১) মানুষ তার সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ কম দুর্যোগ ফেস করেনি। করোনার সাথে অন্য সব প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট দুর্যোগের একটা পার্থক্য হচ্ছে অন্য দুর্যোগগুলো মোকাবেলার আহ্বান জানানো হয়েছে এক সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে আর করোনা মোকাবেলার আহ্বান জানানো হচ্ছে পরষ্পরের কাছ থেকে সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে। জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক মনস্তত্বে করোনার প্রভাবও হবে অত্যন্ত মারাত্নক। করোনা পরবর্তী পৃথিবীতে মানুষ পরষ্পরের কাছ থেকে আরো বেশি বিচ্ছিন্ন হবে, বাড়বে আত্নকেন্দ্রীকতা, বাড়বে সামাজিক অবিশ্বাস। প্রচলিত নৈতিকতার ধারণাগুলোও প্রশ্ন বিদ্ধ হবে। বিচ্ছিন্নতাবোধের শিক্ষা আর লকডাউনে এক সঙ্গে দীর্ঘ সময় থাকার বিরক্তি মিলিয়ে বাড়বে ডিভোর্সের সংখ্যাও । এর সঙ্গে যোগ করুন-মন্দা কেন্দ্রীক অর্থনৈতিক টানাপোড়ন। জ্ঞানীরা বলেন- দারিদ্র যখন দরজা দিয়ে ঢুকে, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালানোর উপায় খোঁজে। কে জানে হয়তো ডিভোর্সই হবে সেই জানালা! – (করোনা-বিপর্যয় )
২) আমাদের দেশে ফেসবুক জনপ্রিয় হবার অন্যতম প্রধান কারণটি কি জানেন ? ফেসবুক আমাদের ক্লান্ত, যাপিত জীবনের নানা রকম চাপে বিধ্বস্ত, সাধারন মানুষদের ভার্চুয়াল হিরোইজমের স্বাদ দেয়। আপনি বাসায় বউ পিটিয়েও ফেসবুকে ষ্ট্যাটাস দিতে পারেন – অমুক জায়গায় নারী নির্যাতনের বিচার চাই। এছাড়া জীবনের অনেক না পাওয়ার কষ্ট খানিকক্ষণের জন্য ভুলিয়ে দিতে পারে কয়েকটা লাইক-কমেন্ট। – (ভার্চুয়াল হিরোইজম)
৩) বাঙ্গালী মুসলমানের কালচার কেন্দ্রীক দৃষ্টিভঙ্গিতে দুটো ধারা আছে। এক ধারার অনুসারীদের কাছে কালচার বলতে বুঝায় মধ্যযুগীয় আরবীয় কালচার। ইহাই সত্য, ইহাই পরম। ইহা ছাড়া আর কোন গতি নাই আর এক ধারার অনুসারী আছে যারা ধর্ম পালনের প্রক্রিয়াকেই প্রতিনিয়ত চেইঞ্জ হওয়া এই কালচারের সঙ্গে এডজাষ্ট করে তুলছে। সেহরি পার্টি (করোনার কারনে এবার বিলুপ্ত) , টাইট জিন্সের সাথে হিজাব, একমাস রোজা রেখে ঈদের দিনে লালপানি হজম তারই কিছু সাম্প্রতিক উদাহরণ। আপনি যদি হাই প্রোফাইল শপিং মল গুলোতে যান, দেখবেন অনেক হিজাবী মা আর তার জিন্স-টপ পড়া আল্ট্রা মর্ডান মেয়ে একসঙ্গে মনের মাধুরী মিশিয়ে শপিং করছে। পহেলা ফাল্গুনে তো আজকাল ঢাকার রাস্তায় বাসন্তী হিজাবেরও প্রচলন দেখা যায়। কি বলবেন এটাকে? এটাই হছে কালচার আর রিলিজিওনের এক ধরনের কোঅর্ডিনেশন। এই কোঅর্ডিনেশনটা ঘটবে। যারা সভ্যতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চান সেই মধ্যযুগে কিংবা অন্তত পক্ষে সেই স্বপ্নটা দেখেন তাদেরকে কাউন্টার করতে এই কোঅর্ডিনেশনটার দরকার আছে। – (কালচার-রিলিজিওন কোঅর্ডিনেশন)
৪) একবার বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনের জন্য ওয়েট করছিলাম। এক প্রায়-বৃদ্ধ খানিকটা পাগলাটে ভিক্ষুক ষ্টেশনের মেঝেতে বসে বিচিত্র ভঙ্গীতে ভিক্ষা করছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনার নাম কি?
