পঞ্চকবির একজন, রজনীকান্ত সেন

আরজু মুক্তা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, রবিবার, ১২:৫৫:২৯পূর্বাহ্ন খ্যাতনামা ব্যক্তি ৪৫ মন্তব্য

আধুনিক বাংলাগানের ইতিহাসে পঞ্চগীতি কবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন। তিনি সঙ্গীত জগতের একজন দিকপাল।

দূর থেকে যখন, ” মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই/ দীন দুঃখিনী মা যে তোদের,  তার বেশি আর সাধ্য নাই।” এই গানটি যখন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে হৃদয়ে দোলা জাগিয়ে চোখের জল হয়ে চিকচিক করে; তখন বুঝে যাই, সেই শিল্পীই হচ্ছেন রজনীকান্ত সেন। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীর এই মাসে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তিনি ১৮৮৫ সালের ২৬ জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলার ভাঙ্গাবাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গুরুচ প্রসাদ সেন। তিনি সেকালের সঙ্গীতজ্ঞ গুণী ব্যক্তিত্ব এবং বরিশালের নামকরা সাবজজ ছিলেন। মায়ের নাম ছিলো, মোহিন দেবি। তিনি বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন। ছোটবেলায় বেশ ডানপিটে স্বভাবের ছিলেন। আবার অসম্ভব মেধাবীও ছিলেন।

রজনীকান্ত কুচবিহার জেলার জেনকিন্স স্কুল থেকে ১৮৮৩ সালে এন্ট্রান্স,  ১৮৮৫ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ, এ; ১৮৮৯ সালে কোলকাতার সিটি কলেজ থেকে বিএ, এবং ১৮৯৭ সালে বি, এল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে রাজশাহী কোর্টে ওকালতি শুরু করেন।

তাঁর গানচর্চা শুরু হয় পিতার কাছ থেকে, এবং ১৫ বছর বয়সে ” কালী সঙ্গীত “রচনা করে কবিত্ব শক্তির পরিচয় দেন। তাঁর কবিতা ও গানের বিষয়বস্তু প্রধানত: ভক্তি ও দেশপ্রেম। তাঁর ভক্তি সঙ্গীতগুলো ” কান্ত পদাবলী ” নামে পরিচিত।  তাঁর প্রথম কাব্য ” গীতিবাণী” প্রকাশিত হয় ১৯০২ সালে। তাঁর কল্যাণী  (১৯০৫), অভয়া ( ১৯১০), অমৃতনীতি কবিতা (১৯১০), আনন্দময়ী ১৯১০), বিশ্রাম (১৯১০), সদ্ভাবকুসুম (১৯১৩), শেষদান (১৯১৬), সালে প্রকাশিত হয়।

রাজশাহীতে থাকাকালীন দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও “ভারতবর্ষ” পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্টতা হয়।

রজনীকান্ত সেন স্বদেশী গান, ভক্তিমূলক গান, ও হাসির গান লিখেছেন অসংখ্য। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রার্থনামূলক একটি বিখ্যাত গান হলো :

তুমি নির্মল করো মঙ্গল করো

মলিনমন মুছায়ে

তব, পূর্ণ কিরণ দিয়ে যাক

মোর মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”

তাঁর হাসির গানগুলিও চমৎকার ও অসাধারণ। যেমন :

” বাজার হুদ্দা কিন্যা আইন্যা চাইলা দিছি পায়

তোমার লগে কেমনে পারচম, হৈয়া উঠিছে দায়

আরসি দিচি, কাহই দিচি

গাও মাজনের ছাপান দিচি

আর কি দ্যাওন যায়? ”

আর ছোটবেলার সেই কবিতা!  আমার তো মনে হয় সকলের মনে আছে।

” বাবুই পাখিরে ডাকিয়া বলিছে চড়াই

কুঁড়ে ঘরে থেকে করো শিল্পের বড়াই।”

অথবা,

“নদী কভু নাহি করে নিজ জল পান

তরুগণ নাহি খায় নিজ নিজ ফল। ”

আবার স্বদেশী গান যেমন :

” নমো নমো জননী বঙ্গ

উত্তর ঐ অভ্রভেদী

অতুল বিপুল গিরি অরণ্য

দক্ষিণে সুবিশাল জলধি

চুম্মে চরণতল নিরবধি

মধ্যে পূত জান্হবীজন

ধৌত শ্যাম ক্ষেত্র সঙ্ঘ।”

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় তাঁর ” মায়ের দেয়া মোটা কাপড় ” গানটির মাধ্যমে বোঝা যায়, তিনি কতোটা উদ্দীপিত হয়েছিলেন।

তাঁর রচিত প্রেম ও প্রকৃতি বিষয়ক গানের সংখ্যাও কম নয়। তাঁর গান বাংলা মৌলিক সাঙ্গীতিক উপাদানে সমৃদ্ধ। কীর্তন,  বাউল, রামপ্রসাদী, পাঁচমিশালি ইত্যাদি গানের সুর ও ভাবের প্রভাব তাঁর গানে লক্ষণীয়। সঙ্গীতের বিবিধ কারুকাজ তাঁর গানে না থাকলেও ; গানের সহজ সরল ভাবপূর্ণ কথার সঙ্গে নাড়িরটান যুক্ত এবং সুরের আবেদন শ্রোতাকে সহজেই আকর্ষণ করে। তাঁর মোট গানের সংখ্যা ২৯০ টি।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীত বিভাগের পাঠ্যসূচীতে ” কান্তগীত ” অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আমাদের দেশেও তাঁর গান বিশেষভাবে পরিচিত ও জনপ্রিয়।

সংগীতপ্রাণ রজনীকান্ত যখন গৌরবের শিখরে, তখন তাঁর শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি ক্যান্সার। রোগ শয্যায় থেকেও তিনি বহু গীতি কবিতা লিখেছেন। প্রায় দুই বছর কঠিন রোগ ভোগের পর ১৯১০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ” গানের রাজা ” রজনীকান্ত সেন মারা যান।

বাংলা গীতি কাব্যের প্রবাদ প্রতীম প্রখ্যাত পঞ্চকবির অন্যতম রজনীকান্ত সেন বাঙ্গালি সংগীত সাধনার এক মাইল ফলক। তাঁকে জানাই হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে গভীর শ্রদ্ধা।

 

তথ্যসুত্র : কবি আসাদ চৌধুরী রচিত জীবনীগ্রন্থ ” রজনীকান্ত সেন”।

১৩৩১জন ১০১৫জন
0 Shares

৪৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