
প্রিয় আকাশ,
জানি তুমি আকাশের মত বিশাল নও, আকাশের মত নীলও নও। তবু আমি তোমার নাম দিয়েছি আকাশ। তোমাকে কল্পনা করি আকাশের বিশালতার মত, তোমাকে খুঁজে ফিরি আকাশের ঐ নীল রঙে। টুকরো টুকরো মেঘের ভেলায় লিখে রেখেছি তোমার স্মৃতি খুব যতনে। তাই তোমার নাম দিয়েছি আকাশ।
অনেক দিন থেকে ভাবছি, তোমাকে একটা চিঠি লিখবো। কিন্তু কি লিখবো, কেন লিখবো, এসব ভেবেই থেমে গেছি। কিন্তু কিন্তু বাদ দিয়ে আজ লিখেই ফেললাম। তুমি জানতে চেয়েছিলে কেন তোমাকে ভালোবাসি? এর উত্তর আজো নিজেই খুঁজে পাইনি। কি বলবো বলো।
কবে যে তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম মনে নেই। তবে রবি ঠাকুরের “শেষের কবিতা” পড়তে গিয়ে বার বার তোমাকেই মনে পড়ত। অমিত বলতে তোমাকেই ভাবতাম, আর লাবণ্য যেন আমি! সেই যে সেদিন জানতে পারলাম, তুমি আমার অমিত নও, আকাশ ও নও, তখন থেকেই বইটা যত্ন করে শেলফে তুলে রেখেছিলাম, আর কোনদিনই পড়া হয় নি।
যেদিন এই সত্যটা প্রথম জেনেছিলাম, সেদিন আড়াই ঘন্টা শুধু নিজের মাথায় পানিই ঢেলেছিলাম, কোনদিকে যে এত সময় পার হয়ে গেছে টেরই পাইনি। মা গোসলখানার দরজা চাপড়ে বলছেন, “কোনদিন তো এত দেরী হয় না, আজ কি হলো? এত পানি ঢেলো না, তোমার তো ঠান্ডা লাগার ধাত আছে।” আচ্ছা তুমি কি জানতে যে আমার ঠান্ডার ধাত আছে? কোনদিন যদি আমার সম্পর্কে একটু জানতে চাইতে…আমি ভালোবাসা নিয়ে ঝড়ে ঝড়ে পরতাম। কিন্তু তখন তা হলো না। কেন হলো না? কী হতো তা হলে?
যেদিন থেকে এই তিক্ত নির্মম সত্যটা জানলাম, তারপর থেকে আমার কী যে হলো…আমি আর নিজের মধ্যে রইলাম না। নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেললাম। এরপর থেকে একটু একটু করে প্রতিদিন তোমাকে ভোলার বৃথা চেষ্টা, তোমাকে ভুলতে গিয়ে আরও বেশি করে ভুলে যাচ্ছিলাম নিজেকেই!
ততদিনে তুমি অন্য কারো কৃষ্ণ হয়ে বাজাতে শুরু করেছো সুরের বাঁশি। আমারই চোখের সামনে আমার আকাশে অন্য কোন মেঘ, অন্য কোন রংধনু, আমি কি করে সই? ততদিনে জেনে গেছি আকাশটাই আমার নয়, তাতে খেলা করে অন্য মেঘ। এদিকে আমার মাথায় খটখটে রোদ। কোথাও কেউ ছিলো না জানো? কেউ ছিলো না যে একটু ছাতা ধরবে, বলবে, “অত ভেবো না, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
জানতাম কিচ্ছু ঠিক হবার নয়। গোটা আকাশটা আমার দুমড়ে মুচড়ে গেছে। এই আকাশে আজ খেলা করে অন্য অন্য মেঘ। সেখানে কোথাও আমি নেই… ভাবতেই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতো। চারপাশে অক্সিজেন শূন্যতা দেখা দিত। মনে হতো এই বুঝি বন্ধ হতে চললো নিঃশ্বাস, থেমে যেতে লাগলো হৃদপিণ্ডের কম্পন। সেদিন থেকে আমার যা যা রোগ হয়েছিল তা আজও সারেনি। ভাতের থালায় খেতে না পারা ভাত রেখে ওঠা রোগ, যখন তখন তোমাকে মনে পড়া রোগ, সবকিছু ভুলে যাওয়া রোগ, তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসার রোগ…
আমি যখনি বিষম খেতাম, ভেবে নিতাম তুমি হয়ত ভাবছো আমাকেই। জানতাম তা হবার নয়, তবু নিজেকে এতটুকু আনন্দ দেবার জন্য এই মিথ্যে ভাবনা ভাবা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আমার।
সেই যে সেদিন থেকে আমার পড়াশোনা ঘুচেছে, তা আর আগের মত হলোই না।তালটা কোথায় যেন কেটে গেলো। ক্লাসে যে মেয়েটা বরাবর প্রথম হতো, সে সেদিন থেকে ফেল করতে শুরু করলো, ভাবা যায়! সেদিন থেকে পড়ার টেবিলে ধূলোরা এসে জমতে থাকলো। ধূলোগুলকে মুছতে মন চাইতো না। মনে হতো, থাকুক না ওরা, ওদের ভালোবাসার বুকে।
সেদিন থেকে আমার চুল এলোমেলো, ঘর, টেবিল,আলনা কলমদানি সবই এলোমেলো। আমি গোছাতে ভুলেছি, নিজেকে সাজাতে ভুলেছি, নিজেকে যত্ন করতে হয়, তাও ভুলেছি। আমি আর আমাতেই ছিলাম না, কোথায় যেন ভেসে গেছিলাম। বৃষ্টি হয়ে ঝড়ে পরেছিলাম অথৈ সাগরে। তারপর ঢেউ আমাকে একবার এদিক পানে ভাসায়, তো আবার ওদিক পানে ডুবায়। ঢেউয়ে ঢেউয়ে বেলা হলো অনেক। ততদিনে তুমি একটা বিরাট রোগে পরিনত হয়েছো। রোগটা কেমন যেন মাথা ব্যাথার মতই…
তুমি যেন মাথাব্যথার মতই
সবসময় কপাল জুড়ে থাকো।
তুমি একঘেয়ে কালো কালি,
মনের ভেতর আঁকিবুকি আঁকো।
তুমি মশার ভ্যান ভ্যান
শুনতে চাই না তবু চাই,
তুমি গগন দহন রোদ
আমি পুড়ে ভষ্ম হয়ে যাই।
তুমি গরম তেলের ফোঁটা,
দাগ হয়ে বেঁচে থাকো,
তুমি কার্বনমনো অক্সাইড,
দম বন্ধ করে রাখো।
আমি হালকা শীতল ছাতা,
গেলাসে চিমটি বরফ
অথবা খাতার রাফ পাতা,
একটু উষ্ণ পরশ।
আমি ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো,
অপ্রয়োজনে ছুঁড়ে ফেলো।
পর্ব ১
চলবে…
৩২টি মন্তব্য
আকবর হোসেন রবিন
বুকের ভেতর প্রচণ্ড হাহাকার তৈরি হলো।
আপনার জন্য রইলো রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কবিতার লাইন
“কষ্ট পাও, কষ্ট পেতে পেতে তুমি হয়ে ওঠো
ফাল্গুনের প্রথম পূর্ণিমা।”
নীরা সাদীয়া
কষ্ট থেকেই কখনো কখনো আনন্দ খুঁজে পেতে হয়।
সুখী হোন জীবনে। এই প্রত্যাশা।
কামরুল ইসলাম
দারুণ লিখেছেন, যেমন চিঠির অভিব্যক্তি, তেমনি কাব্যের অভিপ্রায়
নীরা সাদীয়া
ভালো লেগেছে জেনে প্রীত হলাম।
শুভ কামনা জানবেন।
কামরুল ইসলাম
শুভ কামনা অনেক
সাবিনা ইয়াসমিন
আকাশের কাছে এই চিঠিখানা দ্রুত পৌছে যাক, এত ভালোবাসা যার অন্তরে তার মনে কষ্ট বেশিদিন থাকা ঠিক হবেনা। মন উজাড় করে লেখা চিঠি ভালো লাগলো পড়ে। চিঠির ২য় পৃষ্ঠা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম।
* ব্লগে চিঠি বিভাগ এড করা হয়েছে। লেখাটি একান্ত অনুভূতিতে না রেখে চিঠি বিভাগে দিয়ে দাও।
শুভ কামনা 🌹🌹
নীরা সাদীয়া
আকাশের ঠিকানায় লিখা চিঠি কখনো কি পৌঁছে? পৌঁছে না। তাই সেই চিঠি আকাশের পরিবর্তে সোনেলার পাঠকরাই পড়ুক।
শুভ কামনা জানবেন।
মোহাম্মদ দিদার
বেশ আবেদনময়ী চিঠি।
ভালো লাগলো।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ। শুভকামনা জানবেন।
ছাইরাছ হেলাল
চিঠিতে যন্ত্রণার প্রশ্রবন বইয়ে দিয়েছেন, কবিতাটি জুড়ে দিয়ে আর নিবিড়
করে তুলেছেন, লিখুন।
নীরা সাদীয়া
অনেক সময় যন্ত্রণা প্রকাশেও তৃপ্তি মিলে।
