বাহ বাসের রাজত্ত্বে একা আমি, আর ড্রাইভার। মহিলা ড্রাইভারের হাসিটা খুব মিষ্টি। ভগবান ভুল করে আমাকে মেয়ে বানিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। চোখ কি সবার কপালে উঠলো? রঙধনু! আচ্ছা যদি তা-ই ভাবে সবাই, কিচ্ছু যায় আসেনা। আমি জানি আমি কি! এ চোখ কতো যে মেয়ের দিকে চেয়ে থেকেছে। কারো চোখের চাহনি, কারো ঠোঁটের হাসি পাশে কালো তিল। চুল খুলে দিলে একরকম, খোঁপায় গাজরা জড়ালে অন্যরকম। শাড়ীতে, সালোয়ার-কামিজে(সবচেয়ে অপছন্দের পোষাক), টপ-স্কার্টে, জিন্স-টি-শার্টে, গাউনে একই চেহারা কতো ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়। নিজেকে দিয়েই তো দেখি। শাড়ীতে সব মেয়েকে নাকি ভালো লাগে (ঠিক ১০০%)। যাক কোনো মেয়ের ছবি যখন দেখি, আমি তার চোখটাকেই দেখি বেশী। চোখ এমন একটি জায়গা, যার দিকে চাইলে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কিছুটা হলেও তুলে আনে। নারীর দীঘল কালো চুল, টানা কিংবা পটল চেরা চোখ, পূর্ণিমার চাঁদের মতো হাসি, কমলার কোয়ার মতো ঠোঁট, আহা আরোও কতো যে উপমা নারীর জন্যে। প্রাচীন বাংলা গ্রন্থগুলোতে নারী সৌন্দর্যের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সে তো একেবারে প্রাপ্তবয়ষ্কদের জন্যেই প্রযোজ্য। কে লিখেছেন? আর কে! ওই পুরুষ! এদের কাছে অফুরন্ত সময় নারীদেরকে বিষয় হিসেবে সাজানো। তবে নারীর তুলনা নারী-ই। নারীকে বুঝতে কোনো ছেলে পারেনা, যতোটুকু পারে মেয়েরাই পারে। খুব সত্যি কথা পুরুষ যখন কোনো মেয়ের দিকে চেয়ে দেখে, প্রথমেই কামনার জন্ম হয়। মানুষ ভালোবাসা এবং শারীরিক চাহিদাকে মিলিয়ে ফেলে।

এবার আসি এলোমেলো অন্যকিছুতে। ফেসবুকে ছবির সুনামী চলে। সবাই জানেন। আমিও ব্যতিক্রম নই। তবে পুরুষরা নিজেদের ছবি যখন ট্যাগ করে দেয় কিংবা এলবাম তৈরী করে ফেসবুকে পোষ্ট করে, অনেক হাসি পায় আমার। আচ্ছা ওদেরকে কি দেখার আছে? পুরুষদের ব্যক্তিত্ত্ব আমায় আকর্ষণ করে, তাদের কন্ঠ, তাদের চলা-ফেরার স্টাইল আর অবশ্যই পোষাক। কেউ কেউ দাড়ি-গোঁফ রাখেন। নিজেও বোঝেন বলে মনে হয়না যে তাঁর নিজেকে মানাচ্ছে নাকি না? কেউ কেউ হেভি স্যুট-কোট-বুট পড়ে দাঁড়ান দেখলে মনে হয় একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চোখের সামনে থেকে। আর কেউ একটা টি-শার্ট-জিন্স পরিহিত, কিন্তু অদ্ভূত ব্যক্তিত্ত্ব। যার কথার মধ্যে বোঝা যায় এই পুরুষটি সম্মান দিতে জানে, কোথায় পাওয়া যায় অমন পুরুষ? উষ্কোখুষ্কো চুল, মার্জিত হাসি, আবার দৃষ্টিতে নোংড়ামি নেই, এমন পুরুষ ক’জন আছেন? যাক যা বলছিলাম পুরুষদের ছবির কথা।ছবিতে সব পুরুষকে আমার একই লাগে। কেমন জানি ম্যাদাম্যাদা। সিনেমার নায়ক কিংবা মডেলদের কথা আলাদা, কারণ ওটা ওদের প্রফেশন। আর বিয়ের পোষাকে পুরুষদের একা ছবি সে তো অসহ্যকর। কেমন জানি বলদ বলদ লাগে। কিছু কিছু পুরুষ নিজেকে একেবারে রাজপুত্র ভাবে, কেউ তো জেমস বন্ড। নিজের বরকে এখানে আনবো না, এ ব্যাপারে আমি একটু স্বার্থপর কিনা!

যাক পুরুষের ব্যাপারে বলতে গেলে কয়েকটা কথা না বলেই পারিনা। পুরুষদের মধ্যে সবচেয়ে শয়তান এবং খারাপ হয় নাকি বুড়োরা। জাপান যখন ছিলাম, তখন সেটা শুনেছি, এই কানাডায় এসেও সেই একই কথা। আর বিবাহিত পুরুষ তো ভয়ঙ্কর। এদের ঘরে-বাইরে দুদিকেই ভালোবাসা উপচানো। আহা প্রেমের নৌকায় দোলাবে, তারপর বন্যায় ভাসিয়ে-ডুবিয়ে কূল থেকে অকূলে নেবে। এদের প্রেম তো বিশাল নভোনীল। আর মেয়েগুলো ছলনা করে, ওটা পুরুষদের ভাষ্য। কতো কতো ছ্যাঁকা দিয়েছে মেয়েরা। আহা বেচারা পুরুষ, ইস ছ্যাঁকা খেয়েও আড় চোখে আবার চেয়ে দেখা। আর সাহস থাকলে সামনে দাঁড়িয়ে প্রপোজ। আচ্ছা কতোজন আছেন আপনারা যারা চোখের দিকে চোখ রেখে প্রপোজ করেছেন? মেয়েরা সেটা পারেনা। কারণ লজ্জ্বা। তার মানে পুরুষদের লজ্জ্বা নামক বস্তুটি নেই।

আমার এলোমেলো কথাগুলো বাসে বসেই লেখা হয় বেশী। আর আজ লিখতে গিয়ে শান্তি আর শান্তি। শুধু খেয়াল রাখছিলাম বাস স্টপ পেড়িয়ে না চলে যাই। হঠাৎ বাস থামলো, দেখি এক মা এবং বাচ্চা (বয়স মনে হয় দুইয়ের বেশী হবে না) উঠেছে বাসে। উঠেই একটা চোখ বন্ধ করে আমায় ওর হাসি দিচ্ছে। আজকালকার বাচ্চারা ভালোই ফ্লার্ট(পজিটিভ অর্থে) করতে পারে। আমার খুব ক্লোজ বন্ধু ওর ছেলেটা আমায় ওর গার্লফ্রেন্ড বলে। ওর বাবাকে বলতো, “দেখো বাপি ও কিন্তু আমার গার্লফ্রেন্ড, তোমার না।” আমার বন্ধুটি হাসতো আর বলতো, “তোর গার্লফ্রেন্ডের চেয়ে আমার বৌ অনেক বেশী সুন্দর।” বাবা-ছেলের এই দুষ্টুমী ফোনে শুনতাম। ওর বাবাকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলতো আমায় ফোন দিতে। বাসের এই পিচ্চি ভালোই চোখ ইশারা করে যাচ্ছে। সবশেষে যা হলো হাত দিয়ে ডাকা। ভাবলাম এই ছেলে বড়ো হলে এভাবে যদি করে কেউ কি হাসবো আমরা? এরপর বাস তো যাচ্ছে, আস্তে আস্তে ভীড় বাড়ছে। এখন পিচ্চিটা আমায় দেখেনা, আমিও না। কিন্তু পিচ্চির কান্না শুনলাম। এদিক-ওদিক করে অনেক কষ্টে ভীড়ের ফাঁকে চোখটা ওর চোখের উপর পড়তেই আহা একেবারে প্রেমিক টাইপ হাসি। বললাম মনে মনে আরে ব্যাটা এই বয়সেই এই! এখন পিচ্চি, এরপর পুরুষ যখন হবি তখন যে কতোজনের সাথে ফ্লার্ট করবি কে জানে! আরোও একদিন এভাবেই বাসের ভেতর বসে হঠাৎ চোখ পড়লো একটা বাচ্চার দিকে। দেখি আমাকে দেখেই যাচ্ছে। আমি হাসিটা দেয়ার আগেই ও আমাকে ওর হাসিটুকু দিয়ে ফেললো। আমার তো দিব্যি রাগ উঠে গেলো। আমার হাসির আগে ও হাসি দিয়ে আমাকেই হারিয়ে দিলো? এখানে অপরিচিত বাচ্চার দিকে সরাসরি বেশীক্ষণ চেয়ে থাকা যায়না। জানিনা কেন। হয়তো ভাবে ছেলেধরা। আচ্ছা ছেলেধরা কেন, মেয়েধরা বলেনা কেন? কারণ পুরুষরাই যে ওই কাজটি করে বেশী। এখন অবশ্য নারীরাও পিছিয়ে নেই এই কাজে। কারণ? ওই যে ঘরে স্বামী-সন্তান, তাদের জন্যই। যাক ওই প্রসঙ্গে যেতে চাইছি না। পিচ্চির জন্যেই যে আজ লিখতে পারলাম, নাম-না-জানা বাচ্চাটি মানুষ হোক। একজন ব্যক্তিত্ত্বশালী পুরুষ হোক।

একটা কথা না বললেই নয়। জীবনের প্রথম ভালোবাসার পুরুষ আমার বাবা। দ্বিতীয় আমার ভাই রানা অদ্ভূত ক্ষমতা মানুষকে ক্ষমা করতে এবং ক্ষমা শেখাতে, হাসিতে ভরিয়ে রাখতে। তারপর আমার বড়ো দাদা(নেই পৃথিবীতে) ওর কন্ঠ অসাধারণ। ওকে দেখলে শ্রদ্ধা আসবেই মনে। একজন ডাক্তার হয়েও স্বার্থহীন মানুষ ছিলো। এমনই অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্বর অধিকারী ছিলো সে, ওর চোখের দিকে চাইলেই মনটা ভরে যেতো। আর চোখের দেখায় যাদের প্রতি সম্মান জেগেছিলো, ট্রেনে পরিচয় একজন আর্মি অফিসার অসম্ভব ভদ্র, উনার চোখে আমি কোনো নোংড়ামী দেখিনি। একটা দারুণ ব্যক্তিত্ত্ব। ভদ্রলোকের নাম-চেহারা এখন কিছুই আর মনে নেই। তবে মানুষের ব্যবহারে সেই মানুষকে জীবনের কখনও না কখনও ভাবনায় নিয়ে আসে। যাকে এই সমাজ বলবে ওটাই প্রেম। আরেকজন হলেন আমার ডাক্তার দাদার বন্ধু, নামটা বলবোনা। অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্বসম্পন্ন একজন মানুষ। উনার মধ্যে আমার বাপির চরিত্রের প্রায় সব। তার স্নেহ, শাসন, ভালোবাসা সবই পেয়েছি আমি। কখনো বাবু রে, ও আমার বাবুই পাখী, নিজেকে কেমন জানি ছোট্ট সেই পিচ্চি লাগে। আমার বাবার আরেক রূপ। মনের মধ্যে প্রশ্ন আসছে আর আমার বর কেমন? কপাল তো তরুণের খারাপ আমার মতো স্ত্রী ওর কপালে। একটা কথায় বুঝিয়ে দেই আমার বিচ্ছিরি রাগ তরুণ নিতে পারে, আর অনেক ভালো একজন বাবাও সে।

এই পোষ্টের সাথে কয়েকটি সাবধানবাণী :

১) বুড়োদের থেকে ১০০ হাত দূরত্ত্ব রাখুন। ভাবতে গেলে নিরাপদ, আসলে ভাইরাস। বিশেষ করে নানা বলে ডাকলে আজীবন তাঁর স্নেহের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে যেতে হবে। কান ঝালাপালা হয়ে যাবে “ও নাত্নী, ও নাত্নী” শুনতে শুনতে।

২) যেসব পুরুষ বলেন তিনি সংসার জীবনে সুখী নন, আপনি বললেন তাহলে থাকছেন কেন? ছেড়ে দিন, তখন কিন্তু উনারা পিছ পা হয়ে ওই বৌয়ের কোলে গিয়েই মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়বেন।

৩) কোনো টাকলুর সাথে বন্ধুত্ত্ব করবেন না। এঁরা আবার বেশী জ্ঞানসমৃদ্ধ আঁতেল হয়ে থাকে।

৪) পুরুষ কবিদের কবিতা পড়ুন, কিন্তু সাবধান তাঁদের কবিতা বুঝতে চাইবেন না। মেয়েরা যদি তাঁদের চুল না ফেলতে চান।

৫) এই পোষ্টটি কাউকে বিদ্রূপ করে নয়, অনেক মজা করার জন্যে লিখেছি। তাই সাবধান কেউ ভুলেও ভুল বুঝবেন না। আর ভুল বুঝলে গালমন্দ যতো খুশী করতে পারেন। হাসিমুখে সয়ে নেয়া আমার জন্যে ব্যাপারই না।

ব্লগে আসার সময় পাচ্ছিনা। অনেক ব্যস্ততা। বাসায় ফিরে ল্যাপু খুলতে ইচ্ছে করেনা এমনই ক্লান্ত থাকি। এই যে লিখছি আসলে ঢুলছি। ক্লায়েন্ট ক্যানসেল হয়ে যাওয়াতে তাড়াতাড়ি বাসায় এসেই বসলাম সেলফোন থেকে নোটটা ল্যাপুতে তুলতে। এতো কষ্ট করেছি প্লিজ প্লিজ প্লিজ কেউ বকুনী দিওনা। নারী-পুরুষ যতো দ্বন্দ্বই থাকুক, ভালো-মন্দ সকলের মধ্যেই কম-বেশী। আমরা নারীরা নিশ্চিন্তির শ্বাস নিতে চাই ঠিক এই কানাডায় যেমন নিচ্ছি। নিজের দেশেও ঠিক এমনই নিরাপত্তা চাই।

**একটি কবিতাও দিচ্ছি, বাসে বসেই লেখা। তবে সেটা আজকের নয়। দেবো দেবো করে আর দেয়া হয়নি। কবিতার নাম – “ভেঁজা আঁচলে”

সবুজের কান্নায় কলির হাসি
সবুজের কান্নায় কলির হাসি

মেঘের দরোজা খুলে কি জানি কোন কথা বলে বৃষ্টি!
ওসব শুনে মাটির বুক আরোও সবুজ হয়ে ওঠে।
আকাশ মেঘলা রঙের পাঞ্জাবী পড়ে দু’ বাহু বিস্তৃত করে
আমার দশ দিগন্ত জড়িয়ে নেয়।
ফিসফিসিয়ে শব্দ আসে হাওয়ার,
আমার কানে কানে বলে যায়, “ওড়াও আঁচল। ভাঙ্গো নিজেকে।”
ভোরের নিঃশ্বাসের যে একটা গন্ধ আছে,
সেই ঘ্রাণ বলে দেয়, “এই মেয়ে জানো, এখনও কিন্তু স্বপ্নেরা আশা ছাড়েনি!
কেউ তো আছে পথের বাঁকে আজোও তোমাকেই খুঁজে যায়।”
তখন জমে থাকা জল এ চোখের ঝিলে আলোক-পদ্ম ফোঁটায়,
আর আমি ভিঁজি, ভিঁজতেই থাকি
আঁচল উড়িয়ে বৃষ্টির জলে।   (হ্যামিল্টন, কানাডা //১৪ জুলাই, ২০১৫ ইং।)

হ্যামিল্টন, কানাডা
২০ আগষ্ট, ২০১৫ ইং।

**ছবিটি এই মেয়েটির তোলা সেলফোনেই। পথে হাঁটতে হাঁটতে বৃষ্টিতে ভিঁজে।

৭৯১জন ৭৯১জন
0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