জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক...
জ্ঞানের কান্ডারী শিক্ষক…

ইব্রাহিম স্যার ঃ-

কমলগঞ্জ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। কতো কতো শিক্ষার্থী! কাউকে চিনিনা, জানিনা। শুধু ভর্তির সময় স্কুলের প্রধান শিক্ষক ইব্রাহিম স্যারের সাথে পরিচয় হয়েছে। উনাকে দেখলাম খুবই নরম মনের মানুষ। স্যার এমনিতে আমায় নাকি চিনতেন। তবে সেটা বাপি-মামনির কারণেই। ভর্তির পর আমাকে ক্লাশ টেনের ক্লাশে নিয়ে গেলেন। গিয়ে বসলাম, ক্লাশে কোনো শিক্ষক ছিলো না তখন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি এলেন ক্লাশে। ওহ ইব্রাহিম স্যার আমাদের স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। তিনি ইংরেজী পড়াতেন। সেদিন ক্লাশটেষ্ট ছিলো। কিন্তু আমি নতূন তাই স্যার বললেন পরের দিন পরীক্ষা নেবেন। আমি দাঁড়িয়ে বললাম আজই নিতে। স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি পারবে?” বললাম চেষ্টা করবো। যাই হোক ক্লাশ টেষ্টে পাশ করলাম। মাধবী হলো প্রথম, আমি দ্বিতীয়। মাধবী ক্লাশ টেনের ফার্ষ্ট গার্ল, মানে ওর রোল এক। খুব অহঙ্কারী ছিলো কিন্তু কি কারণে জানি আমার সাথে মিশে গেলো। ইব্রাহিম স্যার সেটা দেখে আমায় উনার রুমে ডাকলেন। যাবার পর বললেন কেন মাধবীর সাথে মিশছি আমি? প্রথমে বুঝিনি ব্যাপার কি! স্যার সেভাবে বলেননি কিছু। শুধু বললেন আমি যেনো খুব বেশী আন্তরিকভাবে না মিশি। যদিও আমি প্রি-টেষ্ট পরীক্ষা দিতে পারিনি, কিন্তু টেষ্ট পরীক্ষা দিয়েছিলাম। টেষ্ট পরীক্ষার পর স্কুলে আসতাম প্র্যাক্টিক্যাল আর ইংরেজী-অঙ্ক ক্লাশ করতে।

**ঘটনাসূত্রে একটা ছোট্ট ঘটনা মনে এসে গেলো। চা’ বাগানের এক কাকুর বাসায় অতিথি এসেছিলো, তো সেই বাসার কাকীমনি আর পিসী ওই অতিথিকে নিয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে এলেন। সুদর্শন যুবক। কিন্তু সমস্যা হলো আমি উনাকে বয়ফ্রেন্ড হিসেবে দেখিনি। বরং বয়সে বড়ো এবং কাকুর কাজিন বলে প্রণাম করেছিলাম। তো উনি একটা চিঠি আমায় পাঠালেন উনারই এক বোনকে দিয়ে। সেটা আমি ফিরিয়ে দিলাম। কিছুদিন পর ডাকযোগে চিঠি হয় আমি প্রেমে রাজি হবো, নয়তো আমাকে এসিড মারবে। আমাদের বাসায় কেউ কারো চিঠি খুলে পড়তো না, বাপি-মামনিকে তাই জানাইনি চিন্তা করবে। আমার দাদাকে মানে বড়ো ভাইকে চিঠিটা দিলাম। এমন হলো ভয়ে স্কুল যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলাম। দাদা তারপর বাপি-মামনির সাথে আলাপ করে। তারপর কি হয়েছিলো জানিনা, তবে ওই লোক এসে ক্ষমা চেয়েছিলো। **

