মাঝে মাঝেই স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাই। হোঁচট খেয়ে ফিরে আসে মন। একটা দোকান — চাটাইয়ের ওপর মাটির লেপ। ছনের চাল। দোকানের ভেতরে ডলি বিস্কুটের কৌটো, বুনবুনি বা নানা রঙের টিকটিকির ডিমগুলোর কাঁচের বয়াম ভেদ করে পিটপিট তাকানো, মচমচে চানাচুর, বিলাতি দুধ, আচার, কাঠি লজেন্স। এসব ছাড়াও সর্ষের তেল আর জর্দার সুবাস। পুরো দোকান ম ম। খুচরো পয়সা, ধান, চাল — বিনিময়ে সাধের লজেন্স, ডলি বিস্কুট, টিকটিকির ডিম, চানাচুর! খেলার সাথীদের সাথে ভাগ করে পরমানন্দে খেতে খেতে ছোটা, ছুটতে ছুটতে খাওয়া । কলমির ঝোপ পেরিয়ে খাল, খাল পেরিয়ে বিল, বিল পেরিয়ে সবুজে সয়লাব ধানক্ষেত! কখনও বৃষ্টিশেষে রোদের ঝিলিক, ওই দূর আকাশে রঙধনুর সাতটি রঙ।
আহা!! কোথায় সেসব? হারিয়ে গেছে আমাদের সেই ছোটবেলা। ফ্ল্যাটে বন্দি আজকের শৈশব আকাশই দেখে না, রঙধনু কোথায় পাবে? অলিগলিতে ফাস্টফুডের দোকান। বার্গার, পিজজা, স্যান্ডউইচ, চাউমিন, পাস্তা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই.. .. ডেজার্ট। হাই, হ্যালো বিদেশী কেতা, বিজাতীয় শব্দসম্ভারে আমরা বড় বেশি আধুনিক। আন্তরিকতা আছে কি? আছে কি মাটির টান, মায়া, দেশের প্রতি আবেগ? থাকলে কেন কথায় কথায়, শব্দে শব্দে গেঁথে ফেলছি বিদেশী শব্দমালা? নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে কেন সরে যাচ্ছি দূরে আরও দূরে?
মনে পড়ে কয়েক বছর আগের কথা, ট্রেনে করে রাজশাহী থেকে খুলনায় যাওয়ার সময় পাশে বসা কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর কথোপকথন —–
— জানিস, চাঁপাই নবাবগঞ্জের মানুষ নাকি কালাইয়ের রুটি খায়, বাড়িতে অতিথি গেলেও ওই রুটি দিয়ে নাস্তা করায়, হি হি হি……
— আর বলিস না, ওরা একেবারেই গাঁইয়া! ওসব খাওয়ার জিনিস? ছিঃ ছিঃ!!
— ঠিক বলেছিস, একেবারেই আনকালচার্ড ওরা। কথাও বলে কেমন হামি হামি করে, শুনেছিস?
লজ্জা পেয়েছিলাম ভীষণ । চাঁপাই নবাবগঞ্জে জন্ম এই কারণে নয়। লজ্জা পেয়েছিলাম, আমাদের সন্তানদের এই মনোভাবের জন্য। চাঁপাই নবাবগঞ্জ বাংলাদেশের বাইরে নয়। দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের আছে কথা বলার নিজস্ব ঢঙ, আছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য, নিজস্ব কিছু আচার -অনুষ্ঠান । সেগুলো আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের দেশের সম্পদ। সার্বিকভাবে আমাদের সেগুলো নিয়ে গর্ব করা উচিত। আর এসব ঐতিহ্য আগলে রাখা উচিত আমাদেরই। তা না করে আমরা উপহাস করি।
আর আমরা গর্ব করি কী নিয়ে? কে কতটা বিদেশী ভাবধারা, ভাষা আয়ত্ব করতে পেরেছে, তাই নিয়ে। হাস্যকরভাবে অনুকরণ করি বিজাতীয় রীতি। আর এসব করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলছি আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ঐতিহ্য। এরচেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হতে পারে না। নিজস্বতা বিবর্জিত একটা জাতি, অবশ্যই একটা খোঁড়া জাতি। আর যে জাতি নিজেদের নিয়ে উপহাস করে, সে জাতি অন্যের কাছেও উপহাসের পাত্র।
ভাষা- সাহিত্য – সংস্কৃতির যে সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আমাদের আছে, ভালোবাসি তা। দেশকে ভালোবাসি, আগলে রাখি দেশের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে। সুশিক্ষিত হই। হিংসাটুকু নয়, নিজের মাঝে যেটুকু আলো আছে, ছড়াতে চেষ্টা করি তা আশেপাশে। একসময় দেখবো… অবশ্যই দেখবো হোঁচট খেয়ে ফিরে না এসে স্বপ্নের সোনালী দরজাটা খুলছে একটু একটু করে চোখের সামনে।
২৫টি মন্তব্য
তৌহিদ
কথায় কথায় অনেক পুরোনো কথা আমারও মনে পড়ে গেলো আপনার লেখা পড়ে। মাঝেমধ্যে উঠতি বয়সীদের বাংলিশ দেশপ্রেম কিংবা অপসংস্কৃতি চিন্তা চেতনা চোখে লাগার মত। ভাবি আমাদের ভবিষ্যৎ কি?
লেখা ভালো লেগেছে আপু।
রেহানা বীথি
ভালোলাগায় খুশি ভাই।
নীরা সাদীয়া
সত্যি বলেছেন আমাদের পরের প্রজন্মের (এমনকি আমারও ছিলো) শৈশব ফ্ল্যাটেে বন্দী। আমরা সভ্যতা বলতে বুঝি অনুকরণ। বিকৃত মানসিকতাই আজ স্বভাবে পরিনত হয়েছে।
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য জন্য ।
আকবর হোসেন রবিন
টিকটিকির ডিম…. এটার কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে করিয়ে দিলেন।
আপনার অনুভূতি গুলো সুন্দর। গল্প লিখেন? আপনার লেখা গল্প পড়তে চাই।
রেহানা বীথি
ধন্যবাদ। ব্লগে আমার লেখা গল্প আছে। পড়তে পারেন।
সাবিনা ইয়াসমিন
এক দেশের ভাষা, আরেক দেশের গালি। আমরা ভুলে যাই মাতৃভাষা মানেই শুদ্ধ ভাবে বলা কথা নয়। মায়ের মুখে শেখা নিজ অঞ্চলের ভাষায় বলা কথাগুলোই মাতৃভাষা। অঞ্চল ভেদে একেক স্থানের ভাষা একেক রকম হয়। আমার খারাপ যখন, এক জেলার মানুষ অন্য জেলার মানুষের ভাষা নিয়ে হাস্য-রসিকতা করে।
সোনালী দিন আসলেই সোনা রঙের মতো অমলিন হয়।
শুভ কামনা, ভালোবাসা নিরন্তর ❤❤
রেহানা বীথি
অনেক ভালোবাসা দিলাম
নিতাই বাবু
পাঁচ পয়সা দামের বাবুল বিস্কু আর তক্তি বিস্কুটের কথাটা কিন্তু বললেন না, দিদি। এগুলোও আমাদের সময়ে আমাদেরই প্রতিদিনের স্কুলের মজার খাবার ছিল। সাথে ছিল বুট ভাজা আর লোহার মতো শক্ত দুই পয়সা দামের আইসক্রিম। যাইহোক, আপনার ছোটবেলার অনুভূতি নিয়ে লেখা কিন্তু দারুণ হয়েছে। এই লেখা আজকালকার ছেলেপেলেদের নজরে পড়া দরকার আছে।
রেহানা বীথি
ভালো লাগলো দাদা আপনার মন্তব্য
নৃ মাসুদ রানা
বাহ! অনেক সুন্দর লেখা। পড়তে পড়তে লেখার ভিতরে চলে গিয়েছিলাম।
রেহানা বীথি
অনেক শুভেচ্ছা আপনাকে
মনির হোসেন মমি
দোষটা ওদের নয় দোষটা আমাদের গার্ডিয়ানদের হয়তো ওদের এই আমরাই সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে পারিনি। আগে আমাদের মা চাচিরা আমাদের সাথে সব সময় আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে কথা বলতেন, ঘুমানোর সময় অনেক গল্প ইতিহাস বলার ছলে ঘুম পারাতেন তাতে আমাদের মনে আমাদের সংস্কৃতি কৃষ্টি কালচারের সাথে অর্ধেক পরিচয় হয়ে যেত বাকীটা শিক্ষাঙ্গণ ও বিস্তৃত মাঠে খেলার কোলাহলে।এখন ওরা এ সব পায় না বলেই ওরা এতো অজ্ঞ ।
খুব সুন্দর স্মৃতি। মনে পড়ে গেল।
রেহানা বীথি
সেটাই ভাই, কেন যে আমরা আমাদের সন্তানদের মাঝে মূল্যবোধগুলো জাগিয়ে তুলি না!
ভালো থাকবেন। শুভকামনা সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
দুরন্ত শৈশব কে মিস করি খুব।
আমরা আমাদের কোনো কিছু নিয়েই আর গর্ব করিনা,
কে কতটা বিদেশী বিষয় আয়ত্বে আনি, এটি নিয়েই আমাদের গর্ব।
এ কারনেই আমরা বিদেশে সেটেলারদের নিয়ে উচ্ছসিত হই।
ভালো লেখা,
এমন লেখা চাই আরো।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালোলাগায় খুশি ভাইয়া। ভালো থাকবেন সবসময়।
ছাইরাছ হেলাল
ক্রমাগত স্বকিয়তা হারানোর উল্লম্ফন দেখছি আর দেখছি।
রেহানা বীথি
দেখছি আর ব্যথিত হচ্ছি। ভালো থাকবেন।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
আপনি প্রথমে যেসব বর্ণনা দিয়েছেন তার তৎকালিন বাংলাদেশের সাথে মিলে যায়। আমিও একসময় সে বাংলাদেশের বাসিন্দা ছিলাম। এখন আমি চাঁদের দেশে বাস করি।
ও হ্যাঁ, দু’মাস আগে একটি গবেষণার কাজে আমি চাপাইনবাবগঞ্জসহ ৭/৮টি জেলা ভ্রমণ করেছিলাম। তখন ছিলো আমের মৌসুম। চাপাইতে হাঁসের মাংশ খেয়ে বেশ মজা পেয়েছিলাম।
রেহানা বীথি
বাহ্, জেনে ভালো লাগলো। আবার কখনও সুযোগ পেলে আসবেন বেড়াতে।
ইঞ্জা
আসলে আমরা যেদিন কাটিয়ে এসেছি, আমাদের শৈশব ছিলো খুবই সাধারণ, ডলি বিস্কুট, টিকটিকির ডিম হাতে পেলেই বর্তে যেতাম, আকাশে এরোপ্লেন দেখলে হা করে তাকিয়ে থাকতাম, খেলতে গিয়ে জন্মভূমির মাটিতে লুটোপুটি খেতাম, কিন্তু সেইসব কি আমাদের পরবর্তী বংশধররা কি পেয়েছে, না পায়নি তারা, ওরা হলো ডিজিটাল যুগের মানুষ, ওদের দোষ দিইনা আমি, আমাদেরই উচিত ওদেরকে নিজ জন্মভূমিকে চেনানো, তাদের শিখানো উচিত জন্মভূমির মানুষদের সম্মান করানো, তাহলেই ওরা সব শিখবে আপু।
রেহানা বীথি
জ্বি ভাইয়া। আমার কথা সেটাই। যে চেতনা নিয়ে একাত্তর এসেছিল, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হলো লাখো প্রাণ, সেই চেতনা থেকে এই কয় বছরে আমরা কেন এতটা দূরেে সরে গেলাম? সবকিছু দেখে এই প্রশ্নটাই মনকে পীড়া দেয় ভীষণ।
ভালো থাকবেন ভাইয়া।
ইঞ্জা
হুম বুঝতে পারছি আপু কিন্তু করার কিছু কি আছে?
আরজু মুক্তা
সংস্কৃতি হচ্ছে নিজস্বতা, এটা হারিয়ে গেলে কিছুই থাকেনা। এগুলো হৃদয়ে লালন করতে হয়।
রেহানা বীথি
একদম আপু।
ভালো থাকবেন, ভালোবাসা জানবেন।