প্রতিদিন একঘেঁয়ে একটা জীবন। অ্যালার্ম বাজলেই উঠে রেডি, বাসের জন্যে দৌঁড়, তারপর সারাদিন অসুস্থতার কাছে সমর্পণ। তবুও বলি ভালো আছি এই যান্ত্রিক সময়ের মধ্যে। আজকাল চাকরীর বাজার ভালো না। তার মধ্যেও যে পাশ করেই চাকরী পেয়েছি, তাকে নিয়ে আফসোস করিনা। কিন্তু ক্লান্তি তো আসেই। বিশেষ করে সকালে যখন বিছানা ছেড়ে উঠতে হয়, মনে পড়ে যায় স্কুল-কলেজ জীবনের কথা। আর ঢাকা/সিলেট থেকে বাসায় ফিরে এলে তো আমি রাজকন্যে। সকালে যেনো শব্দ না হয়, রাত জাগি তাই ঘুম। মামনি পছন্দ করতো না, কিন্তু বাপি বলতো “থাউক ঘুমাউক। যখন ঘাড়ের উপর চাপ পড়বো তখন আর কই পারবো ঘুমাইতে?” কোন কথা থেকে কোথায় চলে এলাম। আজকাল সেভাবে কোথাও যাওয়া হয়না। পুরো সামারটাই চলে গেলো, কতো প্ল্যান ছিলো গহীন অরণ্যে যাবো। আমরা তিন বান্ধবীদের পরিবার মিলে কটেজ ভাড়া করবো, থাকবো, ঘুরবো। কই আর যাওয়া হলো?

মাসে আমি দুটো উইকএন্ড ছুটি পাই। গতকাল কাজ ছিলো তাও দুজন ক্লায়েন্ট ছিলো, একজন ক্যান্সেল করলেন। যাক রবিবার বাস খুব কম। অপেক্ষার পর অপেক্ষা। এরপর নতূন বৌয়ের মতো দুলতে দুলতে এলেন বাসরানী। বৌরানীর কোলে জায়গা নেই। “ছন্দে ছন্দে দুলি” নিরানন্দে আমি ধুতুরা ফুল গো। গিয়ে নেমে আরেকটা বাসের অপেক্ষা। একজন ড্রাইভার দেখলো আমায় দৌঁড়ে আসছি, আমার চেহারা বোধ হয় পছন্দ হয়নি সে একেবারে দিলো দৌঁড়। গালাগালের কয়েকটা শব্দ আছে যা আমি রাগলেই ব্যবহার করি তবে মনে মনে। শয়তান, বান্দর, ফাজিল, বদমায়েশ চড়িয়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো। আবার বলি ধুর দাঁত কই, এমন লাত্থি দেবো রে বাস তোরে। লাত্থি কি আসলে দেয়া সম্ভব! নিজের পা-ই তো ভাঙ্গবে। চুপ করে অপেক্ষায় রইলাম। আধ ঘন্টা পর এলেন রাজকুমার। এটা রাজকুমার কারণ বেশ জোরেই এসে ব্রেক টানলেন কিনা। ড্রাইভারটা একখানা মিষ্টি হাসি দিয়ে বললেন, “গুড মর্ণিং।” আমিও কেলিয়ে বললাম। যাক রাজকুমার বাসের কোলে বসার সুযোগ পেলাম। কিন্তু মাত্র পাঁচটি স্টপেজ বেশীক্ষণ বসতে পারলাম না। নেমেই দৌঁড়। কাজ শেষ করে আবার ছুট কারণ ঢা.বি’র জগন্নাথ হলের পিকনিক। বাস তো আসেনা আর। সময় দেখি আর বলি আয়রে মনা, আয়রে সোনা। এলেন নতূন বৌ। কতোক্ষণ পর? আধঘন্টা পর।   😀

