পত্রিকা জুড়ে বিচিত্র সব সংবাদ। নাইজেরিয়ায় এক মৃতদেহ দাফনে কফিনের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে নুতুন কেনা বিএমডব্লিউ গাড়ি, ভারতে ৯৬ বছর বয়সে পিতৃত্বের স্বাদ পেয়েছেন রামজিৎ রাঘব। নারায়ণগঞ্জে পুরুষ নির্যাতন বিরোধী আইনের দাবীতে মানববন্ধন করেছে একদল যুবক। এমন অনেক বিচিত্র খবরের মাঝে একটা শিরোনামে চোখ আটকে যায় -“প্রেমিককে ইমো কলে রেখে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্নহত্যা করলো তরুণী” । বিস্তারিত জানার জন্য লিংকে ক্লিক করা হল। সেখান থেকে যা জানা গেল তা হচ্ছে এরকম-
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জনৈক চাঁদনী আহমেদের সঙ্গে অন্য একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তানভীর ফাহাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। তাদের দুজনেরই দেশের বাড়ি খুলনায়। খুলনায় একই কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সুবাদে তাদের মধ্যকার সম্পর্কের শুরু। সেটা আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে একসময় শারিরীক পর্যায়ে পৌছায়। এই পর্যায়ে চাঁদনী আহমেদ তানভীর ফাহাদকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। চাঁদনীর চাপেই হোক কিংবা ভালবাসার টানে যাই হোক না কেন তানভীর ফাহাদ বিয়ের জন্য রাজী হয়। দুই পরিবারের মধ্যে বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে কিন্ত শেষপর্যন্ত তানভীর ফাহাদের পরিবার বিয়েটা ভেঙ্গে দেয় কারন মেয়ের পরিবারের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান তাদের থেকে বেশ খানিকটা নিচে। পারিবারিক ভাবে বিয়েটা ভেঙ্গে গেলেও চাঁদনী আহমেদ আর তানভীর ফাহাদের মধ্যে যোগাযোগ চলতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা ঢাকার এক কাজী অফিসে গোপনে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্ত নির্ধারিত দিনে নির্ধারিত স্থানে তানভীর ফাহাদ আর আসেনি। এনিয়ে তাদের দুজনের মধ্যে ইমোতে ঝগড়া হয় এবং ঝগড়ার এক পর্যায়ে তানভীর ফাহাদকে ইমো কলে রেখেই ফ্যানে ওড়না প্যাচিয়ে আত্নহত্যা করে চাঁদনী। ফোনে দীর্ঘক্ষণ কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তানভীর ফাহাদ নিজে চাঁদনী আহমেদের বাবাকে ফোন করে বিস্তারিত জানায়। চাঁদনীর বাবা চাঁদনীর এক বান্ধবীকে ফোন করে তার খোঁজ নিতে বলে। দীর্ঘক্ষণ দরজায় নক করে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে সে এবং আরো কয়েকজন মিলে দরজা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেয় এবং দরজা ভেঙ্গে চাঁদনী আহমেদকে ঝুলন্ত এবং মৃত অবস্থায় আবিস্কার করে। সেখান থেকে একটা চিরকুট বা সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। তাতে লেখা- “আব্বু-আম্মু তোমরা আমাকে মাফ করে দিও, আমাদের সম্পর্ক যে পর্যায়ে গেছে তাতে আমার আর ফেরার কোন উপায় ছিল না। ওর যেন ন্যায্য শাস্তি হয় আর আল্লাহ যেন আর কোন মেয়েকে গরীব ঘরে জন্ম না দেয়”। ইতমধ্যে তানভীর ফাহাদ আর তার পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে আত্নহত্যার প্ররোচনার দায়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। চাঁদনী আহমেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীরা আসামীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবীতে মানববন্ধন করেছে। আর রিপোর্টের শেষ অংশে রয়েছে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল কাদেরের বয়ান। তিনি বলেছেন- আসামীদের গ্রেপ্তারে পুলিশ দিনরাত কাজ করছে, তারা গ্রেপ্তার হবে শীঘ্রই।
রিপোর্টটা এখানেই শেষ। খবরটি পড়ে এক গুচ্ছ ভাবনায় আক্রান্ত হই। বিশ্বব্রক্ষান্ডে খুব অল্প কিছু প্রাণীই নিজেকে ধবংস করতে পারে, মানুষই তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত। পৃথিবীর সব প্রাণীরই সৃষ্টি করার অর্থাৎ নিজের বংশ বিস্তার করার ক্ষমতা রয়েছে কিন্ত বিচিত্র উপায়ে নিজেকে ধবংস করার বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতার অধিকারী শুধু মানুষই। একজন মানুষ যে কিনা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে এই পৃথিবীর প্রতি আকর্ষিত হবার মত আর কোন কিছুই তার জন্য অবশিষ্ট নেই, জীবন মৃত্যুর শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে ফাঁসের দড়িতে ঝুলে পড়বার ঠিক আগ মুহূর্তে সে আসলে কি ভাবে?