আমি পাগল, আমার কোন নাম নাই, মনে নাই। এরকম একটা উত্তর পাওয়া গেল।
আমিও দমার পাত্র না, জিজ্ঞেস করলাম- বাবার নাম মনে আছে তো?
একদৃষ্টিতে সেই ভিক্ষুক খানিকক্ষণ তাকিয়েছিল, চোখে ভাষায় রাগ ষ্পষ্ট। বিড় বিড় করে বলল- জমিরুদ্দীন।
ভিক্ষুকটি চলে যাবার পর ভাবলাম – যে লোক নিজের নাম বলতে আগ্রহী নয় সে কেন তার বাবার নাম বলেছিল? সে কি আমার প্রশ্নে আহত বোধ করেছিল? বাবার নাম আমাদের সামাজিক অস্তিত্বের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নিজের বাবার নাম বলতে না পারলে এই সমাজে তার নিজের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হয়, এই ভয়েই কি? – ( পিতৃ পরিচয়)
৫) মানুষের জীবনে কখনো কি এমন সময় আসে যখন তার সবকিছুই শুন্য মনে হয়? সম্ভবত জীবন মৃত্যুর সীমানায় দাঁড়ালে এরকম মনে হয়। এর বাইরে আর কোথাও কি? ধরা যাক আপনি একজনকে তীব্রভাবে ভালবাসেন। সব সময় শুধু তার কথাই ভাবেন। ধরা যাক আপনি তার নাম জানেন না। একদিন তাকে তার নাম জিজ্ঞেস করলেন কিন্ত সে বললো না। আপনি দীর্ঘ দিন ধরে, অনেক সময়, প্রযুক্তি আর বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তার নাম-পরিচয় আর যোগাযোগের মাধ্যম (ফোন নম্বর) বের করলেন। যখন তাকে বললেন যে আপনি তাকে ভালবাসেন, সে পরিষ্কার ভাবে বললো যে সে আপনাকে পছন্দ করে না। ফোনের দু প্রান্তে দুটো ভিন্ন ও বিপরীতধর্মী অনুভুতির মানচিত্র হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেন আপনি ও সে। আপনাকে ঘিরে ধরবে জগৎ সংসারের সবচেয়ে গভীর শুন্যতা।
আর্টসেলের গানের ভাষায়-
তোমাকে ঘিরে পথগুলো সব সরে যায়
রাত্রির এই একা ঘর শুন্যের কাঁটাতারে
দুটো মানচিত্র এঁকে দুটো দেশের মাঝে
মিশে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ..
-( বিপরীত মানচিত্র)
৬) নিজের বাবা-মাকে চোখের সামনে একটু একটু করে বৃদ্ধ হতে দেখাটা সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। কয়েকমাস পরপর এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাটা হয়। – (বৃদ্ধত্বের সাক্ষী)
১১টি মন্তব্য
সাবিনা ইয়াসমিন
আপনার ডায়েরির অধ্যায় ১ এর কথাগুলো পড়ছিলাম আর মনে মনে হিসেব করছিলাম। টিভিতে সন্ধ্যার খবরে দেখলাম করোনার প্রভাব কিভাবে সাধারণ সমাজে পড়েছে। শুধু এই মাসেই সাতশো প্লাস পারিবারিক হানাহানির ঘটনা ঘটেছে। এর কারণ দেখানো হয়েছে পরিবারের পুরুষদের কর্মহীন হয়ে যাওয়ায় তারা মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে নাকি এসব করেছে।
প্রভাব পড়েছে মানুষের নৈতিকতার উপরেও। এম্নিতে করোনার ভয়ে অনেকেই বাইরে যাওয়া বন্ধ করেনি, কিন্তু কেউ মারা গেলে তার দাফনকাজ সমপন্ন করার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। মৃতদেহ নিয়ে সন্তান রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, অথচ নিজবাড়ির উঠোনে মরহুমের জায়গা হচ্ছে না।
মাদকাসক্তদের উপদ্রব বেড়ে গেছে কয়েকগুণ, আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীও রেহাই পেলো না। অগ্নিদগ্ধ হয়ে বেচারি মরেই গেলো। করোনার কারণে থেমে নেই ধর্ষণ।
