তখন আমি খুব ছোট। একটা তিনচাকার সাইকেল চড়ে ঘরে-বাইরে, মাঠে-বারান্দায় ঘুরে বেড়াই। সাইকেলটা বিশাল বড়। সামনে একটা ছোট driving seat. পেছনে একটা চওড়া বড় passenger seat. তিন-চার লাইনের ছড়াটা খুব পছন্দ হয়েছিল। সাইকেল চালাতে চালাতে সুর করে আবৃত্তি করি, সারাক্ষণ করি। বাচ্চারা যা করে, বেশি বেশি-ই করে। আশে পাশের লোকজন কেউ কেউ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, কেউ কেউ মুচকি হাসে। আমি আবৃত্তি করি আর চালাই। চালাতে চালাতে কালো পিচের রাস্তা, সবুজ ঘাসের মাঠ, বেনীআ মাস, সহকলা বছর পার হয়ে যাই। চাকা ঘোরে, ঘুরতে থাকে বনবন বনবন। সাইকেলটাকে আরব্য উপন্যাসের যাদুর গালিচা মনে হয়, যেখানে মন সেখানে গমন।
সেই সাইকেলের সামনের tyre-টা একসময় ছিঁড়ে যায়, সেটি আর চালান যায় না। সাইকেলটি দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয় একটা নীল রঙের Pipe-এর সাথে। সাইকেলটা ঝোলান থাকে উল্টো করে। Seat নীচের দিকে, চাকাগুলো ওপরে। যেন কালো পীচের রাস্তা ছেড়ে দিয়ে সে এবার টিকটিকির মত হাঁটবে আকাশের নীল কাচ বেয়ে। অথবা উল্টে দেয়া হয়েছে বালিঘড়িটা। ওপরের বাটি থেকে এইবার দিনমান বালি ঝরবে নীচের বাটিতে।
তারপর কিভাবে যেন আমি বড় হয়ে যাই। তিন চাকার বিশাল সাইকেলটা ছোট হতে হতে খেলনা হয়ে যায়। সাইকেলটার সাদা Seat Cover, ঘন নীল রঙের Pedal, টকটকে লাল রঙের চাকাগুলো ধুলো জমে জমে ধুসর হয়ে ওঠে। একদিন সাইকেলটাও আর থাকে না। কিভাবে যেন কোথায় হারিয়ে যায়, আমার শৈশবের মতই। এরপর কবে যেন ভুলে গেছি সব। সাইকেল, শৈশব, ছড়া, আরব্য উপন্যাস, যাদুর গালিচা, বেনীআসহকলা – সব। কিন্তু সাইকেল না থাকলেও তার চাকাগুলি থাকে, সেগুলো থামেনা। ঘুরতেই থাকে, ঘুরতেই থাকে…আচ্ছা চাকা ঘোরার সময় কি টিক! টিক! শব্দ হয়?
সময় বহিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়-
যে জন না বোঝে তারে ধিক! শত ধিক!
২০টি মন্তব্য
প্রহেলিকা
বাহ! বাহ! চমৎকার একটি লেখা! এই লাইনটা মনে থাকবে অনেক অনেকদিন!
“তিন চাকার বিশাল সাইকেলটা ছোট হতে হতে খেলনা হয়ে যায়।”
কি অপূর্ব করে লিখেছেন সার্বজনীন মনের অভিব্যক্তি।
গদ্য কিংবা পদ্য, সবজায়গাতেই আসন গেড়েছেন দেখছি।
আসিফ ইকবাল
প্রহেলিকা! অনেক ধন্যবাদ। আসলে কবিতাই লেখা হয়েছে বেশী। গদ্য খুব কম। আপনাদের মন্তব্যে উৎসাহ পাচ্ছি।
মোঃ মজিবর রহমান
জীবন বহমান চলেই থাকে চলতেইইইইইইইইই
সুন্দর জীবন বোধ।
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ ভাই। হুম, চলতেই থাকে, চলতেই থাকে-
নীরা সাদীয়া
সাইকেলের সাথে শিশুকালটাও হারিয়ে যায়! আহা!
দারুন লাগলো আপনার শৈশব কথন।
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ নীরা। খুব miss করি সেই নিষ্পাপ আমাকে। ভালো থাকবেন।
তৌহিদ
নিজের ছেলেবেলা মনে করিয়ে দিলেন ভাই। জীবন যে জীবনের গতিতে চলতেই থাকে!
ভালোলাগা রেখে গেলাম।
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ ভাই। জীবন চলে জীবনের মতোই। সে কারো তোয়াক্কা করে না। আমরাই পড়ে থাকি আমাদের ভুল, আমাদের ব্যার্থতা নিয়ে-
শুন্য শুন্যালয়
ঠিক এই লাইনটিতে আমিও আটকে গিয়েছি। “তারপর কিভাবে যেন আমি বড় হয়ে যাই। তিন চাকার বিশাল সাইকেলটা ছোট হতে হতে খেলনা হয়ে যায়।” অদ্ভূত সুন্দর। আর উলটে দেয়া বালিঘড়ি থেকে দিনমান ঝরে পড়া বালি!
আপনি তো সাংঘাতিক লেখেন!
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ ভাই। লিখি আর কি, যাহা আসে মনে!
সাবিনা ইয়াসমিন
শূন্য ভাইয়া, হাহাহাহাহা মজা পেলাম 😁😁
শুন্য শুন্যালয়
দুঃখের কথা কী আর বলবো!! 🙁 আরেকজনও দেখলাম সমানে ভাই বলতেছে। আমি আমার নাম নিয়া হতাশ :'(
আসিফ ইকবাল
অ্যাঁ, আফনে আফা নিহি! মিশটেক হয়া গেছে! 🙁
আসিফ ইকবাল
তাই বলি! সাবিনা হিহি করে হাসে কেন!!
মনির হোসেন মমি
দারুণ সহজ সরল জীবনি গাথা।
আসিফ ইকবাল
ধন্যবাদ মমি।
ছাইরাছ হেলাল
কবিদের গদ্য পড়ার মজাই আলাদা।
আসিফ ইকবাল
এইখানে আপনার সাথে পুরোপুরি একমত ভাই। সত্যিই কবিদের গদ্যের মাঝে অন্যরকম এক সুর থাকে।
সাবিনা ইয়াসমিন
বে নী আ স হ ক লা… এগুলো কি শুধু রঙের প্রতীক? আর কিছু নয়? সাইকেলের টায়ার ছিঁড়ে যাওয়ার মতো কিছু একটা। বালি ঘড়ি আমাদের সবার একটা করে থাকে, হয়তো খুব জরুরী তাই ওটাকে আমাদের সাথে ফ্রী দেয়া হয়েছে। যখনি ইচ্ছে হবে উঁকি দিয়ে দেখবো এর উত্থান–পতন। বালি গুলো কেবল নীচে গড়িয়ে পরে, পরতেই থাকে। যেমন করে আমাদের সময় গুলো বাতাসেরও আগে পাশ কেটে চলে যায়…..
আসিফ ইকবাল
সাবিনা, রঙের প্রতীক বটে। দৃশ্য রঙ, অদৃশ্য রঙ- সবরকম রঙ, যা প্রতিনিয়ত রাঙিয়ে চলেছে আমাদের দিনমান। হুম, এই সাইকেলটা তো ছোটদের তিন-চাকার সাইকেল। এইটার টায়ারে বাতাস থাকত না। গোল রাবারের একটা টুকরো। পুরানো হলে এটা ছিঁড়ে যেত। হ্যাঁ, বাতাসের-ও আগে, কিভাবে যেন বালি ওড়ার মতো করে উড়ে যায়। সময়।