তো সেই সময় স্কুল না যাওয়ার কারণে ইব্রাহিম স্যার একদিন বাসায় এলেন। কি ব্যাপার আমি স্কুলে যাচ্ছি না কেন। শরীর ভালো আছে তো আমার? আমার একটা স্বভাব ছিলো স্যারদের হাত তুলে সম্মান জানানোর পাশাপাশি প্রণামও করতাম। স্যারকেও সেটাই করলাম। তখন বাপিকে বললেন, “আদাব-নমষ্কার সবই পাই করুণা দাদা। কিন্তু মন থেকে সম্মান এই মেয়েটার থেকে পাই (এসব লিখছি নিজের সুনাম বৃদ্ধির জন্য নয়। এমনকি অহঙ্কারী হিসেবেও নয়। ভালো কথাগুলো কেউ কখনো ভুলে যেতে পারেনা। আর এটা লিখতে গিয়ে এক এক করে অনেক কথা মনে চলে আসছে। তাই লিখছি।)।” আসলে স্যার খুব বেশী চিন্তিত ছিলেন ক্লাশে আমার অনুপস্থিতি নিয়ে। তারপর যখন জানলেন বাপিকে বললেন উনি একজন কাউকে পাঠিয়ে দেবেন আমায় স্কুল থেকে নিয়ে এবং দিয়ে যেতে। কিন্তু বাপি বললো একটু ঠিক হয়ে নিক সব, তারপর স্কুলে যাবো। তবে স্যার আসতেন সপ্তাহে দু’দিন করে। এস.এস.সি পরীক্ষার পর স্যার আরেকদিন এলেন, জানতে চাইলেন রেজাল্ট দেয়ার পর কোথায় ভর্তি হবো? তখনও ঠিক জানিনা আমি। তবে যেদিন রেজাল্ট পেলাম, স্যার বাসায় এসেছিলেন। কেঁদেছিলেন, আমি প্রথম বিভাগ পাইনি তাই। মার্কশিট পাবার পর বাপি ঠিক করলো চ্যালেঞ্জ করবে কারণ আমি বাংলা দ্বিতীয় পত্রে মাত্র তেত্রিশ পেয়েছি, আর সেটা অসম্ভব। স্যার বাপিকে বললেন চ্যালেঞ্জ না করে রি-এক্সামিন করাতে। পরে শুনেছি রি-এক্সামিনে কিছু হয়না, চ্যালেঞ্জ করা উচিৎ ছিলো। স্যার যখন জানলেন এসে আমায় বললেন, “নীলাঞ্জনা ভুল হয়ে গেছে। আমায় ভুল বুঝোনা। মাঝে-মধ্যে শিক্ষকরাও ভুল করে।” আমি স্যারকে কখনোই ভুল বুঝিনি। যদিও স্যারের সাথে অতোটা ক্লোজ ছিলাম না, কিন্তু স্যারের আবেগ ছিলো আমার প্রতি। স্যারের স্ত্রী ম্যাডামও খুব ভালো ছিলেন। কলেজে ভর্তির আগে একদিন স্যারের বাসায় গিয়েছি, ম্যাডাম অনেক যত্ন করলেন। সেমাই বানালেন। আসার সময় বলেছিলেন, “নীলাঞ্জনা আবার এসো।” আর যাওয়া হয়নি। কিভাবে যাবো? আমরা তো পেছন ফিরতে পারিনা, সময় কোথায়? চলার পথেই বা ক’জনকে সময় দেই?

শিবাণী ম্যাডাম ঃ-

স্কুলের সকল ছাত্রীরাই ম্যাডামকে ভয় পেতো। জানিনা কেন! উনার ক্লাশ খুব কমই করেছি। রোগা-পাতলা ছিপছিপে দেখতে ছিলেন ম্যাডাম। মাথা উঁচু করে হাঁটতেন। ম্যাডাম বাংলা পড়াতেন। উনার মুখে হাসি নাকি কোনো ছাত্রী-ই দেখেনি, সহপাঠিরা বলেছিলো। যাই হোক ম্যাডামের সাথে আমার প্রথম কথা ক্লাশে। একটা কবিতার সারাংশ নিজের ভাষায় লিখে সেটা পড়ে শোনাতে হবে, তাও নিজের লেখা না দেখে। মাথায় হাত, নিজের ভাষায় লিখবো সে নয় ঠিক আছে। সেই লেখা না দেখে আবার মুখে বলা, এ কেমন কথা! কিন্তু ম্যাডাম এমনই নাকি। যাক লিখলাম। এবার ডায়াসের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলা শুরু করলাম। একটা শব্দ “আষাঢ়”-এর “ঢ়” উচ্চারণে থামিয়ে দিলেন ম্যাডাম। বললেন, “নীলাঞ্জনা আবার বলো।” বুঝতে পারছিলাম না উচ্চারণ তো ঠিকই আছে। মামনি তো এভাবেই শিখিয়েছিলো। যাক আবার বললাম। এবার ম্যাডাম এক এক করে ক্লাশের সকলকে বললেন “আষাঢ়” শব্দের উচ্চারণ করতে। “ঢ়”-এর উচ্চারণ শেখানোর চেষ্টা বৃথা হলো সেদিন, কারণ ঘন্টা পড়ে গেলো। যাবার সময় ম্যাডাম বললেন পরেরদিন যেনো দেখা করি। পরেরদিন টিফিন পিরিয়ডে সিঁড়িতে বসে আছি, হঠাৎ ম্যাডাম আমার সামনে। সেদিনকার কথোপকথন আমি ডায়েরীতে লিখে রেখেছিলাম। সেই ডায়েরী এখন নেই। কিন্তু কথাগুলো মনের খাতায় আছে। এমনি কিছু কথা বলে তারপর প্রথম প্রশ্ন করলেন,
ম্যাডাম – অক্ষরের উচ্চারণ কে শিখিয়েছে?
আমি- আমার মামনি।
ম্যাডাম – শুনেছি উনি টিচার, তাই না?
আমি – হ্যা ম্যাডাম।
ম্যাডাম – এই যে বাবা-মা শেখাচ্ছেন কাজে কি আসছে কিছু জীবনে? (আমি মাথা নীচে করে রাখলাম। কারণ কি বলবো, বুঝতে পারছিলাম না।) মাথা নীচু করে আছো কেন? প্রশ্নের উত্তর না পেলে সরাসরি বলবে। যারা অন্যায় করে, একমাত্র তারাই মাথা নুয়ে রাখে।
আমি – ম্যাডাম গুরুজনদের সামনে মাথা নুয়ে রাখতে হয় না?
ম্যাডাম – না, হয় না। আচ্ছা বলো কয় ভাই-বোন তোমরা?
আমি – দুই বোন।
ম্যাডাম – বড়ো হয়ে বিয়ে করবে, তারপর নিজের সংসার। বাবা-মায়ের কথা কি মাথায় রাখো? (আমি কি লজ্জ্বা! বিয়ের কথা, ইস রে!!) শোনো আমাদের সমাজ-ব্যবস্থায় মেয়েরা নাকি পরের সম্পত্তি, মানুষ কখনো সম্পত্তি হয়না, হতে পারেনা। একজন ছেলেও যা, একজন মেয়েও তা। কথাটা মনে রেখো। তোমার বিশাল দায়িত্ত্ব একজন সন্তান হিসেবে। বাবা-মায়ের যত্ন নিও যখন নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ঠিক আছে?
আমি – ঠিক আছে ম্যাডাম।
মাথায় একটা হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। মাধবী দৌঁড়ে এলো জানতে। কিছু বলিনি। তবে এটা ঠিক সেদিনই প্রথম মাথায় ঢুকলো বাপি-মামনির জন্য আমার করতে হবে। পরীক্ষার পর স্কুল থেকে চলে এলাম, আর দেখা হয়নি ম্যাডামের সাথে। জানিনা কেমন আছেন? আমরা জীবনে সবচেয়ে বড়ো ভুল করি, শিক্ষকদের ঠিকানা রাখিনা। একটা জীবন গড়ে তুলতে কতো শিক্ষার যে প্রয়োজন। বাংলার শিক্ষক শিবাণী ম্যাডাম, কিন্তু আমায় উনি দায়িত্ত্ব পালনের শিক্ষা দিলেন। শুধু মাত্র একটি শব্দের সঠিক উচ্চারণ করে কতো বিশাল একটা শিক্ষা পেলাম, এ ঋণ কি শোধ করা যাবে আদৌ?

ক্রমশ

হ্যামিল্টন, কানাডা
৩ আগষ্ট, ২০১৬ ইং।

শামসুল হক স্যার ও রীতা ম্যাডাম – যাঁদের কাছে ঋণী এ জীবন : ষষ্ঠ ভাগ

১১৩৭জন ১১৩৫জন
0 Shares

৩৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