ত্রান-সাহায্য চুরি, ঘর ভাড়া দিতে না পারায় ভাড়াটিয়ার চালের বস্তা হরণ, একেক জনের ঘরে আবিষ্কার হচ্ছে তেলের খনি! দিনদিন অপরাধ যেন বেড়েই যাচ্ছে।
অপার্থিব
সামনে আরো খারাপ সময় আসছে। পারিবারিক নির্যাতন তো এদেশে সব সময় থাকে। এখন বিচ্ছিনতাবোধের শিক্ষা, বেকারত্ব, আর হতাশা মিলিয়ে সেটা ভবিষ্যতে বাড়বে। এর বাইরে বাড়বে চুরি, ছিনতাই, খুন সহ নানা অপরাধ। নৈতিকতাও বিবর্তিত হয়ে সেটা সমাজের চেয়ে আরো বেশি ব্যক্তিক অবস্থান নেবে।
সাবিনা ইয়াসমিন
পোশাক আশাক কে কি পরবে এটা ব্যাক্তির নিজস্ব রুচির উপর নির্ভর করে। কেউ মাথায় বিশাল বড়ো হিজাব পরে, কিন্তু শরীর ঢাকার কাপড় সংকটে ভোগে। আবার কেউ দেড় হাত কাপড়েই নিজেকে ঢেকে নিতে জানে। এখানে কে কিভাবে নিজেকে উপস্থাপন করবেন ব্যাপারটা তার একান্ত।
সোশ্যাল মিডিয়া বা ফেসবুকের যতই বদনাম করি না কেন, ফেসবুক কিন্তু সবারই কমবেশি কাজে আসে। স্ট্যাটাস, লাইভ পার্টি, আন্দোলন,গুজব, আস্তিক নাস্তিক, যত ধরনের চুলকানি সহ সব শেয়ার করা যায়। কেনাকাটাও করা যায়। এবার ঈদ উপলক্ষে অনলাইনে অনেক ডিজাইনের মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে, আপনিও চাইলে নিতে পারবেন 🙂
অপার্থিব
মাস্ক পরলে দম বন্ধ লাগে, মাঝে মধ্যে মনে হয় মাস্ক পরে মরার চেয়ে করোনায় মরা ভাল।
//পোশাক আশাক কে কি পরবে এটা ব্যাক্তির নিজস্ব রুচির উপর নির্ভর করে।//
ব্যক্তির রুচি প্রভাবিত হয় ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি দ্বারা। এর বাইরে আরো অনেক কিছু আছে। অনেকে বিয়ের পর বোরখা-হিজাব পড়া শুরু করে, এক্ষেত্রে তার রুচি প্রভাবিত হয় বিয়ের সুত্রে পাওয়া নুতুন পারিবারিক ক্ষমতা কাঠামোয় নিজের দুর্বল অবস্থান দ্বারা। তার মন বা রুচি সচেতন বা অবচেতনভাবে চায় তার স্বামী বা নুত্নুন পরিবারের কেউ যাতে বোরখা-হিজাব না পরাকে তার খুঁত হিসেবে না দেখে।
সাবিনা ইয়াসমিন
পাগল হোক আর যাইহোক বাপের নাম ভুলে গেলে চলবে না। কারণটা আপনিই লিখে দিয়েছেন।
দিন শেষে মানুষ যখন নিজেকে ফিরে পায় তখন এমন লাগে। ফেলে আসা সময় তাকে একাকী করে দেয়, আগামীর দিকে চাইলে নিজেকে নিঃস্ব মনে হয়। সব সময় না, কিন্তু এক সময় এমন লাগেই।
সবাই বৃদ্ধ হওয়ার সময়সীমা পায়না। কেউ কেউ তার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়। মা বাবার কাছে সন্তান বৃদ্ধ হয়না,, সন্তানের চোখে মা বাবা ছোট হতে পারে না। এগুলো মহান বাণী। বাস্তবতা হলো, সন্তানের চোখের সামনে মা বাবার দেহক্ষয় হতে থাকে। আর এই অনুভব বেদনার, সন্তান সেই অনুভবে নিজের ভবিষ্যৎ রুপ দেখতে পায়।
ফয়জুল মহী
অনুপম, ভালোই হয়েছে।
অপার্থিব
ধন্যবাদ আপনাকে।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
আমি আপনার সাথে একমত পোষণ করছি। ভালো লাগলো আপনার পূঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ধর্মী লেখা। ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। শুভ সকাল
অপার্থিব
আপনাকেও ধন্যবাদ। শুভ রাত্রী।
হালিম নজরুল
অনেকগুলো চমৎকার বিষয় নিয়ে লেখার জন্য আন্তরিক সাধুবাদ জানাই।
অপার্থিব
আপনাকেও ধন্যবাদ।