রেল ষ্টেশন, রেল লাইন আমাকে টানে খুব। থাইল্যান্ডে এক ঝক্‌ঝকে, কোলাহলহীন রেল ষ্টেশন বসে এই টান প্রথম অনুভব করেছিলাম প্রায় এক যুগ পূর্বে। আমাদের দেশের রেল ষ্টেশনে গিয়ে আমার এই আবেগকে খুঁজতে গিয়ে ব্যার্থ হয়েছি। ব্যার্থতার কারণ কোলাহল, হট্টগোল, চিৎকার,চেচামেচি। বিদেশে এসব নেই। নিজের মাঝে মগ্ন হতে পারা যায় পরিচ্ছন্ন,ঝক্‌ঝকে, মানুষ্য সৃষ্ট শব্দ মুক্ত পরিবেশে।
চেষ্টা করি বিদেশে গেলে রেল ষ্টেশনে একবার হলেও যেতে। অস্ট্রেলিয়ায় আমার সাম্প্রতিক স্বল্প দিনের ভ্রমনে কোন ভ্রমন সঙ্গী না থাকায় ইচ্ছে করেই মেলবোর্ন সাউদার্ন ক্রস ষ্টেশন  এর কাছে হোটেল নিয়েছিলাম , মেলবোর্নের দর্শনীয় স্থান সমূহের অবস্থান এই বিশাল ষ্টেশনের কাছেই। প্রথম তিনটি ফটো মেলবোর্নের , পরের গুলো সিডনির একটি ছোট রেল ষ্টেশনের।

ষ্টেশন, প্লাট ফরম, রেল লাইন
কত মানুষ কত বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বা গন্তব্য থেকে এই প্লাটফর্মে এসে জড়ো হয়। বিদায় জানাতে, অভ্যর্থনা জানাতেও আসে অনেকে। কেউ তার প্রিয় মানুষকে হারিয়ে ফেলে, কেউ আবার ফিরে পায়। জীবনের একটি প্লাট ফরম যেন এটি। প্রিয়তমা স্ত্রী/স্বামী সন্তান কে রেখে জীবনের তাগিদে কেউ চলে চলে যান বহু দূরে বা যুদ্ধে। এর মাঝে কেউ ফিরেন আবার কেউ ফিরেন না। প্রাণপ্রিয় ভালোবাসার একান্ত জনকেও অনেক সময় ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিদায় জানায় এই ষ্টেশনে কেউ কেউ। বিভিন্ন লাইনের ট্রেন বিভিন্ন মানুষকে একটি ষ্টেশন থেকে নিয়ে যায় আবার নিয়ে আসে কিছু ট্রেন।

আমি আসলে কে ? কোথা থেকে এসেছি ? এই যে আমাকে সবাই জানে, আসলেই কি আমি সে ? আমার একটি স্বত্বা যাযাবর। ঘুরে বেড়াতে চায় সে, যে কোন বন্ধনহীন বন্ধনে সে আবদ্ধ হতে চায়। জগতের বিপুল সৌন্দর্যের মাঝে ডুবে যেতে চায়, ডুবে থাকতে চায়। নিবির বন, উত্তল সমুদ্র , পাহাড় , ঝর্ণাকে বুকের মাঝে ধারণ করতে চায়। শরীর এবং মনের প্রতিটি কনিকা শুনতে চায় এসবের অজানা কথাকে। গোলাকার পৃথিবীর কেন্দ্র বিন্দুতে গিয়ে পৃথিবীর হৃদয়কে স্পর্শ করতে চায়।
এই চেনা জানা আমিকে তখন অচেনা মনে হয়। আমিই যেন হয়ে যাই রেল লাইন বিছানো মাটি পাথর স্লিপার। আমার উপরে শায়িত দুটো রেল পাত। একটি সবার চেনা জানা এই আমি, অন্যটি অচেনা অজানা এই আমি। সমান্তরাল পাশাপাশি অবস্থান। মিলে এক হতে পারবেনা কোনোদিন।

