
স্টিলের ওভার ব্রীজের ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে আনমনে চোখ বুজে গান গাইছে একজন। গলায় পেঁচিয়ে মুখের সামনে মাইক্রোফোন, গলায় ঝুলানো পেটের কাছে এক বাদ্য যন্ত্র, পায় আটকানো হুক এর সাথে যুক্ত স্ট্যান্ডে রাখা ড্রাম, বাঁশি, ছোট তবলার মত, সব নিয়ে ছয় সাতটি বাদ্য যন্ত্র বাজাচ্ছে সে গানের সাথে সাথে। পাশেই বসে আছে ছোট একটি ছেলে, ছেলেটির সামনে বড় কাঠের একটি গামলা রাখা। বুঝতে অসুবিধা হয়নি গায়ক অন্ধ। পথচারীদের এভাবে গান শুনিয়ে আনন্দ দিয়ে অর্থ উপার্জন করেন।
তার গলার সুরে কি এক টান। অন্তর স্পর্শ করে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ান ভাষায় গান গাইছে। গান এর একটি শব্দও বুঝিনা, অথচ সুর যেন আমারই। মন্ত্রমুগ্ধের মত তার গান শুনছিলাম। ত্রিশ মিনিট তো হবেই। চলে যেতে ইচ্ছে করছিল না। এমনই নিবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম তার সুরের যাদুতে, মনে হচ্ছিল আমিই গাইছি গান।
পথচারীরা কেউ গান শুনে, কেউ না শুনে কাঠের গামলায় দুই, পাঁচ, দশ রিংগিত রাখছে। আমি একটু বেশিই দিলাম। ছোট ছেলেটি আমার দেয়া নোটটি দেখে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো, আমি হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে গান শুনছিলাম।
সমস্ত দিনই সে হয়ত গান গায়, মাঝে মাঝে বিরতি দেয়। তার কষ্ট দেখে আমারও কষ্ট হচ্ছিল। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তার গলা থেকে মাইক্রোফোনটা নিয়ে আমি তার জন্য গান গেয়ে তাকে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করি। কিন্তু আমার ইচ্ছে পুরণ করতে পারিনি।
তবে একটি প্রবল ইচ্ছে তখন থেকে ধারণ করে আছি, একবারের জন্য হলেও আমি এদের জন্য এদের হয়ে রাস্তায় দাড়িয়ে গান গেয়ে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করবো। অবশ্যই দেশে নয় প্রবাসে।
এমন স্ট্রিট সিংগার আমি যতটি দেশ ভ্রমন করেছি প্রায় সমস্ত দেশেই দেখেছি। কারো কাছে এরা কোনো অর্থ চান না, কেউ দিলে দিবে, না দিলে না দিবে। আর এক ধরনের স্ট্রিট সিংগার আছেন যারা মনের আনন্দে গান গায়, অর্থ গ্রহন করেন না।
আমাদের দেশেও এমন আছেন। এরা ট্রেন, ফুটপাথ, লঞ্চে দাড়িয়ে গান গেয়ে থাকেন। এদের দু একজনের কণ্ঠ এত সুন্দর যে অবাক হতে হয়।
কয়েকবছর আগে কুয়াকাটা গিয়েছিলাম অত্যন্ত প্রিয় কিছু মানুষদের সাথে। সন্ধ্যার কিছু আগে এমন এক গায়ককে পেলাম। আমন্ত্রন জানালাম আমাদের গান শোনাবার জন্য। তার গানের সুর ঐ সময়ের পরিবেশকে কতটা আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তা আমি প্রকাশ করতে অক্ষম।
এখনো তার গান ভেসে আসে সাগরের হাওয়ায়,
* ছবি গুগল থেকে নেয়া।
১৩টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
একজন অন্ধ শিল্পী, চোখে দেখতে পারেনা। তারপরেও ছয়/সাতটি বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে গান করেন। ভিক্ষাবৃত্তিকে কোনোভাবেই পেশা হিসেবে গ্রহন না করে নিজের চেষ্টায় কিছু করা আর সফল হওয়া।
ব্যাপারটি ভাবতেই ভালো লাগে। পথ শিল্পীদের প্রায়ই দেখি, কেউ গান গায়, কেউ বাঁশি বাজায়। খুব অসহায় আর দারিদ্র্যের মাঝে থাকে তবুও কারো কাছে হাত পাতেন না। পথশিল্পী আর ভিক্ষুকদের মাঝে পার্থক্য এটাই। শিল্পীর মাঝে আত্মসম্মান বোধ প্রবল থাকে। তাদের আত্মসম্মান ও ব্যাক্তিত্বের কারনেই সাধারণ মানুষ তাদের নিজ থেকেই সহায়তা করে। তাদের সুর-গানে নিজেরা প্রফুল্ল হয়, ছড়িয়ে দেয় সবার মাঝে।