শুভ কামনা জানবেন।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
লেখাটি হৃদয় ছুঁয়েছে। অত্যন্ত দক্ষ হাতে অংকিত করেছেন মনের অভিব্যক্তি।
লেখা এগিয়ে যাক।
নীরা সাদীয়া
লেখাটি আপনাদের হৃদয় ছুঁতে পেরেছে জেনে প্রীত হলাম। শুভ কামনা জানবেন।
মনির হোসেন মমি
সিরিজ চিঠি মনে হয় প্রথম আপনিই লিখছেন।কবিতা দিয়ে চিঠির মান আরো বাড়ীয়ে দিয়েছেন। খুব ভাল লাগল।
নীরা সাদীয়া
সোনেলায় কোনকিছুতে ১ম হতে পেরেছি, এই আমার অনেক খুশির কারণ। পরের পর্বেও থাকবে এমনি আরেকটি কাব্য।
শুভকামনা জানবেন।
ইঞ্জা
এক মহাশূন্য হাহাকার যেন ফুটে উঠেছে, আসলেই আকাশটা যেন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, কিন্তু আপু এই মহাবিশ্বের কোথাও না কোথাও আরেক আকাশের জন্ম হয় অন্য আকাশের বিলীনতায়, দেখবেন একদিন সেই আকাশ আপনার মাথার উপর ছায়া হয়ে উজ্জ্বল তারাদের নিয়ে খেলছে।
নীরা সাদীয়া
এত হাহাকার মানুষকে করে ভাবুক, ভাবুককে করে লেখক। অন্য আকাশ হয়ত আসেই একদিন। কিন্তু সকল শূন্যতা কি উবে যায়?
শুভ কামনা জানবেন।
ইঞ্জা
একটি কথা আছে, সময় সব কিছুই ভুলিয়ে দেয় আপু।
নীরা সাদীয়া
তা ঠিক। সময়ের সাথে সব ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু একেবারে ভোলা যায় না।
জিসান শা ইকরাম
মনের মধ্যে কতটা আবেগ থাকলে এমন চিঠি লেখা যায় তাই ভাবছি।
আকাশের কাছে লেখা চিঠি অনেক ভালো হয়েছে।
পরের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
নীরা সাদীয়া
ভালো লেগেছে জেনে প্রীত হলাম। অনেক শুভকামনা রইলো।
আরজু মুক্তা
চিঠির কি সিরিজ হয়? সম্মানিত এডমিনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
আপনার ঝড়ে ঝড়ে বানানটা ঝরে ঝরে হবে।
চিঠি না হয়ে অণুগল্প হলে ভালো লাগতো।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ শুধরে দেবার জন্য।
নিতাই বাবু
আকাশকে উদ্দেশ্য করে আপনার লেখা চিঠি পড়ে একসময়ের আলোচিত গানটি মনে পড়ে গেল। তা মন্তব্যের বক্সে সেই আলোচিত গানটির লিংক দিলাম। আশা করি সময় করে গানটি শুনে নিবেন।
আপনার চিঠি লেখা কিন্তু দারুণ হয়েছে।
নীরা সাদীয়া
আপনি তো একধাপ এগিয়ে গেলেন। পরবর্তী পর্বে এ গানটাও থাকছে। পরবর্তী পর্বে আরো একটি কবিতা, একটি গান রয়েছে। তার মাঝে একটি এখানে দিয়ে দিলেন আপনি। 😃
নিতাই বাবু
ওহ্ আচ্ছা! তা-ই হোক, তবে আমি মনে হয় আগাম কিছু করে ফেললাম। তা যাইহোক, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
রেহানা বীথি
আহা, এমন ভালোবাসা দূরে ঠেলে দিলো আকাশ? বড় আবেগী চিঠি, ভালো লাগলো ভীষণ।
নীরা সাদীয়া
ধন্যবাদ আপু। পরের পর্ব দেয়া হয়েছে। নিমন্ত্রণ রইলো।
নৃ মাসুদ রানা
আহা! প্রেমের চিঠি।
কোথায় তোকে গুজিয়া রাখি।
নীরা সাদীয়া
হুম, পরের পর্বেে নিমন্ত্রণ রইলো।
সুরাইয়া পারভিন
চিঠি পড়তে পড়তে হারিয়ে গেছিলাম
আকাশরা এমন কেনো হয়?
অনবদ্য সৃষ্টি,,, মুগ্ধতা অনিমেষ
নীরা সাদীয়া
এটাতো আমারও প্রশ্ন। উত্তরটা সম্ভবত আকাশদেরই জানা আছে।