বাসায় এলাম, এসেই কি পড়বো? আমি আগে থেকে রেডি করে রাখিনা কিছু সহজে। আর আমি পছন্দে আনাড়ি। টেক্সট করলাম বান্ধবীকে প্লিজ রাগ করিস না, বলে দে কি পড়বো? ফোন দিয়ে বললো কূর্তি পড়। ব্যস রেডি হলাম। তরুণ বললো অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে। আর কতোক্ষণ! বললাম আরোও পনেরো মিনিট। ভাবছেন মেকাপের জন্য দেরী? ওই জিনিস আমি করিনা, নিজেকে ডাইনী লাগে মেকাপ করলে। বিয়ের সময় আয়নায় দেখে আঁৎকে উঠেছিলাম। কেন সে কি আর বলতে হবে? ওহ আমার ছেলে তীর্থ (ওকে ওর বন্ধুরা সবাই কিন্তু নভোনীল নামে চেনে) বললো গিয়ে বারবিকিউ পাবে তো? বললাম এই তুই কি রে? খাওয়ার চিন্তা করিস শুধু? মুখটা কালো করে গাড়ীতে বসে রইলো। ক্ষিদে তো আমার, সকালে কিচ্ছু খেয়ে যেতে পারিনি। ভেবেছিলাম কফি কিনবো, বাসের জন্যে অপেক্ষায় সেও পারিনি। শুধু জল পান করেই যাচ্ছি। হ্যামিল্টন থেকে টরেন্টো পার হয়ে স্কারব্যুরো শহরের থমসন মেমোরিয়াল পার্ক বেশী দূর না, একঘন্টা লাগে। তবে দেশের জন্যে বেশ দূর। গিয়ে পৌঁছলাম, কিন্তু পার্কিং পাওয়া যাচ্ছেনা। এতোটাই ভীড়। ওই পার্কে একই দিনে কতো কতো যে পিকনিক হচ্ছিলো। যা হোক আধঘন্টা লাগলো গাড়ী পার্ক করতে। খুবই সুন্দর পার্কটা। সবুজ আর সবুজ।  যাক তারপর তো ক্ষিদে, কিন্তু গিয়েই তো খেতে পারিনা। তরুণের বন্ধু বিপ্লদদা এসে বললেন বারবিকিউ হচ্ছে ওদিকে যেতে। একটু ভাব তো নিতেই হয় বললাম ঠিক আছে দাদা পরে যাবো। উনি জোর করলেন আহা “ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়” এ লাইনটা ক্ষিদে পেলেই মনে আসে। আমিও নতূন বৌয়ের ভাব ধরে গেলাম, তীর্থও সাথে। তিন পিস খেয়ে মনে হলো আহা কি শান্তি। আসলেই “পেট শান্তি তো জগৎ শান্তি।” চেয়ে কিছু না পেলে কতো মন খারাপ হয়, আর ক্ষিদে নিয়ে থাকলে জীবন শেষ হয়ে যায়।

IMG_20150810_134119
ফটোশেসন এক
IMG_20150809_162920032
ফটোশেসন দুই

এক এক করে পরিচিতদের সাথে দেখা হলো। গল্প-আড্ডা-হাসি-আনন্দ-খেলা। বাচ্চাদের খেলা হবার পর এক বৌদি এসে বলছেন কমিটি মেম্বারদের, মায়েরা এতো কষ্ট করে অথচ মায়েদের জন্যে কোনো এন্টারটেইনমেন্ট নেই। ঠিক না। আসলেই তো মায়েরা আমরা বেড়াতে গিয়েও খেয়ালে রাখি সন্তান কি করে, খেলো কিনা! বাবারাও করে, কিন্তু মায়েদের দায়িত্ত্বটা অন্যরকম।

শুরু হলো পিলো পাসিং। আমি জানি এসব খেলায় একেবারে প্রথম রাউন্ডেই আমাকে পরাজয় হাসিমুখে স্বীকার করে নিতে হয়। গান ছাড়া হলো, কি করে জানি আট রাউন্ড পর্যন্ত টিকে গেলাম। এটুকুই অনেক আমার জন্যে। মনে হয় গতকাল আমার জন্য বেশ লাকী ছিলো। তা নইলে আট রাউন্ড!   😮   তারপর ওটা শেষ হবার পর শুরু হলো হাঁড়ি ভাঙ্গা। এখানে মাটির হাঁড়ি নেই, রাখা হলো তরমুজ। কিন্তু এর আগে কয়েকজন একেবারে এদিক-সেদিক হাঁটা। সবাই হাসছে। এক একজন বলছেন কারো মাথা না ভাঙ্গলেই হয়!  😀    উত্তর-দক্ষিণ হাঁটা  আর কোথায় তরমুজ? অবশেষে এলো আমার পালা। আমার অবস্থা হলো চশমা খুলে দিলে “আলো আমার, আলো ওগো, আলোয় ভূবন ভরা” এ গান আর থাকেনা। তখন হয় “তুমি কি কুয়াশা? ধোঁয়া ধোঁয়া ধোঁয়া?” আমার মাসতুতো বোন বিয়ের আগে মজা করে বলতো, “নীলাদি শুভদৃষ্টির সময় চশমা ছাড়া কার দিকে চাইবি আর দেখা যাবে কাকে না কাকে মালা পড়িয়ে দিয়েছিস। অবশ্য মালা পড়ানোর সময় আমরা নয় হাত ধরে রাখবো, শুভদৃষ্টি কি হবে রে?” :D)   বলতাম ওসব টাইপ বিয়ে করলে তো! যাক ছোট্ট একটা ঘটনা বলে নেই এই ফাঁকে। বান্ধবীর মেয়ের জন্মদিনের পার্টিতে মেয়েটি বললো, “আন্টি তুমি চশমা খোলো। প্লিজ।” জন্মদিন কন্যার কথা তো আর ফেলতে পারিনা। আর এই মেয়েটি আমার অনেক আদরের। খুলে ওখানেই দাঁড়ানো। এক দিদি এলেন, হয়তো আমার চোখ উনার চোখের দিকে পড়েছে। আমি তো কথা বলিনি, দেখলে না বলবো? নতূন তখন চাকরী পেয়েছিলাম। চম্পাদি এসে বললেন, “নীলা চাকরী পেয়ে এতো অহঙ্কারী হয়ে গেলে?” আমি তো সামনে আসতেই বললাম ওহ চম্পাদি কখন এলে? উনি বললেন, “বাহ তুমি দেখলে চেয়ে, এভোয়েড করলে!” হায়রে আর এরপর চশমা খুলে কোনো অনুষ্ঠানে যাইনা। যা হোক চশমা খুলে ছেলেকে দিলাম।

চোখ বাঁধা চলছে
চোখ বাঁধা চলছে
চল চল ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল
চল চল ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল   
"আরো কাছাকাছি, আরো কাছে এসো"
“আরো কাছাকাছি, আরো কাছে এসো” 

চোখ বাঁধা হলো। যেখানে চশমা খুলে আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজেই নিজেকে দেখিনা, তাকে এতো টাইট করে চোখ কি না বাঁধলেই নয়? আর এও জানি এ জীবনে হাঁড়ি ভাঙ্গায় আমি পরাজিত একজন সৈনিক। হাতে লাঠি দেয়া হলো। লাঠি উপরে তুলে “হাঁটি হাঁটি পা পা, ওরে বুড়ী হেঁটে যা।” যাচ্ছি, যাচ্ছি, যাচ্ছি……কানে কোনো শব্দ আসছে না। তার মানে কি চলে এসেছি? নাকি উল্টো-বাঁকা পথে হাঁটছি? ভাবলাম ধুত্তোর যা হবার হবে। ঘাসের উপর সেভাবে শব্দ হয়নি, কিন্তু যতো শক্তি আছে দিলাম প্যাঁদানি। বেশ তালি পড়লো। চোখের কাপড় নিজেই খুলে দেখি তরমুজটা ভাঙ্গেনি কিন্তু একেবারে ছুঁয়ে ফেলেছি। একমাত্র আমি-ই সোজা গিয়েছি। কেউ কেউ বলছিলো আমি নাকি দেখতে পেয়েছি।  ^:^   আমরা বাঙ্গালীরা যে ভালো সন্দেহবাতিক এটা আসলেই সত্যি। খেলা শেষের পর খাওয়া। চিকেন বিরিয়ানি-ডিম-সালাদ আর বারবিকিউ খাওয়ার পর পেটে ছিলো না জায়গা। সত্যি বলতে কি বিরিয়ানি আমি খাই বাধ্য হয়ে, খুবই অপছন্দের একটা খাবার।

তবুও আনন্দ হলো, একটি দিন অন্যরকম কাটলো। তরমুজ ভাঙ্গা প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার আনন্দ কি, সেটা জীবনে প্রথম জানলাম। আর তরমুজটা এত্তো স্বাদের ছিলো, “মিষ্টি যেনো গুড়”।   ফিরে আসার সময়ও হলো। ফেরার সময় দশ মিনিটের দূরত্ত্বে শ্রীমঙ্গলের পিকনিক হচ্ছিলো, সেখানেও গেলাম। বান্ধবী ঊর্মী আর ওর বর সঞ্জয়দাও এলো আমাদের সাথে। বেশ মজায় কেটে গেলো দিনটা। রাতে আর ঘুমই হয়নি। ভোরে কখন যে চোখ লেগে গেলো জানিনা। উঠে দেখি আকাশ মেঘে ঢাকা, শাওন-ধারা ঝরবে আবহাওয়া দপ্তর বলেছে। লেখাটা লেখার কথা ছিলো না। এমন আহামরি কিছু না বলার মতো। কিন্তু নীতেশ বড়ুয়া দাদার আব্দারে লিখতে হলো। উনি বললেন ছবি দিতে আসলেই ভেঙ্গেছি কিনা। মন্তব্যের ঘরে ছবি দেয়া যায় কিভাবে জানিনা। তখন বললেন নতূন পোষ্ট লিখতে। আমার অবস্থাটা কি আমি জানি। নীতেশ বড়ুয়া দাদাকে মন্তব্যের রিপ্লাই দিলাম যা সেটাই কপি-পেষ্ট করে দিচ্ছি।
“ওহ আবার পোষ্ট? পুরোনো কতোগুলো ধারাবাহিকের কি হবে গো? আমি কই যাই? ‘হে মা কালী বাঁচাও তুমি আমারে।’ ভানু বন্দোপাধ্যায়ের কৌতুকের গান, তাই না?” :D)

খুব ইচ্ছে ছিলো সেই পাহাড়ের কাছে যাবার
যেখানে আলো-অন্ধকারে খেলা করবে লজ্জ্বা-মৌণতা
পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছোট্ট একটা ঘর,
তার পাশেই কলকল করে বয়ে যাবে একটি নদী।
তারপর বেশ কয়েকদিন ওখানেই।
কোথায় আর হলো!

কবে, কোন কালে স্বপ্ন দেখেছিলো একটি তরুণী মেয়ে
আহ্লাদী-অভিমানী সময় পার করার,
কতো ইচ্ছে ছিলো তার সেই পাহাড় ছোঁওয়ার
যেখানে “ও” নোখ আঁচড়ে লিখে রেখেছে সেই তরুণীর নাম।

**লেখাটি দুটি সময়ের। প্রথম অংশটি আজকের ২০১৫ সালের ১০ আগষ্টের, আর নীচের অংশটি ১৯৯৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বরের। নীচের অংশটি রাফ ছিলো, একটু আগে পেলাম লেখাটি ছেঁড়া একটি নোটবুকের পাতায়। কি সুন্দর সেতু-বন্ধন ২০ বছরের, তাই না?

হ্যামিল্টন, কানাডা
১০ আগষ্ট, ২০১৫ ইং।

ফটোশেসন তিন
ফটোশেসন তিন
ফটোসেশন চার
ফটোসেশন চার 
২৬৬৩জন ২৬৪৬জন
0 Shares

৪২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