হাড়ির জল-ভাতটুকু মরিচ-পেঁয়াজ- নুনে মেখে ছেলে-মেয়ের পাতে তুলে দিয়ে জমিলা মুখে পান গুঁজলো।তিনটা বাসায় ছুটা বুয়ার কাজ ,একটা ছাত্র মেসে রান্না করা জমিলার প্রতিদিনের রুটিন।আটটা থেকে তিনটা।ফিরতে ফিরতে বেলা হেলতে শুরু করে পশ্চিমে। ঘরে এসে চাল-ডাল ফুটাতেই বিকেল গড়িয়ে যায়। এতো বেলা পর্যন্ত সন্তানেরা না খেয়ে থাকবে মা হয়ে তা জমিলার সহ্য হয় না।তাই রাতের ভাতে জল ঢেলে রাখে। নিজে উপোস করে প্রায়শই। ঘুম থেকে উঠেই যে বাসায় কাজে যায় তারা দুটো রুটি দেয়। কখনও সাথে কিছু থাকে কখনও থাকেনা।তা দিয়েই নাস্তা সারে।
সবশেষ যে বাসায় ঢুকে সেই বাসার গৃহকর্ত্রী দুপুরের খাবার খাওয়াবে , বিনিময়ে বেতন কম দেয় তিনশো টাকা।জমিলা সেই খাদ্য আঁচলের তলায় করে নিয়ে আসে। সন্তানরা খুশিতে লাফালাফি করে যার যার অংশের খাবার খায়। জমিলার মুখে তৃপ্তি হাসি ফোটে।চোখে জল আসে।আনন্দের নাকি বেদনার জমিলা বুঝে না। কেবল বুঝে, ক্ষুধার্ত সন্তানেরা খাবার পেয়ে ভিন্ন রকম আনন্দ পায়। জমিলার মাতৃত্বে ঢেউ এসে উছলে পড়ে,চোখে জল আসে।
.
বৈশাখ আসন্ন।জমিলােক এক জোড়া ইলিশ কেটে ধুয়ে দেয়ার ফরমায়েশ দেন মোল্লা সাহেবের স্ত্রী। জমিলা ইলিশ কাটতে কাটতে ঘ্রাণ শুঁকে।কত বছর আগে ইলিশ দিয়ে ভাত খেয়েছিলো মনে করতে পারে না ।ধোঁয়া উঠা গরম
ভাতে ভাজা ইলিশ দিয়ে সন্তানদের ভাত খাওয়াতে ইচ্ছে করে। সেই ইচ্ছেতে লাগামও টানে । কাটতে গিয়ে দু’টুকরো ইলিশ লুকানোর ফন্দিও আঁটে।পরক্ষণেই চুরির অপরাধে কাজ হারাতে হবে ভেবে সংবরণ করে লোভ। মেম সাবের কাছ থেকে চেয়ে নেয়ার সাহসও হয় না। আগেই তিনি বলেছেন সাড়ে পাঁচ হাজারে কিনেছেন ইলিশ দুটো।শোনে জমিলার গলা শুকিয়ে আসে।ইলিশের দাম তাঁর এক মাসের সংসার খরচের উর্ধ্বে ।মানুষের চে’ মাছের মূল্য কি তবে বেশি !
অবাক জমিলার ইলিশ শুঁকেই পেট ভরে যায়।
.
সংসারে কর্মক্ষম পুরুষ, জমিলার স্বামী গত হয়েছে চার বছর। এরপর থেকে নিজেই কাজে নেমেছে। হাল ধরেছে সংসারের।সন্তানদের একটু ভালো-মন্দ খাওয়ানোর জন্য ঝড়-বৃষ্টি, অসুখ-বিসুখেও কাজে যায়। দুপুরের খাবার বয়ে আনে আঁচলের তলায়।
.
পহেলা বৈশাখের পূর্ব সন্ধ্যা। হাড়িতে ভাত চাপিয়ে সন্তানদের পড়ার তাগাদা দেয় মা। শিশু মন। প্রশ্ন করে মাকে।
-মা , পয়লা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খায় ক্যান ?
জমিলা নিরুত্তর।
-মা , মেলায় যামু আমাগোরে পয়সা দিবা ?
জমিলা কথা বলে না।
– মা , কও না ইলিশ – পান্তা না খাইলে নাকি পয়লা বৈশাখ অয় না ?
– কেডা কইলো তরে এগুলা ?
মেয়েকে পাল্টা প্রশ্ন দেয় জমিলা।
– হ , ফুল বেচতে গেছিলাম বিহালে। এক সুন্দরী মেমসাব কার লগে জানি কতা কইতাছিল ।আরো খাওনের নাম কইলো।হুনিই নাই জীবনে। কি কি কিনছে তাও কইছে । তাগোর কি কাইলও ঈদ ? আমাগোরে নতুন কাপড় দিবা না ?