আমাদের সামনে এই মুহূর্তে তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত আছে। ধরা যাক তাদের নাম যথাক্রমে X, Y এবং Z। তাদের লিঙ্গ পরিচয়ের প্রশ্নটা মুখ্য নয়। প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেওয়া হল তাদের তিনজনকেই-
চাঁদনী আহমেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
তারা তিনজনই একসঙ্গে ভাবনায় ডুবে যান। পুরো ঘরে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা নেমে আসে। স্তব্ধতা ভেঙ্গে প্রথম উত্তর আসে X এর কাছ থেকে। তিনি বলেন-
আমার মতে চাঁদনী আহমেদের মৃত্যুর জন্য যদি কেউ দায়ী হয়ে থাকে তবে তা হচ্ছে সে নিজে। লক্ষ্য করুন চাঁদনী আহমেদ ইউনিভার্সিটির থার্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। তার বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থাৎ তিনি বাংলাদেশের একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিক। একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নাগরিকের নিজের সম্পর্কে ভালমন্দ যে কোন ডিসিশন নেওয়ার অধিকার রয়েছে। হ্যাঁ, এটা সত্য যে চাঁদনী আহমেদ তার প্রেমিক তানভীর ফাহাদের কাছ থেকে প্রতারণার স্বীকার হয়েছেন, বিয়ের ব্যাপারে তার আশাভঙ্গ হয়েছে কিন্ত জীবনে চলার পথে এরকম আশাভঙ্গের ঘটনা, চাওয়া পাওয়ার হিসেবে এরকম অমিল তো আমাদের প্রায় সবার জীবনেই কমবেশি ঘটে। আমরা একেকজন একেক ভাবে এই কষ্টগুলোকে হ্যান্ডল করি। চাঁদনী আহমেদ যদি মনে করেন যে একমাত্র মৃত্যুই এই আশাভঙ্গ বা প্রতারণার স্বীকার হওয়ার কষ্ট হ্যান্ডল করার একমাত্র উপায় তবে তিনি সেটা মনে করতেই পারেন। জীবন কেড়ে নেওয়ার এই সিদ্ধান্তটা তো তার নিজের নেওয়া। তিনি তো কারো কোন ক্ষতি করছেন না। তার সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। আসল কথা হচ্ছে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার তার আছে। প্রতিটা মানুষ স্বাধীন, তার স্বরুপ এমনই যে সে স্বাধীন। তার আচরন বা কাজকে ন্যায় সঙ্গত বলে যাচাই করবার মত সার্বিক কোন নীতি বা মুল্য নেই। সে নিজেই তার নীতি বা মুল্যের স্রষ্টা। সে নিজেই নিজের সংজ্ঞা দেয়, প্রয়োজনে নিজের জন্য আইন তৈরী করে , কোন ভাগ্য বা অদৃষ্ট দ্বারা সে নিয়ন্ত্রিত নয়। এপ্রসঙ্গে আমরা গ্রিক পুরাণের অরেষ্টিসের কাহিনী স্মরণ করতে পারি । আরগসের রাজা অগামেননকে খুন করে সিংহাসন দখল করে তার ছোট ভাই এজিষ্টাস। অগামেননকে খুন করার পর এজিষ্টাস অগামেননের স্ত্রী ক্লাইটেমনেষ্ট্রাকে বিয়ে করেন এবং অপরাধক্লিষ্ট মনে রাজ্য শাসন করতে থাকেন। অগামেনন আর ক্লাইটেমনেষ্ট্রা্র সন্তান রাজপুত্র অরেষ্টিস তার গৃহ শিক্ষকের সঙ্গে জীবিত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দীর্ঘ পনের বছর আত্নগোপনে থাকার পর অরেষ্টিসের সঙ্গে তার বোন ইলেক্ট্রার সাক্ষাত ঘটে এবং তারা দুজনে মিলে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে তাদের মা ও চাচাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। মহাদেবতা