আমার ভালোবাসা, আমার ক্রোধ , ঘৃণা, আনন্দ,কষ্ট,হতাশা…………
জীবনের প্লাট ফরমে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করি……
এই আমার মাঝেই বহন করি আমি ভালোবাসা,প্রেম,স্নেহ, ক্রোধ,ঘৃনা,আনন্দ,কষ্ট,হতাশা,প্রেরণা, ক্লেদ
আমার শান্তি, আমার অনিদ্রা, ঘুম, নেশা, মায়া
আমার না বলা কথা, প্রকাশিতব্য বা প্রকাশিত কথা
সবগুলোকেই ধারণ করে আছি আমি। যেন আমি নামক ট্রেনের যাত্রী সব।
অপেক্ষা করি সঠিক গন্তব্যের। ইচ্ছে করলেও শুধু সুন্দরকে ধারণ করতে পারিনা।
আবার শুধু অসুন্দরকে ও নয়।
সুন্দর এবং অসুন্দর পাশাপাশি থাকে আমারই মাঝে
সুযোগ এবং উপযুক্ত সময়ে ট্রেন হতে নেমে পরে প্লাট ফরমে, প্রকাশিত হয় দৃশ্যমান হয় সবার কাছে।
রেল লাইনের মত সমান্তরাল সহাবস্থান বলা যায়, একে অন্যের পরিপূরক-

ঝক্‌ঝকে জীবনের প্রত্যাশা আছেই সবার মত আমারো। একটি সুন্দর ট্রেন আসবে,যার নাম জীবন ট্রেন
তার যাত্রী হবো আমি। ট্রেনের সব যাত্রীর গন্তব্য এক।
বহুদূরের সেই গন্তব্যে পাখির কথা মানুষ বুঝবে,
বুঝবে পাহাড়, ঝর্না, নদী, সাগর , ফুলের কথা।
আকাশের তারার সাথে গাল গল্প ,
জোনাকির সাথে আলো ভাগাভাগি, কপালে মুখে জোনাকিরা এসে আলো মেখে দিবে।
আমার এ জীবনের বাইরের সে জীবন, শুধু আনন্দের আলো সে জীবনে।

কেন জানি প্রতিবার রেল লাইন দেখি, দূরে তাকিয়ে থাকি, আর মনের মাঝে এই গান ভেসে আসে।
দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
বন্ধু চিরকাল
রেললাইন বহে সমান্তরাল
বহে সমান্তরাল

পিরিতের ঘর বানাইয়া
অন্তরের ভিতর
দুই দিগন্তে রইলাম দুইজন
সারা জীবন ভর

হইলো না তো সুখের মিলন
হইলো না শুকসারির দর্শন
এমনই কপাল
রেললাইন বহে সমান্তরাল
বহে সমান্তরাল

নয়নের জল শুকাইয়া
বিচ্ছেদের অনল
এই অন্তরে অন্তর জ্বালা
বাড়াইলো কেবল

হইলো না তো মিলন সাধন
চিনলো না মনের বান্ধন
এমনই আড়াল

দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
বন্ধু চিরকাল
রেললাইন বহে সমান্তরাল
বহে সমান্তরাল

কোন দুজন হয়ত কোনোদিন এক হতে পারবেনা, তারপরেও দূরে তাকালে মনে হয় দুটো লাইন এক হয়ে গিয়েছে।
রেল লাইনের উপরে দুজন দুজনের হাত ধরে হেটে যাবে বহুদূর। যতদুর চোখ যায়, তার চেয়েও দূরে।
কেউ কেউ হয়ত ভাববে, এক হতে না পারি, আজীবন পাশাপাশি তো থাকতে পারবো।
.
সতর্কতা
আমি নিশ্চিত আমার এই ছবি দেখে এই ব্লগের অন্তত দুইজন প্রিয় ব্লগার মনে মনে বলবেন ‘ এসব কোন ছবি হইল ?
আমার অকপট স্বীকারোক্তি : ফটোগ্রাফির ছাত্র হবারও যোগ্যতা আমার নেই।
আপনাদের দুজনের উপর মাননীয় স্পিকারের রুলিং হচ্ছে ‘ মনে মনে হাসা নিষেধ ‘
ছবি গুলো এখানে মুখ্য নয়, শুধু দেয়ার জন্য দেয়া।

 

 

৪২৩৭জন ৪২৩৭জন
0 Shares

৩৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