জমিলা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সন্তানদের প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ এক মায়ের তখন বুকের ভেতর তোলপাড়। গলায় কান্না আর অপারগতার সুর মিলে কঠিন এক সুরের জন্ম নেয়। চোয়াল শক্ত করে বলে উঠে,
– গরীবের আবার পয়লা বৈশাখ কি ? পান্তা-ইলিশ খাওনের অতো বিলাসিতা আমাগোর লাইগ্যা না রে । আমাগোর পত্তেক দিনই পয়লা বৈশাখ। বেইন্যার সমো ডেলি ডেলি পান্তা খাইয়া তরা ইস্কুলে গেলেই পয়লা বৈশাখ অয়া যায়।
ছেলে-মেয়ে অপলক মায়ের মুখের দিয়ে তাকিয়ে থাকে। তাঁদের মা কাঁদছে !
দু’জন মাকে জড়িয়ে ধরে ,
-পান্তা- ইলিশ খামু না মা।তাও তুমি কাইন্দো না।
১৬টি মন্তব্য
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
পান্তা-ইলিশ খাওনের অতো বিলাসিতা আমাগোর লাইগ্যা না রে । আমাগোর পত্তেক দিনই পয়লা বৈশাখ। বেইন্যার সমো ডেলি ডেলি পান্তা খাইয়া তরা ইস্কুলে গেলেই পয়লা বৈশাখ অয়া যায়।
চমৎকার বক্তব্য -{@
রুম্পা রুমানা
শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য , ভাই। ধন্যবাদ।
চাটিগাঁ থেকে বাহার
সুন্দর, হৃদয়স্পর্শী গল্প। ভালো লাগলো। -{@
রুম্পা রুমানা
ধন্যবাদ অফুরান। শুভ কামনা থাকলো আপনাকে। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
পান্তা-ইলিশ নববর্ষ নাম দেয়া উচিৎ পহেলা বৈশাখকে।
গল্পটা পড়ার মন মন ভিঁজে গেলো।
সুন্দর লিখেছেন, অবশ্য গল্প আপনি ভালো লেখেন সবসময়।
রুম্পা রুমানা
আপু , আসলেই কি ভালো লিখি ? নিজের কাছে মনে হয় এগুলো কোন লেখাই হয় না। ভালোবাসা নেবেন। (3
নীলাঞ্জনা নীলা
আসলেই ভালো লিখেন। তা নইলে বলতাম না।
ভালো থাকুন। -{@
রুম্পা রুমানা
ধন্যবাদ আপু । শুভ কামনা।
মিষ্টি জিন
নববর্ষে পান্তা ইলিশ খেতে হয়, এই উদ্ভট নিয়ম কার মাথা থেকে বের হয়েছে কে জানে।
হৃদয় ছোয়া গল্প।
রুম্পা রুমানা
সর্বজনীন উৎসব পহেলা বৈশাখ। বাঙালিয়ানা কতোটুকু ধারণ করি আমরা কে জানে ! লোক দেখানো কাজ কারবারই করি বেশি।
জিসান শা ইকরাম
পহেলা বৈশাখকে যারা পান্তা ইলিশের সাথে যুক্ত করেছে তারা দেশের সুবিধাভোগী শ্রেনী। দেশের প্রতি এদের কোন দায়বদ্ধতা নেই।
রুম্পা রুমানা
ঠিক বলেছেন ।একদম । ধন্যবাদ।
মেহেরী তাজ
এখন পহেলা বৈশাখ মানে পান্তা, ইলিশ মাথায় ফুলের মুকুট, নতুন জামা কাপড়।
বদলে গেছে আমাদের চির চেনা পহেলা বৈশাখ।
আপনি বেশ লেখেন। কিন্তু থাকেন কই?
এতো ভালো লেখা পড়া থেকে বঞ্চিত করছেন।
নিয়মিত লিখুন আপু পড়তে ভালো লাগে।
রুম্পা রুমানা
এমন উৎসাহ পেলে লিখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু অলসতায় মন -মগজ ভর্তি ! শুভ কামনা ও শুভেচ্ছা রইলো আপু। আপনিও লিখুন খুব।
রুম্পা রুমানা
ঠিক বলেছেন। একদম। ধন্যবাদ ।
মাহমুদ আল মেহেদী
আপু আপনার লেখা পড়ে আমি লিখার জন্য অনুপ্রেরনা পাই , আপনার লেখার ভাষাগুলি অনেক সহজ সরল ।