্মৃতির পাতায়। সন্ন্যাস বুঝি এমনই একজন।
দারুণ লিখেছেন ভাই। আপনার লেখার ভক্ত হয়ে গেলাম।
হালিম নজরুল
ধন্যবাদ তৌহিদ ভাই।আমি আগে থেকেই আপনার লেখার ভক্ত।আজ জেনে ধন্য হলাম যে আমার লেখা আপনার ভাল লেগেছে।ভালবাসা রইল ভাই।
ছাইরাছ হেলাল
মন্তব্যগুলোর উত্তর দিন একটু সময় করে।
হালিম নজরুল
সবগুলো মন্তব্যের জবাব দিয়েছি ভাই।সুন্দর পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ।এটি আমার তৃতীয় পোস্ট,আপনার লেখা সম্পর্কিত মন্তব্য প্রার্থনা করি।
ছাইরাছ হেলাল
অনেক অনেক ধন্যবাদ, আপনি জানেন তাও বলছি,
একজন মন্তব্যকারী লেখকের কাছে উত্তর প্রত্যাশায় রাখে।
আমিও চাই আমার মন্তব্যের উত্তর আপনি দিন (দিয়েছেন)।
প্রথম ও দ্বিতীয় লেখার মন্তব্যগুলোর উত্তর সময় করে দিয়ে দিবেন আশা করি।
এ লেখাটি পড়ে পরে মন্তব্য দিব অবশ্যই, একটু ব্যস্ত।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ছাইরাছ হেলাল
গল্পে আমাদের সমাজের এক কঠিন-করুন চিত্র ফুটে উঠেছে।
সন্ন্যাস সময়ের সাহসের চিহ্ন ধারণ করে ক্ষীণ ভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
হয়ত আলো দেখাবে বলে।
হালিম নজরুল
আপনার মূল্যবান মতামত আমার প্রেরণা হয়ে থাকবে ভাই।ধন্যবাদ আপনাকে।
মুক্তা মৃণালিনী
কি লিখব বুঝতে পারছি না। গল্পের মাঝে ডুবে গিয়েছিলাম। গল্পটা কি এতটুকুই? তৃষ্ণা রয়ে গেল। শুভকামনা অনেক অনেক।
হালিম নজরুল
আপাতত এটুকুই থাক না!পরের গল্পে না একটু টেনে নেওয়া যাবে।পাশে থাকার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনাকে।