মাহবুবুল আলম
মহাধুমধামের সাথে অণিক ও শ্রাবণীর বিয়েটা হয়ে গেল। এদের বিয়েটা ছিল এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। দু’পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতিতেই বিয়েটা হয়েছে। বিয়ের আগে কনেপক্ষ বেশ ক’বার অণিককে দেখলেও অণিকদের পক্ষে শ্রাবণীকে একবারই দেখা হয়েছে। মা-বাবা অণিককে কয়েকবার কনে দেখে আসার কথা বললেও সে প্রতিবারই বলেছে-
: তোমরাইতো দেখেছো। আমার আর দেখার দরকার নেই। তোমাদের পছন্দই আমার পছন্দ।
আজকের এ মোবাইল ফেসবুকের যুগেও বিয়ের আগে অণিক একবারও শ্রাবণীকে ফোন করেনি। ফোন না করলেও ফেসবুকে শ্রাবণী আছে কি তাও জানতে চায়নি সে।
এই যুগে বিয়ে ঠিক হলেই ছেলে ও মেয়েরা একে অপরের সাথে রাত জেগে ফোনে কথা বলে, বা ফেসবুক, ইমু ভাইভারসহ বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে চ্যাটিং করে রাত পার করে দেয়। কিন্তু অণিকের বেলায় বিষয়টি ছিল একেবারে বিপরীত। বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হওয়ার পর একবারের জন্যও অণিক বা শ্রাবণী কেউ কাউকে ফোন করেনি, আর চ্যাটিংতো দূরের কথা। এ ব্যাপারে অণিকের যুক্তি হলো ‘ফুলশয্যা’র আগেই যদি ফুলশয্যার রাতের সব কথা শেষ হয়ে যায়, তা হলে ফুলশয্যার কোন আকর্ষণ বা আবেদনই থাকে না। তাই সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল তার যখন বিয়ে হবে, তখন ফুলশয্যার রাতেই সব কথা হবে। এক রাতে কথা শেষ না হলে প্রয়োজনে দুই রাতে হবে। কোন সমস্যা নেই। এতে তাকে কেউ ব্যাকডেটেড বললে কোন আপত্তি নেই। ফুলশয্যার আগেই সব কথা বলে মধুময় সে রাতটিতে বাসি করে ফেলার কোন মানে হয় না।
অনিক মন ও মননে একজন আধুনিক মানুষ। সে জাবি থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স মাস্টারর্স করার পর দেশেরই একটি রেপুটেড কর্পোরেট হাউসে পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে উচ্চ বেতনে চাকুরী করছে। ফ্রি একোমোডেশন যাতায়তের জন্য ও গাড়ি পেয়েছে। পোশাকে-আসাকে বেশ ট্র্যান্ডি। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে তার প্রতিজ্ঞা হলো, বিয়ে করলে মা-বার পছন্দের পাত্রিকেই বিয়ে করবে, কেননা মা-বাবা ব্যাপারে অণিকের নিরঙ্কুশ বিশ্বাস ও আস্থা আছে। তারা তাদের একমাত্র ছেলেকে এমন জায়গায় বিয়ে দেবেনা যাতে সমাজে হেয় হতে হয়। আর ফুলশয্যার ব্যাপারে অণিকের যুক্তির কথাতো আগেই বলা হয়েছে।
কনের বাবাও দেশের নামকরা ব্যবসায়ী। আর অনিকের সরকারী পদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে একটি মন্ত্রনালয়ের দায়িত্বে আছেন। পারিবারিক ঐতিহ্যেও কেউ কারো থেকে পেছনে নয়। অনিকরা চৌধুরী, আর শ্রাবণীরা ভূঁইয়া, যেমন ‘কেউ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান’ কথাটির মতো। তাই সব বিষয়ে খাপের খাপ মিলে যাওয়াতেই বিয়েটা হয়েছে। বিয়েতে দু’পক্ষই বেশ খুশি। তাই বিয়েতে ছিল ঝমকালোসব আয়োজন।
সন্ধ্যার সাথে সাথে বউ নিয়ে আসা হয়েছে। ইস্কাটনের এক নামী-দামী কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন ছিল। ইস্কাটন থেকে অনিকদের বাসা ধানমন্ডির আঠাশে আসতে যানজটের কারণে পাক্কা দেড়ঘন্টার সময় লেগেছে। স্বাভাবিক যাত্রা হলে কিছুতেই পনের মিনিটের বেশি সময় লাগার কথা নয়।
গাড়িতে আসতে এই দেড়ঘন্টায় অনিক বা শ্রাবণী একটি কথাও বলেনি। তবে শ্রাবণী কাঁদতে কাঁদতে পুরোটা সময় কাটিয়ে দিয়েছে। এই দেড়ঘন্টা সে অনেকটাই বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। আর অণিক গাড়ির ভেতর মোবাইল অফিস বসিয়ে দিয়েছিল।
অনিকদের ২৮/১২৫ বাড়িটি যেন অলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। ঢাকার প্রথমসারির এক ইভেন্টম্যানেজমেন্ট অণিকদের বাড়িটি সাজানোর কাজটি পেয়েছে। সে হিসেবে সৌন্দর্যবর্ধনে কোন ত্রুটি করা হয়নি। মেইন রোড থেকে আভ্যান্তরীণ পুরো রোডটিই আলোকসজ্জায় যেন এক স্বপ্নের ভূবনে রূপান্তরিত হয়েছে।
বধূবরণের পরে। ছোট্র পরিবারের নিস্তব্দ এ বিশাল বাড়িটিতে প্রাণের মিলমেলায় পরিনত হয়েছে। অণিকদের কাছের ও দূরের যত আত্মীয় বিয়েতে এসেছে, এদের অনেকেই থেকে গেছে। পরশু বউভাত শেষ করে তারপর যাবে।
নতুন বউকে দেখেই সবাই খুব খুশি। খুশি অণিক নিজেও। সে মনে মনে মা-বাবার পছন্দের প্রশংসা করে। মা-বাবার কাছ থেকে শ্রাবণীর যে টুক রূপ-সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনেছিল তার সাথে বাস্তবের শাবণীর কোন অমিল নেই। মালা বদলের সময় শ্রাবণীকে যতটুকু দেখেছে তাতেই অনিক ভীষণ সুখি।
এখনো আনন্দ উৎসবের বাড়িটা জেগে আছে। রাত যতই বাড়তে থাকে আয়োজন ততই যেন জমে ওঠতে থাকে। রাত বারটা বেজে গেছে এখনো কারো ঘুমানোর কোন খবর নেই। তবে এখন অতিথিদের ডিনারের কাজ চলছে। উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের খাওয়া দাওয়ার প্রতি তেমন খেয়াল নেই। ঢাকার বুকে এমন খোলামেলা বাড়ি পেয়ে এখানে সেখানে সবাই আসর জমিয়ে বসেছে।
এরই মধ্যে অণিকের কাজিন ও কাজিনের বউরা মিলে ফুলশয্যার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত। যদিও ইভেন্টম্যানেজমেন্টের সাজসজ্জার পরে সাজানোর মতো আর কিছু অবশিষ্ট থাকেনা; তবু যেন ওদের বউ-ঝিদের ব্যস্ততার শেষ নেই। একদিকে হার্ডবিটের গান চলছে, মেয়েরা কেউ কেউ নাচছে, বয়ষ্ক মুরব্বী গোছের যারা ভেতর বাড়িতে খোশগল্পে মসগুল। এ করতে করতেই একটা বেজে যায়। এর পরেই পুরো বাড়িটে কেমন স্তব্দ হয়ে যায়। ডিনার করে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
রাত সোয়া একটার দিকে ভাবীরা এসে অণিককে ডেকে ফুলশয্যার করে নিয়ে যায়। এতক্ষণ অণিক ও শ্রাবণীর সাথে যারা আড্ডা দিয়েছিল একব্ষণে যার যার মতো চলে গেছে। এমুহূর্তে চারিদিকে কেমন সুনসান নিরবতা। একা যেন রঙিন আলোর ঝর্ণাধারায় দাঁড়িয়ে আছে অণিকদের বাড়িটা। অণিক ঘরে ঢুকেই দেখে শ্রাবণী ঘুমিয়ে রয়েছে। ভেতর থেকে দরজা লক করে বিছানার কাছে এসে বেডসাইড ড্রয়ারের ওপরে ঢেকে রাখা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে বিছানায় শুতে আসে। শ্রাবণী এমন ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে যে ইচ্ছা করলেই কেউ যাতে পাশাপাশি বা আড়াআড়ি ভাবে নয় একেবার কোণাকোণি ভাবে শুয়ে আছে। শ্রাবণীকে এ অবস্থায় দেখে অণিকের মনে কেন যেন খটকা লাগে। সে মনে মনে ভাবে শ্রাবণী কী ইচ্ছাকৃতভাবে এমন ভঙ্গিতে শুয়েছে! ইচ্ছা করলেই কেউ যাতে কেউ পাশে এসে শুতে না পারে! তবু ডাকতে যায় না অণিক। সে মনে মনে ভাবে দু’তিন দিন যে দকল গেছে তাই হয়তো পরিশ্রান্ত সে কারণেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
এতক্ষণ খেয়ালই করেনি অনিক তার শোবার ঘরটিকে ইভেনম্যানেজমেন্টের লোকেরা কি ই না নান্দনিক সাজে সাজিয়েছে। কাচা ফুলের গন্ধ আর নতুন বউয়ের পারফিউমনের ঘ্রাণে ঘরের ভেতর অন্যরকম মাদতকতা এনে দিয়েছে। দেখে মনে হয় কল্পনার এক স্বর্গীয় জগত। পুরো বাসর ঘরটিকে আবছা রঙ্গিণ বাতি দিয়ে কেমন রহস্যময় করে তোলা হয়েছে। এ মুহূর্তে অণিক যেন নিজের ঘরটিকেই চিনতে পারছে না। ঘরটির ভেতর আলো-আঁধারীরর একম মায়াময় এ্যাফেক্ট সৃষ্টি হয়েছে।
রিমুট খুঁজে নিয়ে খুব সন্তর্পনে টিভি অন করে অণিক। কিন্তু মনে তার অজানিত অস্থিরতা। তাই কোন চ্যানেলেই মনোসংযোগ করতে না পেরে বিশাল পর্দার টেলিভিশনটাকে অফ করে দিয়ে সোফায় বসে ঘরটাকে আবার খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। অণিক যেমনটি চেয়েছিল তার চেয়েও যেন বেশি সুন্দর করে সাজিয়েছে ওরা।
এ মুহূর্তে অণিকের বার বার হাই ওঠছে। সে ভাবে শ্রাবণী যদি এভাবে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সারারাত পার করে দেয় তা হলেতো এ মধুর ফুলশয্যারই পুরোপুরি বিফলে যাবে। তাছাড়া সকালে ওঠে শ্রাবণী যদি উল্টো অভিযোগ করে আপনি আমাকে একবার ডাকতে পারলেন না? এটি ভেবেই শ্রাবণীর ঠিক মাথার কাছে এসে বসে শ্রাবণীকে ডাকে অণিক।
: শ্রাবণী! এই শ্রাবণী! শ্রাবণী! শেষ ডাকের সাথে সাথে গায়ে একটা মৃদু ধাক্কাও দেয় সে।
তবু শ্রাবণীর কোন জবাব নেই। আবার কয়েকবার ডাকে অণিক-
: শ্রাবণী! এ্যা শ্রাবণী।
তবুও জাগছেনা দেখে অণিকের মনে পড়ে কোন ঘুমন্ত মানুষকে তিনবার ডাকার পরেও যদি সে জেগে না ওঠে তা হলে বুঝতে হবে সে মানুষটি ঘুমিয়ে থাকার ভান করছে। এ কথাটি মনে হতেই অণিক কেমন ম্লান হয়ে যায়। তবু সে আবার ডাকে।
: শ্রাবণী ওঠো! আমি অনেক্ষণ ধরে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। ওঠো।
এ কথার পরই হুরমুড়িয়ে ওঠে শ্রাবণী বলে-
: কে বলেছে আপনাকে অপেক্ষা করার জন্য। কথাটা শুনে অণিকের মনে বেশ ধাক্কা লাগে। তবু মুহূর্তের মধ্যে নিজকে সামলে নিয়ে অণিক বলে-
: দেখ, প্রত্যেক নারী পুরুষের জীবনেই এটি বিশেষ ও অন্যরকম রাত। এ রাতটির জন্য সবাই কতনা অপেক্ষা করে থাকে। আর তুমি বলছো …!
কোন কথা বলেনা শ্রাবণী সে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। অণিকও কিছু না বলে মিনিট কয়েক চুপচাপ বসে থাকে। তারপর আবার বলে-
শ্রাবণী প্লিজ, এদিকে তাকাও। এই নাও, তোমার জন্য নিজে পছন্দ করে ডায়মন্ডের এ আংটিটা এনেছি। হাতটি দাও আমি পরিয়ে দিই।
অণিক হাত ধরে টানতে যায়, কিন্তু শ্রাবণী হেচকা টানে হাতটি ছড়িয়ে নেয়।
অনিক শান্ত অথচ স্থির কন্ঠে বলে-
: তোমার কী হয়েছে বলো, শরীর খারাপ বা অন্য কিছু? তা না হলে হাতটি বাড়াও, আংটিটি পরিয়ে দিই।
: না আমার আংটি লাগবে না। বেশ ঝাঁঝালোভাবে বলে শ্রাবণী।
: তাহলে আমাকে কী তোমার পছন্দ হয়নি? অণিক জানতে চায়।
: না তা নয়। এ বিয়েতে আমার মত ছিল না। শ্রাবণী বলে। কথাটি কেড়ে নিয়ে অণিক বলে-
: তবে বিয়েটা করতে গেলে কেন? হাতেতো বেশ সময় ছিলো। আগে জানিয়ে দিলেইতো পারতে।
: না, বাবা-মা’র মনের দিকে চেয়ে তা করা সম্ভব ছিল না। তাই আপনার সাথে বিয়ের এ নাটকটা করতে হয়েছে।
: নাটক? বিয়েটাকে তুমি নাটক বলছো!
: হ্যা নাটক বলছি এ কারণে যে, লোক দেখানোর জন্য বিয়েটা করতে হয়েছে, এটুকুই। এর বেশি আর কিছু হবে না। আপনি নিশ্চয়ই আমার এ কথা বুঝতে পেরেছেন। প্রশ্ন করার মতো শ্রাবণী বলে।
এ কথার পেছনে অণিক কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মনে মনে কিছু কথা গোছানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোন কথাই সে গুছিয়ে ওঠতে পারছে না। চুপ করে বসে থাকে অণিক।
অণিকের কোন কথা না শোনে শ্রাবণীই আবার বলে।
: দেখুন আমার একটা পাস্ট আছে।
: আধুনিক যুগে কোন ছেলে মেয়ের পাস্ট থাকবেনা তা হতেই পরে না। তা আমার জানার প্রয়োজন নেই। আমরা শুরু করতে চাই, এখন, যাষ্ট এ মুহূর্ত থেকে। বলে অণিক থামে।
: না আমি আপনার সাথে কোন জীবন শুরু করতে চাই না। আমার বয়ফ্রেন্ডকে আমি কথা দিয়েছি। বিয়েটা নামকাওয়াস্তে হতে দাও। এর পরেই আমি চিরদিনের মতো চলে আসবে তোমার কাছে। সে আমায় বিশ্বাস করেছে। কথা শেষ করতে দেয়না অণিক। শ্রাবণীর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বলে-
: আমিওতো তোমাকে বিশ্বাস করে বিয়ে করেছি।
: আপনার বিশ্বাসের চেয়ে ওর বিশ্বাস আমার কাছে অনেক বড়। শ্রাবণীর চটপট জবাব।
শ্রাবণী এ কথা শুনে অণিকের গলাটা যেন কেমন শুকিয়ে যায়। তবু নিজকে সংযত করে বলে-
বিয়েতো ঠিক হয়েছে বিশ দিন হলো। এর মধ্যেতো তুমি আমাকে ফোনেও জানিয়ে দিতে পারতে।
কথাটা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় শ্রাবণী-
আপনিওতো আমাকে একটি কলও করেননি। ভেবেছিলাম আপনি যদি ফোন করেন তা হলে আমার পাস্ট নিয়ে আপনাকে বিস্তারিত বলবো। কিন্তু…!
পাস্ট থাকলেওতা হাজার হাজার ছেলে মেয়েদের বিয়ে হয় তাই না। তা ছাড়া আমিতো বলেছি তোমার পাস্ট নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। তাছাড়া আমারওতো পাস্ট থাকতে পারে তাইনা। পাস্ট নিয়ে ভেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে নষ্ট করে দেয়া উচিত নয়।
এ কথা বলার পরই শ্রাবণীর সাথে কথা বলা সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলে অনিক। সে বিছানা থেকে ওঠে বারেন্দার বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশে পঞ্চমির মরা চাঁদ হয়তো ক্ষানিক পরেই সে ডুবে যাবে। ঢাকায় খুব কমই চাঁদ দেখা যায়। অনেক দিন পরে চাঁদ দেখলো অণিক। ঢাকার আলো ঝলমল মহানগরীতে চাঁদকে তবু বেমানা মনে হয় না। চাঁদ তার নিজের আলোয় স্বগৌরবে তার অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে।
দরজা লাগার আওয়াজে অণিকের ভাবনাটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।
অণিক দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখে ভেতর থেকে দরজাটা লক করে দেয়া হয়েছে।
এতে অণিকের মনটা আরো বেশি খারাপ হয়ে যায়। সে কয়েকবার দরজায় নক করে। কিন্তু শ্রাবণী দরজা খোলে না। বারান্দায় থাইয়ের জানালা পর্দার ফাঁক দিয়ে অণিক দেখে শ্রাবণী আগের মতোই গুটিয়ে শুয়ে আছে। এসি ছাড়ার মতো গরম নেই। তাই ফ্যান চলছে ঘরে। ফ্যানের বাতাসে পর্দা সরে গেলেই বারান্দার গার্ডেন চেয়ারে বসে শ্রাবণীর গতিবিধি লক্ষ করে অণিক। তবে শ্রাবণী যে ঘুমায়নি তা তার নড়াচড়া দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। এ মুহূর্তে অণিকের চোখে যেন রাজ্যের ঘুম এসে জড়ো হয়েছে। তবু অণিক জোর করে জেগে থাকে। এ মুহূর্তের অণিকের ভাবনায় এসে দাঁড়ায় নাসরিন।
নাসরিন অণিকের মামাতো বোন। সে অণিক থেকে চার বছরের ছোট। শৈশবে দুজন এক সাথেই মানুষ হয়েছে। অণিকদের পাশেই ছিল তার নানা বাড়ি। প্রায়ই সে চলে যেত নানা বাড়ি। সে হিসেবে বলা যায় অণিকের শৈশবের বেশির ভাগ সময়ই নানার বাড়িতে কেটেছে । তাই বলতে গেলে পুরো শৈশবটাই নাসরিনের সাথে কেটেছে অণিকের। খেলাধূলা, গোসল, খাওয়া-দাওয়া হতো এক সাথেই। অণিক যা যা করতো, মেয়ে হয়েও নাসরীন তাই অনুস্মরণ বা নকল করতো। দু’জনের সাথে দুজনের ঝগড়াও হতো প্রচুর। আবার সহসাই মিটমাট হয়ে যেত। কিন্তু কৈশোরেই এসেই দুজন অনেকটাই আদালা হয়ে যায়। অণিক চলে আসে ঢাকায় আর নাসরীন ভর্তি হয় মফস্বল শহরের একটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে।
বারান্দায় মাশার কামড়ে বসে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। আবার জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে অণিক। শ্রাবণী তখনও ঘুমায়নি। সে বারে বারে বারান্দার দিকে তাকাচ্ছে। এ বিষয়টি লক্ষ্য করে অণিক দরজায় নক করে। কয়েকবার নক করার পরও দরজায় খোলার লক্ষন না দেখে অণিক আবার গার্ডেন চেয়ারেরই থিতু হবার চেষ্টা করে। আবারও ভাবনায় এসে যায় নাসরীন। তখনও নাসরীনের বিয়ে হয়নি। ইউনির্ভাসিটির এক অবকাশে অণিক কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে আসে। সে সময়ই নাসরিন অণিককে তার ভালোবাসার কথা বলে। একদিন সন্ধ্যায় নানাদের সানবাধানো ঘাটে বসে দু’জন গল্প করছিল। তখনই কথাটা তুলেছিল নাসরিন। হঠাৎ করেই কথার এক ফাঁকে নাসরীন বলেছিল-
: অণিক ভাই আপনি কী আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন কখনো?
: কেন বোঝবনা। দুজন এক সাথে বড় হলাম। কত সুন্দর ছিল আমাদের শৈশবকাল। তুই সবসময় সাথে সাথে থাকতি। খেলাধূলা, গোছল, খাওয়া-দাওয়া, আরও কত কি করতি। আমার সবকিছু নকল করতি। তাই না।
: এর বাইরে আর কিছু নজর পড়েনি তোমার? নাসরিন বলেছিল। উত্তরে অণিক বলেছিল।
: এর বাইরে আর কি? তেমনতো কিছুই মনে পড়ছেনা আমার।
: ঠিক আছে মনে না পড়লে নাই। অভিমানের মতো করে বলেছিল নাসরিন।
: না না ঠিক আছে তুই বল। আমারতো তেমন কিছুই মনে পড়ছে না। প্লিজ বল। অভিমান করিস না।
অণিকের এই কথায় নাসরিনের বরফ গলে যেন। নিজকে একটু সামলিয়ে নিয়ে সে বলেছিল-
: শৈশব পেরিয়ে কেশোরে পা রাখতেই টের পাই, তোমাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করেছি। কিন্তু লজ্জায় মুখফুটে তোমাকে কিছুই বলতে পারিনি। মনের গোপন কথা গোপনই রয়ে যায়। তাই আজ সব লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলছি, আমি তোমকে ভীষণ ভালোবাসি অণিক দা।
নাসরিনের এ কথা শুনে সহসাই কিছু বলতে পারেনি অণিক। তারপর একটু গুছিয়ে নিয়ে বলে-
: দেখ নাসরিন, আমরা মামাতো ফুফাতো ভাইবোন এর চেয়ে বড় সম্পর্ক আর কিছু হতে পারে না। আর এর বাইরে আমরা নতুন কোনো সম্পর্কে জড়াই তা আমি চাই না। মাথা থেকে প্রেমের ভূত নামা।
এ কথার পর নাসরিন সেই যে অনিকের সামনে থেকে চলেগিয়েছিল, এরপর যতদিন অণিক নানার বাড়িতে ছিল, নাসরিন আর অণিকের সাথে কথাতো দূরে থাক দেখাও করেনি। অণিককে এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছে।
এরই মধ্যে নাসরিনের বিয়ে হয়ে যায়। সে চলে বরের সাথে রাজশাহী । অণিকও রাগ করে নাসরিনের সাথে আর যোগাযোগ রাখেনি। তবে বছর খানেক আগে নানার মৃত্যুতে সবাই কুমিল্লা এসেছিল। নানার অনুষ্ঠানাদি শেষ করে ফেরার সময় নাসরিন অনিকদের বাসায় যাত্রা বিরতি করেছিল। সেই রাতে অণিকদের বাগানে দুজনের অনেক তা হয়েছিল। একসময় নাসরীণ না পাবার কষ্টের কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল নাসরীন। যাবার সময় শুধু একটি কথাই বলে গিয়েছিল। তুমি আমাকে যেভাবে ফিরিয়ে দিয়েছো, তুমিও কোন দিন সুখি হবে না মনে রেখ।
নাসরীনের সে দিনের সে কথাটাতে এ মুহূর্তে অভিশাপ হিসেবে দেখছে অণিক। তা না হলে কেন, আজকের এমন রাতে তাকে ঘরের বাইরে থাকতে হচ্ছে। এমন ভাবনার মাঝেই হঠাৎই বারেন্দার দরজা খুলে যায়। শ্রfবণী মুচকী হেসে অনিককে বলে-
: বেশ শাস্তি হয়েছে, এবার ঘরে এসো।
অণিক আশ্চর্য হয়ে বলে-
: শাস্তি মানে?
: এসো ঘরে এসো। শাস্তির কথা পরে বলছি।
তবু অণিক ওঠেনা। অনেকটা কপট রাগ করে সে বসে থাকে। শ্রাবণী হাত ধরে বলে- এসো ভেতরে এসো। আর রাগ করতে হবে না। তাছাড়া তোমার প্রতি আমারওতো রাগ থাকতে পারে। তাই না?
: আমার প্রতি তোমার কি রাগ! আমিতো তোমার সাথে এমন কিছু করিনি যাতে তোমার রাগ হবে।
: সে কথাইতো বলছি, এসো ভেতরে। তোমার রাগ আমি… আর কথা না বাড়িয়ে অণিককে অনেকটা জোর করেই ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে বিছানায় বসায় শ্রাবণী। তার পর চাপাহাসি হেসে বলে-
: আজ কয়েকদিন ধরেই এমন একটা প্লেন করেছি আমি যে, ফুলশয্যার রাতে তোমকে আচ্ছামতো একটা শস্তি দেব।
: কেন আমি কি করেছি যে আমায় শাস্তি দেবে! অণিক বলে।
: কেন শাস্তি দেবো না! আজ এতোদিন হলো আমাদের বিয়ের কথা পাকা হয়েছে, অথচ তুমি কেমন পুরুষ মানুষ, একবারও আমার সাথে দেখা করা দূরে থাক একটা ফোন পর্যন্ত করলে না। এমন বেরসিক মানুষ আজকের যুগে হয়? আমি প্রতিদিন কত যে তোমার একটি ফোনকলের অপেক্ষায় থেকেছি।
: ও সে কথা। তাহলে তুমি ফোন করনি কেন? তুমিওতো একটা ফোন করতে পারতে!
: দেখ কী হাদারামের মতো কথা বলে। মেয়েরা কি আগ বাড়িয়ে সব করতে পারে। এক্কেবারে বুদ্দু! শ্রাবণী একটু এগিয়ে অণিকের নাক টেনে দেয়। শ্রাবণী হেসে গড়িয়ে পড়ে অণিকের ওপর। অণিক বলে-
: তাই বোঝি এমন দিনে এমন শাস্তি! তবে তুমি যে বললে তোমার পাস্ট আছে, একজনকে ভীষণ ভালোবাসো?
: এসবই তোমাকে ভড়কে দিয়ে সব কিছু বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য। চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলে শ্রাবণী।
: এবার বলো আমি কেমন?
: তুমি খুব সুন্দর।
এতক্ষণতো মনে মনে হয়তো আমাকে অনেক গালাগাল করেছো তাই না। শ্রাবণী বলে।
: না গালাগালি করবো কেন, তবে খুব খুউব রাগ হয়েছে।
আমি কিন্তু ঘরের ভেতরে বসে বিষয়টা খুব এনজয় করেছি। শ্রাবণীর নিঃশব্দ হাসি।
: আমিও জানালার ফাঁক দিয়ে তোমার এসব কান্ডকারখানা দেখেছি। হাসে শ্রাবণী।
: তুমি হাসছো। আর আমার অবস্থা দেখ মশায় কামড়িয়ে কি অবস্থা করেছে। অণিক বেডসাই সুইচ টিপে আলো জ্বালায়।
: এই দেখ। মশা কি অবস্থা করেছে। অনিক ঘাড়, মুখ, পায়ের পাতার ও হাতের বিভিন্ন অংশ দেখায়। অণিকের এ অসহায় বর্ণনা শুনে শ্রাবণী আবার নিঃশব্দ হেসে বলে-
: স্যরিগো সোনা, আমি ভাবিনি এমনি হবে। বলেই দু’হাত জোড় করে অণিকের কাছে ক্ষমা চায়।
: যাক ঘটনা ঘটিয়ে এখন আর স্যরি বলতে হবে না। অণিক অভিমানের মতো করে বলে।
অণিক শ্রাবণীর এ ছেলে মানুসি দেখে ভেতরে ভেতরে হাসে। তারপর নিজকে সামলে নিয়ে বলে-
: আমিতো বসে বসে ভাবছিলাম আমার জীবটাই বোঝি নষ্ট হয়ে গেল। বলেই অণিক বেটসাইড সুইচ অপ করে। হালকা রঙিন আলোয় ঘরটা আবার রহস্যময় হয়ে ওঠে। শ্রাবণী আরও ঘণ হয়ে অণিকের কাছে বসে বলে-
অনিক যেন তখনও স্বাভাবিক হতে পারছে না। সে কিছুটা অন্যমনস্কতায় ডুবে থাকে। শ্রাবণী মুহূর্তেই অণিকের মনের অবস্থা পড়ে নিয়ে বলে-
: স্যরি স্যরি। অনেক হয়েছে। আর গাল ফুলিয়ে থাকতে হবেনা। দাও। এবার তোমার আংটিটা পড়িয়ে দাও। অণিকের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় শ্রাবণী।
…………….
১৪টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
খুব বেশি সাদামাটা মনে হচ্ছে!!
আপনার কাছে প্রত্যাশা অনেক।
মাহবুবুল আলম
এ গল্পটি সাদামাটাই। সবশ্রেণীর পাঠকের কথা মথায় রেখেই লিখা। ধন্যবাদ!
শিরিন হক
ভাই আপনার যতোগুলো পোস্ট পড়েছি সেগুলো ছিলো অন্যরকম এই পোষ্টের থেকে।অনিকের বাসর রাত ভেবেছিলাম মাটি হয়ে গেলো পুরোটা পড়ে বুঝতে পারলাম আপনিও গল্পো কম জানেন না। এখানেও দক্ষতা দেখালেন।শ্রবনীর বুদ্ধি টা ভালোই ছিলো পড়ে মজা পাইলাম।
শুভকামনা রইলো।
মাহবুবুল আলম
শিরিন হক! গল্পটি আপনার ভাল লেগেছে জেনে, আমারও ভাল লাগলো। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
জিসান শা ইকরাম
আমিও এই মুহূর্তে মশার কামড় খেতে খেতে আপনার লেখা পড়ে শেষ করে মন্তব্য লিখছি 🙂
বিয়ের আগে ছেলেরা আজকাল ভাইবার, ইমো, হোয়াটস এপ ইউজ করেনা এটি বিরল ঘটনা। তবে অসম্ভব নয়।
গল্পের মাঝা মাঝি এসে শ্রাবণীর কথাবার্তা শুনে তো ভেবেছিলাম, অনিকের জীবনটা কাকের মত শুস্কই থেকে যাবে।
বাসর রাতেই কি অবস্থা, বউর আদরের পরিবর্তে মশার কামড়! আহারে।
শেষে এমন চমক থাকবে ভাবতেই পারিনি।
শ্রাবণীর চমৎকার কথা বার্তা বেশ উপভোগ্য ছিল।
গল্পের কাহিনী দৌড়েছে দ্রুত গতিতে,
একবারেই পড়ে ফেলেছি।
কঠিন লেখার মাঝে এমন গল্প চাই আপনার কাছে আরো।
শুভ কামনা ভাই।
মাহবুবুল আলম
জিসান ভাই! মশার কামড় খেয়ে গল্প গল্পটি পড়ে শেষ করার জন্য আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ পাঠকই হালকাচালের গল্প ভালোবাসে। বেশি জটিল ঘুরোনো প্যাচানো গল্প তাদের পছন্দ নয়। হুমায়ুন আহমদও সাধারণ পাঠকদের কথা মাথায় রেখে গল্প লিখে জনপ্রিয় হয়েছেন। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ!
শাহরিন
শুরুতে মনে হচ্ছিলো অনেক পরিচিত গল্প। বইয়ে নাটক বা সিনেমাতে অনেক দেখেছি। তবে শেষের টুকু ভালো লেগেছে।
মাহবুবুল আলম
ধন্যবাদ আপনাকে!
রেহানা বীথি
যাক, শেষ ভালো যার তার সব ভালো।
ভালো লিখেছেন।
মাহবুবুল আলম
অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শুভ কামনা!
রাফি আরাফাত
শুরুটা স্বাভাবিক হলেও শেষটা অনবদ্য ছিলো। অসাধারণ ভাই। ধন্যবাদ
মাহবুবুল আলম
শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ!
সাবিনা ইয়াসমিন
ফুলশয্যার রাত প্রতিটি মানুষের জীবনেই বিভিন্ন কারনে স্বরনীয় হয়ে থাকে। অম্ল-মধুর ঘটনায় অনিক আর শ্রাবনীর প্রথমরাতও স্বরনীয় হয়ে গেলো।
গল্প লেখা শিখতে হবে আপনার কাছ থেকে। আরও লিখুন। শুভ কামনা 🌹🌹
মাহবুবুল আলম
“গল্প লেখা শিখতে হবে আপনার কাছ থেকে” কী যে বলেন! তবু খুশি হলাম। শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ!