এলোমেলো কিছু কথা…**বারো**

নীলাঞ্জনা নীলা ১৬ অক্টোবর ২০১৫, শুক্রবার, ০৩:৪৫:৪৩পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি, বিবিধ ৬১ মন্তব্য
ভোরের মেঘের মানচিত্র...
ভোরের মেঘের মানচিত্র…

জীবন নাকি ঝরা-পাতার কাব্য? সত্যি কি? সকালে এলার্মটা বাজতেই আর এসব কাব্য-কথা মনে থাকেনা। তখন দায়িত্ত্ব-ভরা কলস কাঁখে নিয়ে ছুটতে হয় জীবনের পথে। অন্যান্য দিনের মতোই আজকের সকালটা। আজকাল সবাই কেমন জানি ব্যস্ত! আগে বান্ধবীর ম্যাসেজ পেতাম সুপ্রভাত। এখন সেলফোনটা নির্জীব পড়ে থাকে এলার্মের অপেক্ষায়। প্রথম বাস মিস হলো, ক্লায়েন্টকে ফোন দিয়ে বললাম আসছি। বাস মিস একটু সময় লাগবে। বুড়ো মানুষটার হাসি লাগানো থাকে মুখে। কখনো ঝামেলা করেনি কেন দেরী হলো! আমার পেশায় বলাই আছে কাজ কিংবা কোনো ক্লায়েন্ট নিয়ে কিছু বলা যাবেনা। তাই অন্য কথায় আসছি। এমনিতেই মন খারাপ ছিলো। আমার একজন মা আছে এখানে যে আমার চোখ-মুখ দেখে আমায় বুঝে ফেলে। সে কিন্তু আমার চাকরী জীবনের প্রথম ক্লায়েন্ট। মাম্মা ডাকি তাকে, একদিন উনার স্বামী এসে বললো, উনাকেও পাপা ডাকতে হবে। আমি তা-ই ডাকি। অফিস জানে না আমাদের এই সম্পর্কের কথা। সেই মাম্মা আজ হাসপাতালে। আজকাল অনেক প্রফেশনাল হয়ে গেছি। এই তো আজই একজন মারা গেলো, কি অনায়াসে অফিসে ফোন দিয়ে বললাম সুয়েন মারা গেছে। আমার কোনো কষ্ট হয়নি সেভাবে। বরং প্রার্থনাই করছিলাম ভগবান ওকে নিয়ে যাও। অনেক কষ্ট পাচ্ছিলো গতকাল গিয়ে দেখেছি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। যদিও গতকালই বুঝে গেছিলাম রাত পার হবে না। তবুও আমি মানুষ তো। কিছুটা তো কষ্ট হয়ই। তবে সেই কষ্টের গভীরতা নেই বললেই চলে। একসময় পত্রিকার পাতায় পড়া কোনো মানুষের মৃত্যুর খবর পড়লেই অনেক যন্ত্রণা হতো। সেই আমি কি করে বদলে গেলাম! সময় আসলেই যাদুকর।

ফুরিয়ে যায়।
গরম মগে ধোঁয়া সরিয়ে চুমুক দেয়া কফি কিংবা চা ফুরিয়ে যায়।
হাওয়ার মতো মিলিয়ে যায়।
নিঃশ্বাস এবং মানুষ
কফির সাথে মানুষ!!! সময়ের সাথে বুঝি নিঃশ্বাস?
সময় ম্যাজিক জানে,
তা নইলে কি অনায়াসে বদলে যেতে পারে নাগরিক জীবন!?

যাক সকালে বাসে বসে কিংবা দাঁড়িয়েই থাকিনা কেন, ব্লগে একটু হলেও উঁকি দেই। হুম মন্তব্য করার সময় থাকেনা। আর কিছু কিছু লেখা এতোটাই আকর্ষণীয় যে মন্তব্য না করে পারা যায়না। উঁকি দিয়েই যা দেখলাম নাসির সারওয়ার ভাইয়ের লেখা “কবি হবো।” একটানে পড়ে গেলাম। লগ ইন করতে বাধ্য হলাম। মন্তব্য করতেই হলো। স্মৃতিকথা বড়ো টানে আমায়। মানুষকে চেনা কিংবা জানা কিংবা বোঝা যায় তার অতীতের দিনগুলো দিয়ে। আমাদের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য এখানে কিন্তু কোনো মুখোশ থাকে না। সাধারণত খুব কম মানুষেরই মুখোশ থাকে ওই সময়গুলোতে। আমি নাসির ভাইয়ের সেই সময়টাকে একটু জানলাম। গতকাল রাতে লিখছিলাম,

পাড় ছুঁয়ে দিলেই জলের আঁখর স্পষ্ট হবে
চিরল চিরল পাতা্র ছায়ায় শব্দেরা গাঢ় হবে
একটিবার মধ্য পুকুরে সাঁতার দিয়েই
ডুবুরী জেতে জীবনের প্রয়োজনে নির্দিষ্ট সময়-সীমায়
কিন্তু কবিতায় আজন্ম ডুবে থাকে কবি
সেই আবেগ সাঁতার কাটে মনের জলে
তাই তো বারবার ফিরে আসা এখানেই
তবুও এখানেই।
কবিতার ভূবন সে কি আর বাস্তব জীবন বোঝে?
কবিতা যে বোহেমিয়ান ঠিক আমারই মতো।

ওই লেখাটার রাফ অংশ দিয়েই মন্তব্যটা করলাম। তখুনি চোখে পড়লো আমাদের হাসির ফেরিওয়ালা নীতেশ বড়ুয়া দাদা যার ঝোলায় বিভিন্ন রকমের হাসি থাকে, উনি “কবি হবো” পোষ্টের প্রতি-মন্তব্যে একটি পোষ্ট দিয়েছেন “লিখতে হবে (কবি হবো পোস্টের মন্তব্যে)।” আমি কিভাবে কাজে মন দেবো? যে করেই হোক পড়ে মন্তব্য করতেই হবে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে(মতান্তরে দৌঁড়ে দৌঁড়ে) পড়ে মন্তব্য করলাম। নাসির ভাইয়ু আর নীতেশদা আপনাদের বলছি এমন আর কখনো লিখবেন না যেনো :@ । ফিরে আসছি মাথার ভেতর খুঁচিয়ে চলছে নিজের জীবন। ফেলে আসা দিন এই লেখা নিয়েই। কিভাবে পার করেছি লেখার জীবন। নীতেশদার লেখা পড়েই সব মনে এলো আবার।

অনেক বছর আগে একটি খুকী লিখলো কলমি শাকের ফুলে ভরে গেলো পুকুর পাড়। একজন মানুষ এ নিয়ে বিদ্রূপ কলমি শাকের আবার ফুল আছে নাকি? ওই খুকীটা আবার লিখলো ঢাকা থেকে ওর মামা ওর জন্যে একটা জামা নিয়ে আসবে। জামার অপেক্ষায় মেয়েটি কখনো থাকেনি, আজও না। মামা আসবে সেই অপেক্ষা আসলে ছিলো। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে দেখে মামা নেই কোথাও। তারপর সবদিকে খোঁজ, এমনকি উঠোনের লেবু ঝোঁপের ভেতরও। ওখানে লুকোচুরি খেলার জায়গাও বটে। লেবুর ঝোঁপে লুকিয়েছে নাকি মামা। সেই নিয়ে লিখে ফেললো, যদিও সব মনে নেই। কয়েকটি লাইন এমন,
মামা আমার হারিয়ে গেলো লেবু গাছের ঝোপে
ডালটি কেটে ফেলো এক কোপে
তবেই না বেড়ুবে মামা
পাবো আমি নতূন জামা।——অনেক ক্ষ্যাপানো। অনেক ছোট ছিলো মেয়েটি। একটু বড়ো হলো, তখনও প্রাথমিক বিদ্যালয় পার করেনি। শামসুর রাহমানের “স্বাধীনতা তুমি” কবিতাটি পড়ে মনে হলো মেয়েটির এভাবে কি লেখা যায়,
“স্বাধীনতা তুমি দূরন্ত হাওয়া্র ভেতর উড়ন্ত পাখীর ডানা?” শুরু হয়ে গেলো ক্ষ্যাপানো। এই লাইনটিকে কতোভাবে যে ভর্তা করা হয়েছে। খুকীটি বড়ো হবার পর বড়ো মাসীর মেঝো ছেলে শোভনদা বলতো, “তুই তো মহাকবি রে।” অনেক কষ্ট ওসব ব্যঙ্গ নেয়া। তখন তো আর খুকী নেই ওই খুকীটি, কিশোরী হয়ে গেছে। গোমড়া মুখে শুধু চুপচাপ বসে নিঃসঙ্গ-একাকী হয়ে, তা-ই নয়। অভিমানও যোগ হয় ওই বয়সে। যে মোটা বাইন্ডিং খাতাটা ছিলো, মেয়েটি গেল ঠেকালো ওর বুকে। আদর করলো। তারপর মনে মনে বললো, “আমায় ক্ষমা করিস।” রান্নাঘরে চুলোর আগুণে ঢুকিয়ে দিলো। শোভনদা ছিলো সামনে। ততোক্ষণে ছাই। আর কাউকে পড়তে দিতো না লেখা। ১৯৯০ সালে মেয়েটি তখন ইন্টারমিডিয়েট ফার্ষ্ট ইয়ারে ভর্তি হয়ে পেলো বাংলার শিক্ষক আবু রায়হান সেলিম স্যারকে। রায়হান স্যার এই মানুষটি ওই মেয়েটির লেখার আকাশের ধ্রুবতারা। ওই মেয়েটি আজকের এই যে আমি, আমার লেখা সব স্যারের অনুপ্রেরণায়। যা কিছু লিখি আমি আজ স্যার না থাকলে আলোর মুখ দেখতো না। কোনোদিনও না।

গান গাইতাম। শান্তিনিকেতন কিংবা ছায়ানটের কোনো সার্টিফিকেট ছিলোনা। কিন্তু বাপি-মামনির ছায়া ছিলো। ওরা দুজন গাইতো, আমিও গাইতাম। বাপি তবলায় সঙ্গত দিতো, মামনি হারমোনিয়মে। একবার মারাত্মক ঘটনা ঘটলো। টনসিল ব্যথায় গলা ফুলে ভয়ানক অবস্থা। অপারেশন লাগবেই। ডেট পড়লো। অবশেষে অদ্ভূতভাবে অপারেশন ছাড়াই টনসিল বার্ষ্ট করলো। তিনমাস কথা বলা বন্ধ, ইশারায় চললো দিনকাল। ক্লাশ সিক্সে পড়ি তখন। কন্ঠস্বর বদলে গেলো। ডাক্তার বললো জীবনে আর গান গাইতে পারবোনা। বাপির চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়েছিলো ডাক্তারের ওই কথায়। টানা চার বছর গান গাইনি। নিষেধ থাকা সত্ত্বেও একদিন হারমোনিয়ম নিয়ে বসে পড়লাম। আমি কখনো স্বরলিপি ধরে গান উঠাইনি হারমোনিয়মে। শুনে শুনে তুলি, এখনও। আসলে পারিনা দেখে দেখে হারমোনিয়ম বাজাতে।
“খাতা দেখে গান গেওনা উল্টে পাতা যেতেও পারে”

আমার মেঝো মাসী(মিতা আন্টি) আমার গানের ভক্ত ছিলো খুব। আমায় নিয়ে অনেক গর্ব করে কতো কি যে বলতো। খুব লজ্জ্বা পেতাম। একদিন গান গাইছি, একজন মানুষ এসে বললেন, “সর তুই ওঠ। ওকে গাইতে দে। দেখ কেমন গায়, তুই তো আর ছায়ানটে শিখিস না। শেখ ওর থেকে।” এখনও কথাগুলো মনে আছে। অনেক মানুষের মধ্যে বিদ্রূপ করে বলেছিলেন উনি। নাহ উনার পরিচয় দেবো না। আজ মানুষটির হৃদয়ে ব্লক। অদ্ভূতভাবে সত্যি আমার একটুকুও খারাপ লাগছে না। মনে হচ্ছে এটাই হওয়া উচিৎ ছিলো তার অনেক আগেই। আমি এরপর আর ওই মানুষটির সামনে গান করিনি।আমরা বড়োদের থেকে ভালোগুলো যেমন শিখি, খারাপগুলোও কিন্তু শিখি। কেউ ভালোগুলোই বেছে নেয়, কেউবা দুটোই। শুধু খারাপ বেছে কেউই নেয়না। উনি অনেক বড়ো, আজ অনেক সম্মানিয় একজন হতে পারতেন আমার কাছে। সময় যে যাদুকর আমাদের জীবনের পরিবর্তন যেমন ঘটায়, তেমনি আমাদের মন-মানসিকতারও পরিবর্তনের জন্য দায়ী করা যায় এই সময়কেই। আমি উনার জন্যে খারাপটাই বেছে নিলাম। কোনোদিন ক্ষমা করবো না।

সবশেষে আসি মজার কথায়। বাসায় আসছি বিল্ডিঙের সুপারভাইজার ডেকে বললো আমার একটা পার্শ্বেল আছে। ছোট্ট একটা পার্শ্বেল। ওতে লেখা মোবাইল এক্সেসরিস। ভাবলাম তরুণ বুঝি অনলাইনে পাঠিয়েছে তীর্থের আইপডের জন্য কিছু। বাসায় এনে খুললাম, দেখি একটা এঙ্কেল সাপোর্ট। আমার গোড়ালিতে ব্যথা সবাই জানে না। খুব কাছের মানুষেরাই জানে।ঊর্মীকে ফোন দিয়ে বললাম, তুই কেন এসব পাঠিয়েছিস? কারণ এসব চমক আমাকে ও-ই দেয়। বললো ও দেয়নি সত্যি। তাহলে কে দেবে? বললো, “দেখ তোর জন্যে কার এতো প্রাণ পুড়ছে?” বলেই দুষ্টুমী শুরু করলো। জানতে চাইলো কে কে জানে আমার গোড়ালির ব্যথার কথা? বললাম তুই-শিল্পী আর দুজন বন্ধু এবং নানা ছাড়া আর কেউ জানেনা। দুই বন্ধু পাঠাবে? অসম্ভব! শিল্পীও না। তাহলে কি নানা? এ তো আরোইইইইইইইই মহা-বেসম্ভব। তবে কে? কে? কে? কে? ;?   ;?   ;?
ঊর্মী বললো, “তোকে যে সবথেকে বেশী ভালোবাসে, কেয়ার করে সে- ই পাঠিয়েছে ওটা। দেখ তো পায়ে ঠিক হয় কিনা!” বেশ কয়েকদিন থেকে গোড়ালি ফুলে গেছে আরোও। বেশ ব্যথা হয়। এটা না বললেও ঊর্মী বোঝে। যতোই বকুক, যতোই আড়াল তুলুক, যতোই অভিমান হোক না কেন, আমি জানি এটা ও-ই পাঠিয়েছে। যাকে আমি কষ্ট-যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই দিতে পারিনা। গতকালও অনেক কষ্ট দিয়ে কথা বলেছি ওকে আর শিল্পীকে। ঊর্মী-শিল্পী আমায় ক্ষমা করিস। এ জীবনে তোদের থেকে দূরে সরে থাকতে পারবো না আমি। লেখায় আবেগ আসে তখনই যখন জীবনে আবেগ থাকে।

বন্ধু তোদের ছায়ায় আমায় আগলে রাখিস
জ্বরের কপালে ভেঁজা তোদের হাতটা দিস
মন কেমনের বিষণ্ণতায় অলস বিকেল
সেই সময়ে একটু তোরা খবর নিস
অনেক রাতে যখন একা, বড়ো একা
অনিচ্ছেতেও নইলে একটা ফোন করিস
বন্ধু তোদের আঁচলে আমায় লুকিয়ে নিস
স্বার্থপর এই আমার ডাকে প্লিজ তোরা সাড়া দিস।

বহুদিন পর এলোমেলো লেখা। অনেক বেশী বড়ো হয়ে গেলো। কেউ আমায় বকবেন না যেনো। নো গালমন্দ। অবশ্য আমার মন এখন হাল্কা সব লেখার পর।       \|/    \|/    \|/    \|/    \|/    \|/    \|/    \|/

“আহা কি আনন্দ আকাশে-বাতাসে।” \|/   \|/  পুজো এসে গেলো।  \|/    \|/
https://www.youtube.com/watch?v=95N-Z3yjryg

হ্যামিল্টন, কানাডা
১৫ অক্টোবর, ২০১৫ ইং।

৬৩৬জন ৬৩৬জন
0 Shares

৬১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