মিনহাজের সাথে সংসার ভেঙে যাওয়ার পর মানসিকভাবে নিজেও ভেঙে গিয়েছিলাম। পারিবারিক , সামাজিক নানান অসুবিধার সাথে নিরাপত্তাহীনতাও ছিলো।ডিভোর্সের পর ছেলে-মেয়েকে নিয়ে,বারো বছরের সংসার ছেড়ে ভাইয়ের সংসারে এসে জুটেছিলাম । প্রথম প্রথম কেউ কিছু বলতো না কিন্তু কাজে-কর্মে বুঝাতো।বছর ঘুরতেই যা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো।
.
বিয়ের পর মিনহাজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েও গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলাম।অনেকটা জেদ করেই।চাকুরিও করতে চেয়েছিলাম , অনুমতি পাইনি। মিনহাজের সাথে চিন্তা- ভাবনায় বিস্তর ফারাক ছিলো। সংস্কৃতিমনা ছিলাম । কিন্তু সে ছিলো উল্টো।মৌলবাদী ধ্যান-ধারণার।একবার মেয়েকে নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম।ওকে না বলেই। বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো সেবার। ওর সবচে’বড় সমস্যা , ওথেলো সিন্ড্রোমে আক্রান্ত ছিলো।সন্দেহ করতো প্রচুর। অকারণ সন্দেহ। তবুও কাটিয়েছি বারো বছর।
.
এখন মনে হয় আরও আগেই সেই সংসার ছেড়ে চলে আসা উচিত ছিলো। গত পনেরো বছর তো একাই কাটাচ্ছি, কেটে যাচ্ছে জীবন।
আমি রোকেয়া খানম ।শিক্ষকতা করি। বেসরকারী একটা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করে , ছাত্র পড়িয়ে যা পাচ্ছি তা দিয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশুনার খরচ আর সংসার চলছে।তাছাড়া বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া নিজের অংশের টাকাটা ব্যাংকে রেখেছিলাম। ওখান থেকে যা আসে তাতেও সাহায্য হয় ।ছেলে-মেয়েেক প্রাচুর্য দিতে পারিনি। কিন্তু মানবিক মানুষ করে গড়ে তুলতে পেরেছি।
মেয়েটা এ বছর ম্যাজিস্ট্রেট হলো। ছেলেটা অনার্স তৃতীয় বর্ষে । মেধাবী হওয়ায় নিজেও টিউশনি করে পড়াশুনার খরচ যুগিয়েছে মেয়ে।
.
যা বলছিলাম। ডিভোর্সের পর আশেপাশের লোকজন আর আত্মীয়দের কাছে হয়ে উঠেছিলাম চোখের বালি। ছেলে-মেয়েকে অনেকটা একঘরে করেই মানুষ করেছি।কেননা আত্মীয়রা নানান কথা জিজ্ঞেস করতো -শুনাতো।ওদের বাবা আরেকটা বিয়ে করেছে এসব সংবাদ ওদের কানে দিয়ে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলতো। আর আমাকে তো শুনতেই হতো নানান অপবাদ।মেয়েদের এতো দেমাগ ভালো না , অনেক বেড়ে গেছি এসব।
সংগ্রাম করেছি, খেয়ে-না খেয়ে সংসার চালিয়েছি।কাউকে তবু বিরক্ত করিনি।হাত পাতি নি । করুণার জীবন চাইনি কখনও ।মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছি। আজ , এতো বছর পরে এসে কেবল এটুকুই মনে হচ্ছে ,হেরে যাই নি।
নারী যদি প্রকৃতি হয় তবে প্রকৃতি তো হারে না। বরং আশ্রয়স্থল হয়ে উঠে বিপন্ন প্রাণের।
১০টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
আমাদের সমাজকে আমরা যতোই বলি উন্নত হয়েছে, আসলে মন-মানসিকতার উন্নতি হয়নি আজও। তাই সে যে দেশেই থাকুক না কেন বাঙালীরা, কোনো নারী যদি ডিভোর্স দেয় তাকে নিয়ে এতো মসলাদার গল্প তৈরী হয়। যা আমি নিজের চোখে দেখেছি। নারী হলো ধৈর্যের প্রতীক। কি হয় একটু মানিয়ে নিলে? এমনও দেখেছি ডিভোর্স দিয়ে যদি সেই নারী নতূন করে সংসার সাজায় তাকেও ছাড়েনা। এখানে এমন নারীও আছে যারা মার খেয়েও স্বামীর ঘরে পড়ে আছে। আমি সেইসব নারীদের ঘৃণা করি। নিজেদের আত্মসম্মানবোধ যে বিসর্জন দিতে পারে, সে তো মানুষ নামেরই কলঙ্ক।
ভালো লিখেছেন আপনি।
মৌনতা রিতু
এইসব সেনসেঠিভ বিষয়ে আসলে কি বলব বুঝি না। তবে এত সংগ্রাম করে যখন কোনো মানুষ তার সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করতে পারে তখন সে স্বার্থক মা।
সে পেরেছে। তবে এইটুকু কি সবাই পারে ?
অনেক সাহস ও ধৈর্য কি সবার থাকে ?
সমাজটা যে বড়ই অদ্ভুদ !
আমি চাই প্রতিটা সন্তান বেড়ে উঠুক মায়ার বন্ধনে। এটা ভালবাসার বন্ধনে।
ইঞ্জা
একদম ঠিম বলেছেন, নারীরা প্রকৃতির মতোই, কিন্তু আমরা বিশেষ করে এই উপমহাদেশের পুরুষ জাতিরা এখনো নারীদের সম্মান করতে শিখিনি, আমরা পুরুষের চাইতে যেন নিজেদের পশু হিসাবে জাহির করতে ভালোবাসি, জানিনা আমরা কবে আমাদের পশুত্ব ছুড়ে ফেলে মানুষ হবো। 🙁
অপার্থিব
জীবন সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হতে পারে আবার অনেক সময় এমন হয় যে দুজন সঠিক মানুষ মিলেও একটা সঠিক সম্পর্ক গড়ে উঠে না। কাজেই ডিভোর্স হতেই পারে। সমস্যা হল পুরুষতান্ত্রীক সমাজে ডিভোর্সের দায়ে সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় নারীকে, ডিভোর্সের জন্য প্রকারন্তরে তাকেই দায়ী করা হয় , সমাজের পদে পদে তাকে নানা ভাবে অপদস্থ হতে হয়। একারনেই দেখা যায় সামাজিক অপমান ও গঞ্জনার ভয়ে অনেক নারী নীরবে স্বামীর নানা অত্যাচার অপমান সহ্য করে যায়। নারী যখন অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হবে তখন সে সমাজের এই সব রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহনের মনস্তাত্বিক দক্ষতা অর্জন করবে যেমনটা করেছে এই গল্পের নারী চরিত্রটি।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
কিছু মেয়ে আছে এমনি শত কষ্ট হলেও হাল ছাড়েন না।আপনার গল্পের নায়িকা তেমনি একজন সংগ্রামী নারী।খুব ভাল লাগল এমন গল্প সাধারনত কম লেখা হয়।
মিষ্টি জিন
সন্দেহ বাতিক খুব খারাপ এবং এটা একটা মানুষিক রোগ। শুধু এই একটা কারনে হাজার হাজার সংসার ভেংগে যাচ্ছে।
রোকেয়া খানম যা পেরেছে সবাই তা পারেনা।সাহসের অভাবে অনেকে মুখ বুজে অত্যাচার সহ্য করে।
ভাল লেগেছে গল্প।
মারজানা ফেরদৌস রুবা
বেশিরভাগ নারীরই ডিভোর্সের পরের গল্প অনেক সংগ্রামের। তবে আমি আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন সেই সকল নারীদের শ্রদ্ধা করি।
হ্যাঁ, ওথেলো সিন্ড্রোমে আক্রান্ত (সন্দেহ প্রবণতা) সঙ্গীর সাথে দীর্ঘকাল বসবাস খুবই কঠিন। এক সময় তা অনিরাপদও হয়ে উঠে। মাঝেমধ্যে দাম্পত্য খুন-খারাবি কিন্তু এসব কারণেও ঘটে।
অনিকেত নন্দিনী
আমি মনে করি ওথেলো সিনড্রমে আক্রান্ত বরের সংখ্যাই বেশি। “চাকরির কী দরকার? আমি কি কম কামাই করি?” এমন কথা বলা বরের সংখ্যাও নেহাত কমনা।
আনুষ্ঠানিকভাবে ছাড়াছাড়ি হোক বা অনানুষ্ঠানিক ভাবে, অধিকাংশ সময়েই দোষ বর্তায় নারীর উপর। বাচ্চাদের দায়িত্বও মায়ের উপরেই চাপিয়ে দিয়ে বাবারা থাকে হাত পা ঝাড়া।
এই গল্পের রোকেয়া আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন নারী বলেই আত্মীয় ও সমাজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পেরেছেন যা কিনা সবাই পারেনা। তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।
আবু খায়ের আনিছ
কি বলব, সব বলে দিয়েছেন উপরে সবাই।
ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করেছে এটাই হচ্ছে স্বামীর প্রতি তার চরম একটা শিক্ষা, প্রতিশোধও বলা যায়। দেখিয়ে দেওয়া প্রয়োজন এমন মানুষদের কে। ভালো লাগল গল্প।
ব্লগার সজীব
মৌলবাদী না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পাশ করনে ওয়ালারাও প্রায় একই, এক একজন মিনহাজ। নারী পুরুষ তা যে শ্রেনীরই হোক, একই চিন্তার ধারক বাহক এরা।
সমাজে রোকেয়ার মত মানুষ খুব কম। রোকেয়ারা যেন এমন স্ট্রং হতে পারেন।