লেখা ভালো লেগেছে। শুভ কামনা 🌹🌹
জিসান শা ইকরাম
হ্যা, এদের আত্মসন্মান বোধ খুবই প্রখর।
এদের আর ভিক্ষুকদের মধ্যে এটিই পার্থক্য।
এমন মন্তব্যে লেখার আগ্রহ বৃদ্ধি করে,
ধন্যবাদ, শুভ কামনা।
রাফি আরাফাত
অক্ষমতা বলতে কিছু নেই, চাইলেই সম্ভব। কবিতাটা অনেক মনে পড়ছে, পারিবো না এ কথাটি বলিও না আর। কেন পারিবে না তাহা ভাবো একবার।
আসলে আমরা পারবোনা নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত। যা সহজেই আমাদের অক্ষম করে দেয়৷
ভাল লাগছে লেখা। শুভ কামনা
জিসান শা ইকরাম
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়ই,
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য,
শুভ কামনা।
ছাইরাছ হেলাল
আমাদের দেশে এমন গায়কদের ঘৃণার চোখে দেখা হয়, সবাই আমরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি।
সাহায্য প্রায় দেই না বলেই বলা যায়, বিরক্ত হয়ে তাড়িয়ে দিতে পারলেই বাঁচি।
বিদেশে এমন মনে হয় নি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাচ্ছে বলে ফইন্নি কেউ মনে করে না।
অনেক সময় নিয়ে দাঁড়িয়ে গান শুনেছি, পথচারীরা কে কি করে তাও লক্ষ্য করেছি।
মাসুদ চয়ন
মহত্ত্বের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দাদা।
ইঞ্জা
ভাইজান মুগ্ধ করলেন আমাকে, এমন বিষয় নিয়ে লিখলেন যে মন্ত্রমুগ্ধ না হয়ে পারি?
স্ট্রিট সিঙ্গার, এরা যেমন গায় তেমনি ওদের গানের সঙ্গে অনেকে নাচায়, প্যারিসের এক রাস্তায় একবার অল্প নেচেছিলাম ১৯৯৪ তে, যদিও সেইটা নাচ ছিলো কিনা আমার সন্দেহ হয় এখনো। 😜
আপনার জন্য বলি, বিখ্যাত চট্টলার গান “মধু হই হই বিষ খাওয়াইলা” ” তোয়ারে দেখকিলাম জিইসির মুরুত” স্ট্রিট সং যা কক্সবাজারের এক স্ট্রিট সিঙ্গারই গেয়েছিলো।
রেহানা বীথি
এমন গান শুনে আচ্ছন্ন না হয়ে উপায় থাকে না।
মানুষকে আনন্দ দেয়া.. হোক সে ক্ষণিকের জন্য, কিংবা হোক তা সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে, এর চেয়ে ভালো কাজ আর কিছু হয় না। আর সেই কাজে অংশগ্রহণের ইচ্ছা ব্যক্ত করা এক অনন্য বোধের পরিচয়। শ্রদ্ধা জানাই সেই বোধকে।
লেখাটা পড়ে আবেগতাড়িত হলাম ভীষণভাবে।
বড় ভালো লিখলেন।
তৌহিদ
লেখা পড়ার আগে গান শুনলাম, বেশ লাগলো শিল্পীর গান। স্ট্রিট সিঙ্গাররা আমাদের দেশে অবহেলিত সবসময়। অথচ তারা নিজের মেধা আর শ্রম দিয়েই কিন্তু অর্থ উপার্জন করছে। আপনার লেখায় অনুপ্রাণিত হলাম তাদের জন্য। যদি কখনো সুযোগ হয় অবশ্যই সাহায্য করবো সবসময়।
মনির হোসেন মমি
এক সময় হাটে বাজারে মজমা হত। সেখানে যে ধরনে গান বাজনা পরিবেশন করা হত তা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এ ধরনের স্টিট গান আমার খুব ভাল লাগে।সামনে পড়ে গেলে শুনি।
প্রদীপ চক্রবর্তী
বাহ্!
মন্ত্রমুগ্ধ।
অংশগ্রহণমূলক কাজ নিশ্চয় প্রশংসার দাবীদার।
অনেক অনেক অনুপ্রাণিত হলাম দাদা।
সামান্য অর্থ এত মহৎকাজ তাই সব শ্রদ্ধা করি তাদের।
বেশ ভালো লেখনী দাদা।
আগের কমেন্টে ভুল আছে।
তাই দুঃখিত।
আরজু মুক্তা
শিল্পীররা এমনি। নিজেকে উদার করে আমাদের অন্তরের ক্ষুধা মেটায়।
জাহিদ হাসান শিশির
এমন একজন স্টিট সিংগারকে ছোটবেলায় চিনতাম।
লোকটা ছিল ছোটখাট, শারীরিক প্রতিবন্ধি।
অনেক ভাল হিন্দি ও পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার গান গাইতো। লোকে খুশি হয়ে দুই টাকা দিতো।
এভাবেই তার দিন চলতো। ছয় বছর আগে সেই লোকটি ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে।