গল্পের মতোন…

অন্তরা মিতু ২৫ আগস্ট ২০১৪, সোমবার, ০২:১৮:১৫পূর্বাহ্ন গল্প ১৩ মন্তব্য

ঘুম ভাঙ্গার সময়টাকে সকাল বলা যায় না…. প্রায় দুপুর, দুপুর বা কোনোদিন দুপুরের একটু পরে।

রঙিন কাপড় দেখলেই গায়ে জ্বালা ধরে ধ্রুবর। এই দুপুরের রোদে সাততলার জানালা দিয়ে তাকাতেই পৃথিবীর সমস্ত রঙের ভেজা শাড়ি চোখে পড়ে। প্রতিটা দিনই এমন। কত শাড়ি যে পরতে পারে ওই বিল্ডিংয়ের মহিলারা! দিন শুরু না হতেই শাড়ি ধুয়ে-টুয়ে ছয়তলার ছাদে মেলে টানটান….. দেখেই অসহ্য লাগে । মনে হয় ঘুম একবারে সন্ধ্যার পরে ভাঙলেই ভালো হতো, ততক্ষণে নিশ্চয়ই শাড়িগুলো মালিকের বাসার ফেরত যেত….

সতেজ শরীরে, নেশারু মনে ধ্রুব রাস্তার মোড়ের দোকান থেকে চা নিল। দুপুরের খাওয়া একটু দেরিতে করায় মায়ের সাতকাহন শোনা প্রতিদিনের রুটিন। তারপর বাসা থেকে বের হলেই মন ফুরফুরে। আকাশে মেঘ ডাকছে অল্প। কি যেন কি হবে আজ… এমন গোপনে, যত্ন করে করে মেঘ শব্দ করছে। মামার দোকানে, দিনের প্রথম চা খেতে খেতে কয়েক বন্ধুর সাথে দেখা… কিছু টুকরো কথা হতে হতে জমাট বাঁধতে লাগলো গল্পের শরীর, যে শরীরে মেয়েদের গন্ধ লেগে থাকে। ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখা শাড়িগুলোতেও মনে হয় এমনই গন্ধ….. ভাবতেই হোঁচট লাগলো মনে… নাহ্, কাল থেকে জানালা দিয়ে তাকাবেই না সে….

ঝুপ করে বরষা ভিজিয়ে দিলো সবাইকে… চা দোকানের স্বল্পদৈর্ঘ্যের দুর্বল ছাউনির নীচে, অপরিচিত মানুষের ভিড়েই মধ্যেই, চলতে লাগলো আদিম ইঙ্গিতের সহজ রসিকতা…..

রাস্তার ভিতরের দিক থেকে একটি রিক্সা এসে থামলো দোকানের একেবারে সামনে… ঝুম বৃষ্টির মধ্যে গাঢ় নীল পর্দার আড়ালের মানুষটির মুখ অস্পষ্টভাবে দেখা গেল, মেয়ে।

ধ্রুবর বন্ধুরা সবাই মৃদুস্বরে একযোগে রিক্সাওয়ালাকে ধন্যবাদ দিল, জায়গামতোন চেইন ফেলার জন্য। এ ওকে ঠেলতে লাগলো… টস করতে যাবে এমন সময় ধ্রুব বললো-“ধুর টস… এই বৃষ্টিতে তোরা ভিজলে জ্বর আসবে না? আমিই যাই…”

দোকানের সামনে কয়েকটি রিক্সা আগে থেকেই ছিল। ওই রিক্সা টান দেওয়ার সাথে সাথে সে একটাতে উঠে বসলো।

মেইনরোড পর্যন্ত আসার পরে তার মনে হলো বোকামি হয়েছে। একটু পরে মনে হলো রিক্সাটাকে সে হারিয়ে ফেলবে, এমন বৃষ্টিতে এই বাণিজ্যে আসা মহা বোকামি। আরো একটু পরে সে স্বীকার করলো, বন্ধুদের পাল্লায় পরে তার এই চরম মাত্রার বোকামি করা মোটেও ঠিক হয় নি। পকেটে হাত দিয়ে দেখলো মানিব্যাগ ঠিক আছে কি না… এই পথ তো না শেষ হওয়ার দলে মনে হচ্ছে! এইসব যাত্রার জন্য রিক্সা একটা কিনে ফেলবে কি না, ভাবতে না ভাবতেই সামনেরটার চেইন পড়লো আবার। আশেপাশে কোনো দোকান নাই। নামার পরে কথার কোন অজুহাত সত্য বলে চালানো যাবে, ভাবতে ভাবতে ধ্রুব নেমে পড়লো।

না এবার চেইন না, বড় কোনো সমস্যা হয়েছে। রিক্সা আর চলবে না। যাত্রীর সাথে কথাবার্তার বিষয় সম্ভবত না চলার কারণ এবং ঝুঁকিসমূহ। অবশেষে তিনি নামলেন না। রিক্সাওয়ালা, পাশ দিয়ে যাওয়া সিএনজিগুলোকে ডাকতে লাগলো প্রবলভাবে। মেয়ে ভালোই ডোজ দিয়েছে লোকটিকে। ধ্রুব দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে নিজের রিক্সা ওখান থেকে ভাগালো। পরপর দুইটি সিএনজি গেলো না, ওর কানে নিউ মার্কেট শব্দটা আসলো। এইবার ও নামলো মাঠে। একটি সিএনজি নিউমার্কেটের জন্য ঠিক করে ফেলার পর, পাশে দাঁড়ানো রিক্সাওয়ালাটার প্রতি মায়াই লাগলো ওর। বললো-আপনি কই যাবেন মামা?
আমি না, আপায় যাইবো নিউমার্কেট।
ওহ, আমিও তো, উনারে বলেন একসাথে যাবে কি না, এইখানে অপেক্ষা করে তো লাভ নাই।

রিক্সাওয়ালার সাথে উনার কথা চলতে লাগলো… দীর্ঘ ভেজা শরীরে টান টান দাঁড়িয়ে থেকে ধ্রুব একসময় যখন হাল ছেড়ে দিলো, তখন মামা রিক্সাটা পিছিয়ে আনা শুরু করলো… ধ্রুব নিজের হৃৎপিন্ডের শব্দ শুনতে লাগলো, এইবার বোঝা যাবে সে আজ কতখানি বোকামি করেছে।

মামা নীল পর্দা সরালো… নীল শাড়ি !!! কম উচ্চতার হালকা শরীরে মূহূর্তেই জলের ছাট…

প্রবল বরষার পর্দার মধ্যেও ধ্রুব তাকে চিনতে পারলো… মাত্র দুই সেকেন্ড সময়েই সে সব মনে করতে পারলো। সামনের বিল্ডিংএর ছয়তলার জানালায় মাঝে মাঝে…. মায়ের কাছে ছবিও দেখেছে, বছর খানিক আগে প্রায় টানা কয়েকদিন সেই ছবি হাতে নিয়ে বাসার সবাই অত্যন্ত বিরক্ত করেছিলো। বিরক্তি যখন রাগে পরিণত প্রায়, তখন জানা গেল কণ্যার বিবাহ সুসম্পন্ন হয়েছে, ধ্রুব বেঁচে গেল। যখন দু’মাস পরেই সে ফিরে এল ছয়তলার জানালার পর্দার আড়ালে, তখন এলাকায় ঘটনাটি শীর্ষস্থানীয় টপিক ছিল। মা প্রায়ই বলতেন, “আহা রে এত লক্ষী মেয়েটা…”।

অবিরাম ঝরা জলের ফোটার মধ্যে ধ্রুব মাথা উঁচু করলো আকাশের দিকে… চোখ বন্ধ করে অনুভব করলো প্রকৃতির ভিজিয়ে দেয়ার খেলা… এক মূহূর্ত পরে চোখ খুললো স্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে।

অত্যন্ত দ্রুত যে কাজটি করা উচিত ছিল, তা অত্যন্ত ধীরে হলো । তিনি আয়োজন করে নেমে, আস্তে আস্তে হেঁটে এসে, সিএনজির দরজা সরিয়ে উঠে বসলেন, মনে হচ্ছিল যেন বিকেলের তীব্র বরষা না, সন্ধ্যারাতের জোছনা চারিদিকে। সেই জোছনায় ভিজে ভিজে নীল শাড়ি আরো নীল…

সিএনজির ভিতর থেকে ভাড়া দেয়া হলো রিক্সার মামাকে। শেষ পর্যন্ত ধ্রুব উঠলো। প্রায় সাথে সাথেই সে শুনলো “আপনাকে ধন্যবাদ, এখানে দাঁড়িয়ে থাকা যন্ত্রণা হতো”… ও তাকানোর সাহস পেলো না… এত দ্রুত কথা শুরু, ওভার স্মার্ট! উল্টো নিজে ফাঁদে পড়বে না তো!

এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সামনের আয়নায় চোখ রেখে ওর মাথা ঘুরে উঠলো, ঠোঁট-সহ মুখের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে… হায় কপাল মানুষের ঠোঁট এত সুন্দর হয়! চোখ সরিয়ে ফেললো সে। একটু পরে, সমস্ত দ্বিধা কাটিয়ে উঠে বললো-“এই বৃষ্টিতে অনেক জ্যাম হবে, সময় লাগবে যেতে…”

“হু, কিন্তু কি আর করা, যেতে তো হবেই…”

“হু…” – বলেই ধ্রুব সেই মুখের দিকে তাকালো এক পলক… মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে হয়তো… এই সুন্দরের রহস্য কি? প্রচন্ড আঘাত যারা সামলে নিতে পারে, তাদের বিগত অভিজ্ঞতা আর মানসিক শক্তিই কি এই সৌন্দর্যের ক্ষমতা দেয়? এমন রহস্যময় সহজ ব্যক্তিত্বের আলো ছড়ায়? একটু যেন হাসি হাসি মুখ, যেন এইমাত্র কোনো কৌতুক শুনেছে।

একটা সিগন্যাল। এমনই ঢল নামছে যে ফেরিওয়ালার নাম গন্ধ নেই। সি এন জির দু’পাশে পর্দা নামানোতে কেমন যেন একটা ঘর ঘর ভাব হয়েছে… ধ্রুবর মাথাটা ব্যাথা করছে অল্প অল্প… মেয়েটি টুকটাক কথা বলেই যাচ্ছে, রিক্সার চেইন, নিউমার্কেট, মিটার ছাড়া ভাড়া, ট্রাফিক পুলিশ, জ্যাম, নতুন ফ্লাই ওভার… এত কথা কেন!

সিগন্যালে বসে থাকতে থাকতেই বৃষ্টি একটু কমলো বোধহয়… কন্ঠস্বর আরো স্পষ্ট হলো… বরষাঋতু, কদম ফুল, বেলী ফুল, বাগান, গাছ, বরষার নদী, লঞ্চ, লঞ্চডুবি, প্লাবন, বন্যা….. কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে কথা… ধ্রুব শুধু, “ও-আচ্ছা-জানি-এইরকমই-তাই?…”

আবার চলা শুরু। ফ্লাইওভারের উপরে উঠতেই যাদুর মতোন বরষা বেড়ে গেলো এক মূহূর্তে। সাথে বাতাস। দুই হাত দূরের পথও দেখা যাচ্ছে না। ধ্রুবর পাশের পর্দা প্রবল উড়ছে। ঠিক করে বাঁধলো ও । এরপরে বললো- “এদিকে সরে আসেন, ভিজে যাচ্ছেন তো!” বলেই চমকে উঠলো… মুখে থেকে বেরোবার সময়ও শব্দগুলো জানতো না সে।
মেয়েটি পর্দার ফাঁক দিয়ে একটু বাইরে দেখলো, তারপর সরে এলো সত্যিই… ঝড়ো-বাতাস না থাকলে হয়তো শরীরের গন্ধ পাওয়া যেত…

মাথাব্যাথা বাড়ছে… ওদিকের কথাও। “আমার শরীরটা ভালো না” – ধ্রুব বলেই ফেললো। কিন্তু লাভ হলো না শুধু গল্পের বিষয় পরিবর্তিত হলো। আয়নায় ঠোঁটটা না দেখলে এই গল্পগুলোই কত আগ্রহ নিয়ে শুনতে পারতো ও!

মেয়েটা খুবই কাছে। ধ্রুব কথা শোনার সুযোগে আর একবারও তাকায়নি। কথার ফাঁকে বললো-“মাথাব্যাথা করছে, মনে হয় জ্বর…” … নিজের স্বর চিনতে নিজের কষ্ট হলো, যেন ঘোরের মধ্যে কেউ কথা বলছে ধরা গলায়…

মেয়েটির “তাই?” শুনে আবার চমকে উঠলো ও । আন্তরিক হাতে চুড়ির টুং-টাং শব্দসহ কপালের জ্বর দেখা পর্ব সম্পন্ন হলো… তারপর একটু থেমে টুকটুক কথা আবার… বরষা-ঠান্ডা-জ্বর-স্বাস্থ্য-ডাক্তার-ভুল চিকিৎসা-জনগণ-রাজনীতি-দেশ…

মাথাটা দুলে উঠছে… মনে হচ্ছে ও নৌকায়… চারিদিকে ঢেউয়ের উঠানামা… বৃষ্টির ঝমঝম যেন কোন সুযোগে হয়ে গেছে স্রোতের শব্দ…. নদীর পাড় ভাঙছে অবাধ্য প্লাবন…. কোনো কথাই আর ধ্রুব শুনতে পাচ্ছে না…. পৃথিবীর সব দৃশ্য, সব শব্দ একাকার… ও পুরোপুরি ডানদিকে ঘুরলো, দুই চোখ মেলে তাকালো… সেই ঠোঁটদুটো নড়ছে যেন অজানা কোনো ভাষায়… বড় বড় পাপড়ির মাঝের চোখের তারাগুলো কি কিছুটা অবাক? ও দুই হাত বাড়িয়ে মুখের দুইপাশ ধরলো… দশ আঙুলসহ ওর এই হাতের জন্মই যেন হয়েছিল এই মূহূর্তের জন্য… কি অসম্ভব নরম একটি মুখ ওর খসখসে হাতে… ও এগিয়ে গেল কাছে, এবং ঠোঁটে ঠোঁট রাখলো……. সে এখন অবাধ্য স্রোত… উছৃঙ্খল প্লাবন…

.
.
.
অগাষ্ট
২০১৪

.
কোনো এক জাদুর মতোন কোনো এক নিবিড় যতন সময় যে কি খেল দেখায় আকাশকে সাগরে নামায়...

১২১৪জন ১২১৩জন
0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