জিউস তাদের এই পরিকল্পনা জানতে পেরে অরেষ্টিসকে এই কাজ করা থেকে বিরত থাকতে বলে। কিন্ত শেষ পর্যায়ে অরেষ্টিস জিউসের আদেশকে সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে তার মা ও চাচা এজিষ্টাসকে হত্যা করে। জিউস তখন অরেষ্টিসকে তার পাপের জন্য অনুতপ্ত হতে বলে। অরেষ্টিস তখন উত্তর দেয়- আমি পাপী নই, যে কাজকে আমি পাপ বলে মনে করি না সে কাজের জন্য আমাকে অনতপ্ত হতে বলার কোন ক্ষমতা তোমার নেই। জিউস তখন দাবী করেন যে তিনি বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের স্রষ্টা, সমগ্র বিশ্ব তার আইনানুসারে চলে কাজেই অরেষ্টিসের উচিত তার আদেশ মেনে চলা। কিন্ত অরেষ্টিস উত্তর দেয়- তোমার সমস্ত শক্তি আমাকে দোষী প্রমাণ করতে অক্ষম। তুমি দেবতাদের রাজা, পাথর ও নক্ষত্রের রাজা হতে পার কিন্ত মানুষের রাজা তুমি নও। জিউস তখন বলেন যে – ধৃষ্টতা তোমার! আমি তোমার রাজা নই, কে তাহলে তোমাকে সৃষ্টি করেছে?। জিউসের কথায় সম্মতি দিয়ে অরেষ্টিস উত্তর দেয়- কিন্ত তুমি ভুল করেছো, আমাকে স্বাধীন করে সৃষ্টি করা তোমার উচিত হয়নি। জিউস তখন বলেনঃ তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলাম আমার সেবা করার জন্যই। কিন্ত অরেষ্টিস তা মানতে নারাজ, তিনি বলেন- আমি নিজেই আমার স্বাধীনতা, সৃষ্ট হবার পর থেকে আমি আর তোমার কেউ নই।
মানুষের স্বাধীনতার এর চেয়ে বড় উদাহরন আর কি হতে পারে? কাজেই চাঁদনী আহমেদ যদি তার নিজস্ব চিন্তা দ্বারা সৃষ্ট নীতি দ্বারা স্বেচ্ছামৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন তবে আমাদের উচিত তার এই সিদ্ধান্তকে রেসপেক্ট করা। কোন সন্দেহ নেই যে বিয়ের ব্যাপারে তানভীর ফাহাদের ফ্যামিলির মানসিকতা জঘণ্য। তানভীর ফাহাদ যে চাঁদনী আহমেদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এটাও মোটামুটি প্রমাণিত, এই প্রতারণার জন্য তানভীর ফাহাদের উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত কিন্ত চাঁদনী আহমেদের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী নয়।
আমরা মনযোগ দিয়ে এক্স এর বক্তব্য শুনি। এবার কথা বলতে শুরু করেন Y। তিনি বলেন-
এটা পরিষ্কার ভাবেই ষ্পষ্ট যে চাঁদনী আহমদের মৃত্যুর জন্য দায়ী তানভীর ফাহাদ আর তার পুরো পরিবার। রিপোর্টে যদিও উল্লেখ নেই তবুও এটা ধরে নেওয়াই যায় যে তানভীর ফাহাদ সম্ভবত বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চাঁদনী আহমেদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা তানভীর ফাহাদের দায়িত্ব ছিল কিন্ত সে এটা পালন করেনি। বাংলাদেশের আইনে এটাকে ধর্ষণ বলে সংজ্ঞায়িত করা আছে। আর যদি তাদের মধ্যকার শারীরিক সম্পর্কের পিছনে কোন বিয়ের প্রতিশ্রুতি নাও থেকে থাকে তবুও তানভীর ফাহাদ দায় এড়োতে পারে না। কে জানে মেয়েটি হয়তো প্রেগনেন্ট ছিল, আমাদের সমাজে কোন মেয়ের যদি বিয়ে বহির্ভূত শারীরিক সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়ে যায় তাহলে তাকে কি পরিমান লাঞ্ছনা গঞ্জনা আর অপমানের শিকার হতে হয় তার কি কোন ধারনা আছে? তারা যা করেছে সেটা দুই পক্ষ মিলেই করেছে কিন্ত এই লাঞ্ছনা আর অপমানের অনিঃশেষ কষ্টের ভার মেয়েটা শুধু একা বইবে কেন? কাজেই তানভীর ফাহাদের উচিত ছিল বিয়ের মাধ্যমে পুরো ব্যাপারটিকে একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা এবং মেয়েটার কষ্টের ভার হালকা করা। এখন কেউ কেউ বলতে পারে যে তানভীর ফাহাদ নিজেই অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী নয় , বিয়ের মাধ্যমে মেয়েটার যাবতীয় দায়িত্ব নেবার মত সাহস ও ক্ষমতা তার ছিল না, এই কারনেই সে হয়তো শেষপর্যন্ত বিয়েতে পিছু হটেছে। কিন্ত একটু খেয়াল করলেই বুঝা যায় যে এটা খুবই দুর্বল যুক্তি। মেয়েটার দায়িত্ব তানভীর ফাহাদকে নিতে হবে কেন? তারা দুজনেই কি পড়াশোনার পাশাপাশি কোন একটা পার্ট টাইম জব করে নিজেদের এই কঠিন সময়টা পার করতে পারতো না? তাছাড়া এক সময় হয়তো সন্তানদের কথা ভেবে তাদের ফ্যামিলি ঠিকই এই বিয়েটা মেনে নিত। আর তানভীর ফাহাদের পরিবার যে মানসিকতার কারনে বিয়েটা ভেঙ্গে দিয়েছে অর্থাৎ মেয়ের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থান তাদের নিচে, সেটাকে কি আর বলবো ? এক কথায় বলা যায় চরম জঘন্য। এই ধরনের থার্ড ক্লাস মানসিকতার মানুষদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। মেয়েটাকে তিলে তিলে যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য তানভীর ফাহাদেরও উপযুক্ত শাস্তি প্রাপ্য।
এবার Z এর ভাষ্য শোনা যাক। তিনি বলেন-
আমার মতে চাঁদনী আহমেদের মৃত্যুর জন্য দায়ী আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং এই সমাজ ব্যবস্থা সৃষ্ট কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুন। এই নিয়ম কানুনগুলোকে যুগ যুগ ধরে লালন করছি আমরাই কাজেই এই সমাজ ব্যবস্থার পার্ট হিসেবে চাঁদনী আহমদের মৃত্যুর দায় কিছুটা আমাদের সবার উপরই বর্তায়। লক্ষ্য করুন মেয়েটা আত্নহত্যা করেছে তার বিয়ে ভেঙ্গে যাবার পর। প্রথমে বিয়েটা ভেঙ্গেছে পারিবারিক ভাবে তারপর তারা দুজনে মিলে গোপনে বিয়ে করতে চেয়েছিল কিন্ত সেটাও ভেঙ্গেছে ছেলেটির প্রতারণায়। কিন্ত এখন প্রশ্ন হচ্ছে মেয়েটি কেন শুধু বিয়েকেই তার জীবনের আল্টিমেট গোল ভাবছে? এটা কি শুধু একারনেই যে তারা দুজনে স্বেচ্ছায় শারীরিক সম্পর্ক করেছে আর আমাদের সমাজে শারীরিক সম্পর্কের বৈধতার একমাত্র মানদণ্ড শুধু বিয়ে? মেয়েটি ছেলেটির কাছ থেকে প্রতারণার শিকার হয়েছে কিন্ত বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা বা না পাওয়ার কষ্ট তো আমাদের সবারই জীবনে কমবেশি থাকে। মেয়েটাও হয়তো এই প্রতারণা বা না পাওয়ার সব কষ্ট ভুলে নুতুন করে জীবনটা শুরু করতে পারতো, হয়তো দেখতে পারতো নুতুন কোন প্রেমের সোনালী স্বপ্ন কিন্ত সে এটা পারেনি কারন সমাজ তার মধ্যে এই বোধ তৈরী করেছে যে সে অপবিত্র কারন শারীরিক সম্পর্কের পরও তানভীর ফাহাদ তাকে বিয়ে করেনি। এটার প্রমাণ পাওয়া যায় মেয়েটার সুই সাইড নোটে যেখানে সে লিখেছে- “আমাদের সম্পর্ক এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে আমার আর ফেরার কোন উপায় ছিল না”। সিমন দ্য বোভয়ার তার দ্য সেকেন্ড সেক্স বইয়ে লিখেছিলেন- কোন নারীই নারী হয়ে জন্মায় না, সমাজ তাকে নারী হিসেবে গড়ে তোলে। কেন আমাদের সমাজে নারীত্বের প্রধান প্রশ্ন তার পবিত্রতা-অপবিত্রতার প্রশ্ন? কেন শুধু বিয়েকেই নারীর সম্পর্কের পবিত্রতা-অপবিত্রতা যাচাই করবার একমাত্র মানদন্ড হিসেবে দেখা হয়? কেন আমাদের সমাজে একজন নারীর জীবন ও কর্মের যাবতীয় সফলতা যাচাই করা হয় শুধু তার একটা “ভাল বিয়ে” হয়েছে কিনা তা দেখে? যেন “ভাল বিয়ে” না হলে তার জীবনের যাবতীয় সব অর্জন ব্যর্থ। কেন বিয়ে না হওয়া নিয়ে চারপাশ থেকে নানা ধরনের কানাঘুষা শুনতে হয় একটা একা মেয়েকে ? সর্বোপরি বলা যায় যে বিয়েকে ঘিরে তৈরী আমাদের সামজিক প্রপঞ্চ গুলোর কারণে চাঁদনী আহমেদ নিজেকে অপবিত্র বলে মনে করেছে এবং এই অপবিত্রতাবোধ বা হীনমন্যতাবোধ তাকে মৃত্যুর মত চরম সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আমরা সবার বক্তব্য মন দিয়ে শুনি। আমাদের সামনে তিনটা ন্যারেটিভ দাঁড়ায়। এই তিনটা ন্যারেটিভের পক্ষে বা বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতে পারি কিন্ত আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ। পত্রিকায় দেয়া লিংকের সুবাদে এই মুহূর্তে আমাদের চোখের সামনে ল্যাপটপের পর্দায় থাকে জনৈক চাঁদনী আহমদের ফেসবুক টাইমলাইন, সঙ্গে ট্যাগলাইন- রিমেম্বারিং। মানুষ বেঁচে থাকে, তারপর এক সময় মরে যায়। মৃত্যুর পর তার ফেলে যাওয়া হাজারো স্মৃতির মধ্যে একটি হিসেবে টিকে থাকে ফেসবুক টাইমলাইন। আমাদের চোখ পড়ে চাঁদনী আহমেদের শেষ স্ট্যাটাসে। সেখানে লেখা- “যন্ত্রণায় অনেকদিন ঘুমাতে পারিনি। ঘুম পাচ্ছে, শান্তির ঘুম”। পুরো টাইমলাইনের বাকি অংশ জুড়ে বিস্তৃত থাকে শুধু শুন্যতা। মানুষ তো তার বেঁচে থাকার প্রয়োজনে পৃথিবীর সঙ্গে নানা রকম সম্পর্কের শিকড় তৈরী করে। এই সম্পর্কগুলোর সঙ্গে জড়িত হয় এক গুচ্ছ ভালবাসা। সময় যতই এগোয় ভালবাসার আবহে মোড়ানো এই সম্পর্কের শিকড় গুলো প্রবেশ করে গভীর থেকে আরো দূর গভীরে। একজন মানুষ কি ঠিক তখনই আত্নহত্যা করে যখন এই শিকড়গুলো্র সঙ্গে বৃক্ষের মুল অংশের সংযোগ সম্পূর্ণ রুপে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়? এই শিকড় সংযোগহীন অবস্থায় সে কি নিজের প্রতি তীব্র ভালবাসাহীনতায় ভোগে? জগতসংসারের যাবতীয় পূর্ণতার মধ্যে থেকেও কি সে আবিস্কার করে পরম শূন্যতা? এই সব ভাবতে ভাবতে আমরা লক্ষ্য করি যে ফেসবুকের নীল দুনিয়ার নীলচে শুন্যতা এক সময় সংক্রামিত হয় আমাদের সবার মধ্যে। আমাদের ভাবনা থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় পুরুষ নির্যাতনের আইন, বিএমডব্লিউ গাড়ি কিংবা রামজিৎ রাঘব। একটা অসীম অবিন্যস্ত নৈঃশব্দ্যতার মাঝে ডুবে যাই আমরা।
I am learning peacefulness, lying by myself quietly
As the light lies on these white walls, this bed, these hands.
I am nobody; I have nothing to do with explosions.
I have given my name and my day-clothes up to the nurses
And my history to the anesthetist and my body to surgeons
I didn’t want any flowers, I only wanted
To lie with my hands turned up and be utterly empty.
How free it is, you have no idea how free.
-Sylvia Plath (1932-1963)
১৮টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
সবার বক্তব্যই যুক্তিযুক্ত। তবে আমার মতে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাই দায়ী এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য। মেয়েরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারেনা, বেঁচে থাকাটাই তখন নরকযন্ত্রণা হয়ে যায়। ধর্ষক হয়েও যেখানে বিচারের কাঠগড়া থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেখানে বিয়ের নামে এসব সম্পর্ক কিছুই না। অবধারিত ভাবে দোষটা একটা মেয়ের ঘাড়েই বর্তায়। ধন্যবাদ
অপার্থিব
ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। তবে অধিকাংশ মানুষ স্পেশালি আমাদের প্রতিদিনের ফেসবুক কেন্দ্রীক জনমত ওয়াই এর সঙ্গে একমত হবে । ব্যক্তির উপর দায় চাপিয়ে সমাজকে প্রটেক্ট করবে।
ইঞ্জা
আরেকবার পড়তে হবে ভাই, এ বড়ই কঠিন লেখা দিলেন।
অপার্থিব
ওকে, ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
ইঞ্জা
শুভকামনা
রেহানা বীথি
লেখাটাকে ঠিক গল্প বলে মনে হল না। ঘটনা তুলে ধরা এবং কিছু প্রশ্নের অবতারণা। একান্ত অনুভূতিতে দিতে পারতেন।
যাইহোক, প্রশ্নগুলো কালে কালে প্রশ্ন হয়েই রয়ে গেছে, সঠিক সুরাহা হয়নি আজ পর্যন্ত এবং নির্মম সত্যি হল , আমরা যেন নারীর প্রতি আরও বেশি নির্দয় হয়ে পড়ছি দিন দিন।
অপার্থিব
একটা প্লট, কিছু ক্যারেক্টার আর তাদের মধ্যকার সংলাপ, একটা ড্রামাটিক টার্ন এগুলো গল্পের ট্রেডিশনাল ফরম্যাট। সারা বিশ্বেই গল্পের প্রচলিত ফর্ম ভেঙ্গে নুতুন ধারার গল্প লেখা হচ্ছে। গল্পের উপস্থাপন নিয়ে নানা নিরীক্ষা হচ্ছে। আমাদের দেশের নামকরা লেখক শহীদুল জহির, শাহাদুজ্জামানরাও গল্পের প্রচলিত ফরম্যাট ভেঙ্গে নিরীক্ষাধর্মী ধারার গল্প লিখেছেন।
আমি হয়তো খুব একটা ভাল পারিনি কিন্ত উদ্দেশ্য ছিল প্রচলিত ন্যারেশন ষ্টাইল ভেঙ্গে উপস্থাপন করা, একটা ঘটনা তুলে দিয়ে আর ভিন্ন কিছু ন্যারেটিভ দিয়ে পাঠককে ভাবতে দেওয়ার। এটাও কোন নুতুন ষ্টাইল না, বাংলা সাহিত্যে শাহাদুজ্জামানেরর অনেক গল্পই এই ঘরানার। ধন্যবাদ।
এস.জেড বাবু
জটিল ভাবনায় ফেললেন-
ঠিক কি নিয়ে মন্তব্য করবো ঠিক করতে পারছি না-
আসলে এমন লিখায় মন্তব্য লিখাটার মতোই বড় হওয়া উচিত।
যে কোন আত্মহত্যার প্রধান দোষী- “আত্মহত্যাকারী নিজেই”
এবং প্রধান কারণ- ““আত্মবিশ্বাস এর ঘাটতি”
(ব্যাক্তিগত মতামত)
সুবিন্যাস্ত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। দারুন চিন্তাশক্তি আপনার।
মঙ্গল কামনা করছি
অপার্থিব
ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য। আমার কাছে মনে হয় আত্নহত্যার প্রধান কারন পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকালীন সময়ে গড়ে উঠা সম্পর্কগুলোর প্রতি আর কোন টান না থাকা, সেই সঙ্গে নিজের প্রতি ভালবাসার অভাব জনিত এক ধরনের ঘৃণা।
ফয়জুল মহী
চমৎকার লেখা।
আতা স্বপন
কেসগুলো সিক্স আর নাইন দেখার মত। টেবিলে যে দিকে যে বসে সেদিক থেকে বিবেচ্য। কি ভুল বললাম?
অপার্থিব
না ভুল বলেন নাই, সবাই ঠিক। যে যে দৃষ্টিকোন থেকে দেখছে তার কাছেই সেটাই ঠিক মনে হচ্ছে। ধন্যবাদ।
হালিম নজরুল
সমসাময়িক ঘটনা ও কিছু অনুভূতির প্রকাশ।
শুভকামনা রইল।
নীরা সাদীয়া
সত্যিই এ সমাজ, সংসার একজন নারীর জন্য তৈরি করে রেখেছে বিস্তর কঠিন নিয়ম কানুন যা থেকে সে বের হতে পারে না বলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এখানে XYZ প্রায় সকলেই ঠিক। তবে শেষ দুজন বেশি ঠিক বলে মনে হয়েছে আমার।
অপার্থিব
ভাল, অধিকাংশ মানুষের ওয়াই এর সঙ্গে এক মত হবে স্পেশালি আমাদের ফেসবুক কেন্দ্রীক জনমত। উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন কিছু পার্সপেক্টিভ দিয়ে আরো ডিটেইল ভাবে ভাবানো। ধন্যবাদ।
জিসান শা ইকরাম
আমরা ভাবনা Z এর মতই প্রায়।
তবে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে সুন্দর। একজন মানুষ জীবনের মায়ার শক্তির চাইতে হতাশার শক্তি বেশী হলে সে আত্মহত্যা করে।
এরা জীবন থেকে পালিয়ে যায়, চিন্তা ভাবনার বিস্তৃতি ক্ষুদ্র।
একজন মানুষ মরে গেলে আসলেই তার সবকিছুতে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
নিয়মিত লেখুন,
শুভ কামনা।
সাবিনা ইয়াসমিন
এই গল্পে দায়ী কে আর দ্বায় কার এসব প্রসঙ্গে গেলাম না। গল্পটা পড়লাম গল্পের মতো করে, অনলি পাঠক হিসেবে। যেখানে বাস্তব ঘটনার ন্যায়বিচার হয়না, সেখানে এমন গল্প নিয়ে উহু আহা করা যায়, কিন্তু বিচারক বা বিশ্লেষক এর ভূমিকায় নিজেকে বেমানান লাগে।
লকডাউনে এত ব্যস্ততা কিসের? সময় করে ব্লগে আসুন আর নতুন লেখা দিন,
শুভ কামনা 🌹🌹
অপার্থিব
লকডাউনেও হোম অফিস ইদানীং কিছু লিখতে পারি না, বড় লেখক হলে বলতাম রাইটার্স ব্লক। তবু চেষ্টা করছি আসার।