
২০১৪ সালের শুরুর দিকে হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। অদ্ভুত এক অসুস্থতা। পেটে গোলমাল আর হালকা জ্বর। কোনও ভাবেই ঠিক হচ্ছে না। নানা ব্যস্ততায় রাজশাহী পর্যন্ত যেতে পারছি না ডাক্তার দেখাতে, বড় বোন যেহেতু ডাক্তার, ফোনে ফোনে তার কাছে ওষুধ নিই। কিন্তু পেটের গোলমাল আর ঠিক হয় না। ধীরে ধীরে খাওয়ার রুচি শূণ্যের কোঠায়। শরীর ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়লো। এমন সময় আব্বা এলেন আমার বাড়িতে। অবস্থা দেখে আমার বড় বোনকে জানালেন। বড় বোন আব্বাকে বললো, আমাকে যেন সাথে করে নিয়ে যান রাজশাহীতে। সংসার, নিজের কর্মক্ষেত্র, বাচ্চাদের স্কুল, সব ফেলে চলে গেলাম রাজশাহী। শুরু হল চিকিৎসা। চিকিৎসার প্রথম দিনই ধরা পড়লো গল ব্লাডারে স্টোন, যার কারণে এই অসুস্থতা। অবাক হলাম জেনে। কারণ গল ব্লাডারে স্টোনের যা যা উপসর্গ হয় সবার, আমার সেগুলো কিছুই হয়নি এই পেটে গোলমাল শুরু হওয়ার আগে।
যাইহোক, এরমধ্যেই শরীর ভেঙে পড়েছে একদম। পাঁচটা মিনিটও বসে থাকতে পারি না , খেতেও পারি না কিছুই। শুধু ওষুধ, খাওয়ার স্যালাইন আর ডাবের পানি। ভাত কিংবা শক্ত কোনও খাবার মুখে দেয়ার সাথে সাথে বমি হয়ে যায়। আব্বা-আম্মা আর বড় বোন প্রাণান্তকর চেষ্টা করে চলেছে সর্বক্ষণ, কেমন করে সুস্থ করে তোলা যায় আমাকে। পেটের সমস্যার সাথে যেহেতু জ্বরও আছে, সেগুলো না সারা পর্যন্ত অপারেশন করা যাবে না। এদিকে আমার শরীরও না খেয়ে খেয়ে আরও আরও বেশি দুর্বল। ভেন-এ স্যালাইন আর অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন নিতে নিতে বিরক্ত, কিন্তু পেটের সমস্যা আর জ্বর কোনটাই সারে না।
পেরিয়ে গেল দুটো মাস। ডাক্তাররাও হতাশ। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, যদি অন্তত একটা সপ্তাহ জ্বর না আসে, তাহলে ওই সপ্তাহটা শেষ করেই অপারেশন করে নিতে হবে। পরম করুণাময় সহায় হলেন। জ্বর এলো না পর পর সাতদিন। অপারেশনের প্রস্তুতি শুরু হল। ইসিজি, ডায়াবেটিস টেস্ট, ওজন সবকিছু করে তৈরি হলাম অপারেশনের জন্য। বড় মেয়ের বয়স তখন দশ বছর আর ছোটমেয়ের সাড়ে পাঁচ। এই তিনমাসে ৬০ কেজি থেকে ৪০ কেজিতে ঠেকা ওজন নিয়ে অপারেশন টেবিলে যেতে হবে। বেঁচে ফিরবো তো? মেয়ে দুটোর মুখের দিকে তাকিয়ে অসম্ভব কষ্ট হয়। যদি না ফিরি!
অবশেষে ফিরলাম। ফিরে সুস্থও হলাম। কিন্তু আমার একমাথা ঘনকালো চুলগুলো হারিয়ে ফেললাম। তবুও মনে এতটুকুও আক্ষেপ হল না, মেয়েরা আমার মা হারা তো হয়নি!
একটা যুদ্ধ জয় করলাম যেন। ফিরে এলাম নিজের ভাঙাচোরা বাড়িটিতে, আমার কাছে যা স্বর্গতুল্য।
দুঃসময় এভাবেই হানা দেয়, অতর্কিতে। কষ্ট হয়, হয়তো হারাতেও হয় অনেককিছু, তবু জয় একসময় আসেই। হৃদয়ে বিশ্বাস, করোনা থেকেও জয় আসবে একসময়, আসবেই।
২০টি মন্তব্য
সুপর্ণা ফাল্গুনী
একদম ঠিক বলেছেন আপু। সবকিছু জয় করবোই আমরা। আমরা সবাই কখনো কখনো এমন অনেক যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে পার করে আসছি। ভালো থাকুন সবসময় শুভ কামনা রইলো
রেহানা বীথি
কিছু কষ্টকর সময় জীবনের কোনও না কোনও সময়ে আমরা পার করি সবাই। আপনিও ভালো থাকুন আপু।
ছাইরাছ হেলাল
আপনি তো দেখছি কঠিন যোদ্ধা।
সকালের সূর্য অবশ্যই উঠবে।
রেহানা বীথি
সবাই আমরা যোদ্ধা ভাইয়া। সবার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এমন কোনও যুদ্ধের গল্প।
ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন।
নীরা সাদীয়া
আপনার পোস্ট দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ে গেলো। আমার ঘটনাও লিখব আরেকদিন সময় করে।
রেহানা বীথি
লিখুন আপনার কথা, আপনার যুদ্ধজয়ের গল্প। শুভকামনা রইল।
ফয়জুল মহী
লেখা পড়ে ভালো লেগেছে। মন পুলকিত
রেহানা বীথি
অনেক ধন্যবাদ।
ভালো থাকবেন।
প্রদীপ চক্রবর্তী
জীবন যুদ্ধক্ষেত্র..
সকলকিছুকে জয় করে সামনের দিকে এগিয়ে চলা।
.
শুভকামনা দিদি।
রেহানা বীথি
ভালো থাকুন ভাই।
সুরাইয়া পারভীন
একদম সঠিক বলেছেন আপু
একদিন সকালে শোনা যাবে বিশ্বের আকাশে বাতাসে আর উড়ছে না ভয়ঙ্করী করোনা ভাইরাস।
সেদিন আসবে অবশ্যই আসবে।
মহান রাব্বুল আলামীন আপনাকে দীর্ঘজীবী করুন। আমীন
রেহানা বীথি
এমন সকালের প্রতীক্ষায় আমরা সবাই।
ভালো থাকুন আপু।
সুপায়ন বড়ুয়া
“তবু জয় একসময় আসেই। হৃদয়ে বিশ্বাস, করোনা থেকেও জয় আসবে একসময়, আসবেই।”
ধন্যবাদ আপু।
আপনার মতো আমি ও আশাবাদি মানুষ
করোনা মুক্ত হবেই।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভালো থাকবেন দাদা।
শুভকামনা সবসময়।
তৌহিদ
সন্তানের মুখের দিকে চাইলে নিজের অসুস্থতাকেই অনেক বড় মনে হয় মায়ের কাছে। বেঁচে থাকার আকুতিগুলি চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে। তবু ভালো আপনি পেরেছেন আপু।
এই দুঃসময়ে করোনা থেকেও আমরা সামলে উঠবো নিশ্চই। আল্লাহ সহায়।
ভালো থাকবেন সবসময়।
রেহানা বীথি
নিশ্চয়ই ভাই, মহান আল্লাহ্ আমাদেরকে নিরাশ করবেন না।
ভালো থাকুন আপনিও সবসময়।
জিসান শা ইকরাম
৬০ কেজি থেকে ৪০ কেজিতে নেমে যাওয়া! এই অবস্থায় অপারেশন সফল হওয়া বিশাল ভাগ্যের ব্যাপার।
আল্লাহ রহম করেছেন।
একদিন সকল আঁধার কেটে যাবে।
শুভ কামনা।
রেহানা বীথি
ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল ভাইয়া। বেঁচে আছি, এটাই আশ্চর্যের। পরম করুণাময়ের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই।
ভালো থাকুন ভাইয়া।
হালিম নজরুল
অবশেষে ফিরলাম। ফিরে সুস্থও হলাম। কিন্তু আমার একমাথা ঘনকালো চুলগুলো হারিয়ে ফেললাম। তবুও মনে এতটুকুও আক্ষেপ হল না, মেয়েরা আমার মা হারা তো হয়নি!
—————সবাই সুস্থ্য থাকুক।
রেহানা বীথি
আপনিও সুস্থ থাকুন।
শুভকামনা সবসময়।